Industry 4.0 | চতুর্থ শিল্প বিপ্লব | টেক্সটাইল এবং পোশাক শিল্প - Textile Lab | Textile Learning Blog
Industry 4.0



কানাডিয়ান দার্শনিক ও লেখক হার্বাট মার্শাল ম্যাকলুহানের গ্লোবাল ভিলেজের (১৯৬২)  ধারণার সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। গ্লোবাল ভিলেজ এর উপাদান সমূহের মধ্যে রয়েছে হার্ডওয়্যার বা কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি,  প্রোগ্রামসমূহ বা সফটওয়্যার,  ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতা, ডেটা বা ইনফরমেশন, ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেটই হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারক ও বাহক। তাহলে এবার ধাপে ধাপে আগের তিনটি শিল্প বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করা যাক। 



প্রথম শিল্প বিপ্লব। আজকে দিন আগামী দিনের কাছে ইতিহাস হয়ে যাবে। প্রথম শিল্প বিপ্লব এখন আমাদের কাছে শুধু ইতিহাস। প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ১৭৮৪ সালে। এ বিপ্লবের প্রধান  আবিষ্কার হলো রেল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। একটু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন তো এই রেল বাষ্পীয় ইঞ্জিন তখনকার সময়ে বিশ্ব বাণিজ্য অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে কেমন পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্যই রেল বাষ্পীয়  ইঞ্জিন তখনকার সময়ের আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

এবার আসি দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং এটা চলেছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। তড়িৎ ও এসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে ব্যাপক উৎপাদন করায় ছিল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অবদান অর্থাৎ ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার ছিল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের উপাদান। প্রথম শিল্প বিপ্লবের রেল বাষ্পীয়  ইঞ্জিন এখন আর তেমন প্রচলিত না থাকলেও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের বিদ্যুৎ ছাড়া এখন আমাদের একমুহূর্ত ভাবণা কল্পনাতীত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অন্যতম উপাদান বিদ্যুতের অবদান। 



দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের বিদ্যুৎকে নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। ১৯৬০ সালে শুরু হয় তৃতীয়  শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লবকে কম্পিউটার বা ডিজিটাল বিপ্লব বলা হয়। সেমিকন্ডাক্টর,মেইন ফ্রেম কম্পিউটার,  পার্সোনাল কম্পিউটার (১৯৭০-১৯৮০) ও ইন্টারনেট এ বিপ্লবের ধারক। 

আমরা বর্তমানে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের শেষার্ধে বসবাস করছি। কারণ আমাদের  নিত্যদিনের সামগ্রীর মাঝে এখন চতুর্থ  শিল্প বিপ্লবের দামামা বেজে উঠেছে। 


ডিজিটাল বিপ্লবকে কেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে আলোচনার জন্য সারা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা,জড়ো হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের দাভোসে।সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস সোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন আমরা চাই বা না চাই এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা কাজকর্ম চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। 

আগেই বলেছি গ্লোবাল ভিলেজের কথা যার প্রধান উপাদান হলো ইন্টারনেট। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আক্ষরিক অর্থে বিশ্বগ্রামের পরিণত করবে।এটির দ্বারা যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হবে। আর যে কোন শিল্প বিপ্লবের প্রধান উদ্দেশ্যই কোন কিছু আবিষ্কার করে কোন সময় সকলের কাছে উপস্থাপন করা। গ্লোবাল ভিলেজের ইন্টারনেটই হলো কম  সময়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর অন্যতম কৌশল । 

মোট কথায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভর-শক্তি ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন লার্নিং। 

পুরোপুরি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করতে হলে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে ইন্টারনেট অফ থিংস,আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, থ্রিডি প্রিন্টার ও মাইক্রো প্রযুক্তি ইত্যাদি। 

যেহেতু ইন্টারনেট-ই  হলো এই শিল্প বিপ্লবের ধারক-বাহক তাহলে আমাদের জানা দরকার ইন্টারনেট অফ থিংস আসলে কি? ইন্টার্নেট অফ থিংস হলো বাসার সকল আসবাব ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সাথে যুক্ত এই সিস্টেমকে বলা হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস। এর দ্বারা  আমরা সহজেই আমাদের দৈনন্দিন কাজের সকল তথ্যাদি নিজেদের মুঠোফোনে পেয়ে যাবো।এমকি আমাদের শরীরের জন্য কতটুকু ক্যালরি দরকার সে বিষয়ে তথ্য দিয়ে জানিয়ে দেবে আমাদের মুঠোফোনগুলো। 

ইন্টার্নেট অফ থিংস এর কারণে আমাদের কোন কিছুর বিল পরিশোধের জন্য ক্যালেন্ডারের তারিখ গুনতে হবে না। নির্দিষ্ট দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেবে আমাদের বিভিন্ন বিল পরিশোধের তথ্য। 

কারখানার বিপদজনক কাজ, স্থাপনার শ্রমিক, নিরাপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থলীর কাজ সব কাজই করতে শুরু করবে রোবট। শুধু আমাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রোগ্রামের কারণেই রোবট এ সকল কাজ অনায়াসে  করে দিয়ে আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে আরো সহজতর করে তুলবে। 


অটোমেশন কারখানার সবগুলো মেশিন এমন একটি সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে। একেই বলা হচ্ছে অটোমেশন। অটোমেশনের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানিতে লক্ষ্য করা যায়। ঠিক এই সময়ে আপনি যেই কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন হাতের নাগালে পেয়েছেন তার কোনো না কোনো যন্ত্রাংশ  অটোমেশন কারখানার উপাদান। অটোমেশন কারখানাগুলোর ফলে স্বল্প সময়ে উৎপাদন বাড়বে শ্রম কমবে। কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়া পুরোটাই রোবট নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। যেখানে রোবটগুলো কন্ট্রোল করা ছাড়া সাধারণ শ্রমিকদের আর তেমন কাজ থাকবে না। যার ফলে কারখানার মালিকদের স্বল্প সময়ে উৎপাদন যেমন বাড়বে পক্ষান্তরে তাদের উৎপাদন খরচটাও কমে যাবে। কারণ মানুষের বদলে রোবটগুলো স্থাপন করা হলে তখন কারখানার মালিকদের আর কোটি কোটি টাকা শ্রমিকদের মাসিক বেতন দিতে হচ্ছে না। যদি একটি কোম্পানির সর্বক্ষেত্রে অটোমেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায় তাহলে কোন একপর্যায়ে পণ্য উৎপাদন ব্যয় শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ে ভিন্ন গ্রহে বসতি গড়তে মানুষকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। মানুষকে নিরাপদে রাখতে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শক্তিশালী কম্পিউটিং।মানুষের বিভিন্ন জটিল রোগের অস্ত্রোপচার করার জন্য উদ্ভাবিত হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি।

 এবার আসি বাংলাদেশের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক খাত।সম্প্রতি  বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে লেজার কাটিং মেশিন ব্যবহার করেছে। যা কয়েকটি ব্যাচে অজস্র কাপড় কেটে ফেলতে পারে স্বল্প সময়েই। ক্রমান্বয়ে কারখানার সকল কাজেই মানুষের বিকল্প হবে প্রযুক্তি। 


নিউইয়র্কের শিমি টেকনোলজি নামে একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সারাহ ক্রেশলি তিনি দশ বছর পরের পোশাক কারখানা কল্পনা করতে গিয়ে বলেছেন দশ বছর পরের পোশাক কারখানার খুব অল্প শ্রমিকই আসলে কাজ করবে।রোবোটিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি তখনো আমরা হয়তো কিছু কর্মীকে কাজ করতে দেখব। কারখানা জুড়ে তখন বেশি থাকবে নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় রোবটিক যন্ত্রপাতি। থাকবে অনেক কম্পিউটার।কারখানার বড় অংশ জুড়ে  থাকবে ডিভাইস রুম। বেশীরভাগ কর্মী কাজ করবে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে। 

এর ফলে বিশাল জনসম্পদ কিংবা স্বল্পশিক্ষিত কেবল কায়িক শ্রমে উপার্জনে নির্ভর মানুষগুলোর কর্মহীন হয়ে যাবে অর্থাৎ এদের মধ্যে প্রায় ৬০ থেকে ৮৮ শতাংশ মানুষ কাজ হারাবে অটোমেশনের কারণে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হবে এটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে। যেখানে আমেরিকার মতো প্রযুক্তিনির্ভর দেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ কাজ হারাবে।

তাহলে এখন থেকে বাংলাদেশ সরকারের ভাবা উচিত এই বিশাল কর্মহীন মানুষকে কীভাবে সামাল দেবে। এর জন্য কি বাংলাদেশ প্রস্তুত? 

তবে গত বছরের ১৫ ই অক্টোবর ২০১৯ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর জানিয়েছেন যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবটিক্সসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন করা হবে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা যেন সকল বিষয়ে মৌলিক ধারণা পায় সেলক্ষ্যে সমন্বিত সিলেবাস প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। 


বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আজ আমরা প্রযুক্তিখাতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি। দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট প্রযুক্তি; যা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগমাধ্যম আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে ২৮টি হাই-টেক পার্ক; যা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলীদের এগিয়ে চলার পথকে আরো সুগম করে তুলছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং উদ্ভাবনের ফলে দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠছে উন্নত ও আধুনিক ল্যাব।

বর্তমান সরকারের এমন প্রশংসনীয় পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে আমরা যদি লাভবান হতে চাই, তাহলে আমাদের দেশকে প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। 

বিশ্বজুড়ে চলমান মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ স্থিতিশীল জিডিপি অর্জন করেছে। বিশ্বে সপ্তম জনবহুল (১৬০ মিলিয়ন) দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। 

এদেশের ১৫ থেকে ৩৫ বছরের ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি) যুবশক্তিকে আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জিত হবে। আমাদের ৮ কোটি ১৫-৩৫ বছরের যুবক-ই আমাদের বিশাল সম্পদ। 

ধারণা করা যায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন তৈরী হওয়া সকল সম্ভাবনা(অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস,উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন)  বাংলাদেশ দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়ে সামনে আরো এগিয়ে যাবে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১,২০৩০,২০৪১ ডেল্টা প্ল্যান অর্জন করা সম্ভব হবে।





কে.এম.ওলিউল্লাহ মনির
STEC 

Industry 4.0 | চতুর্থ শিল্প বিপ্লব | টেক্সটাইল এবং পোশাক শিল্প

Industry 4.0



কানাডিয়ান দার্শনিক ও লেখক হার্বাট মার্শাল ম্যাকলুহানের গ্লোবাল ভিলেজের (১৯৬২)  ধারণার সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। গ্লোবাল ভিলেজ এর উপাদান সমূহের মধ্যে রয়েছে হার্ডওয়্যার বা কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি,  প্রোগ্রামসমূহ বা সফটওয়্যার,  ব্যক্তিবর্গের সক্ষমতা, ডেটা বা ইনফরমেশন, ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেটই হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারক ও বাহক। তাহলে এবার ধাপে ধাপে আগের তিনটি শিল্প বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করা যাক। 



প্রথম শিল্প বিপ্লব। আজকে দিন আগামী দিনের কাছে ইতিহাস হয়ে যাবে। প্রথম শিল্প বিপ্লব এখন আমাদের কাছে শুধু ইতিহাস। প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ১৭৮৪ সালে। এ বিপ্লবের প্রধান  আবিষ্কার হলো রেল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। একটু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন তো এই রেল বাষ্পীয় ইঞ্জিন তখনকার সময়ে বিশ্ব বাণিজ্য অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে কেমন পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্যই রেল বাষ্পীয়  ইঞ্জিন তখনকার সময়ের আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

এবার আসি দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং এটা চলেছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। তড়িৎ ও এসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে ব্যাপক উৎপাদন করায় ছিল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অবদান অর্থাৎ ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার ছিল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের উপাদান। প্রথম শিল্প বিপ্লবের রেল বাষ্পীয়  ইঞ্জিন এখন আর তেমন প্রচলিত না থাকলেও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের বিদ্যুৎ ছাড়া এখন আমাদের একমুহূর্ত ভাবণা কল্পনাতীত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অন্যতম উপাদান বিদ্যুতের অবদান। 



দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের বিদ্যুৎকে নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। ১৯৬০ সালে শুরু হয় তৃতীয়  শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লবকে কম্পিউটার বা ডিজিটাল বিপ্লব বলা হয়। সেমিকন্ডাক্টর,মেইন ফ্রেম কম্পিউটার,  পার্সোনাল কম্পিউটার (১৯৭০-১৯৮০) ও ইন্টারনেট এ বিপ্লবের ধারক। 

আমরা বর্তমানে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের শেষার্ধে বসবাস করছি। কারণ আমাদের  নিত্যদিনের সামগ্রীর মাঝে এখন চতুর্থ  শিল্প বিপ্লবের দামামা বেজে উঠেছে। 


ডিজিটাল বিপ্লবকে কেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে আলোচনার জন্য সারা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা,জড়ো হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের দাভোসে।সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস সোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন আমরা চাই বা না চাই এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা কাজকর্ম চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। 

আগেই বলেছি গ্লোবাল ভিলেজের কথা যার প্রধান উপাদান হলো ইন্টারনেট। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আক্ষরিক অর্থে বিশ্বগ্রামের পরিণত করবে।এটির দ্বারা যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হবে। আর যে কোন শিল্প বিপ্লবের প্রধান উদ্দেশ্যই কোন কিছু আবিষ্কার করে কোন সময় সকলের কাছে উপস্থাপন করা। গ্লোবাল ভিলেজের ইন্টারনেটই হলো কম  সময়ে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর অন্যতম কৌশল । 

মোট কথায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভর-শক্তি ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন লার্নিং। 

পুরোপুরি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করতে হলে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে ইন্টারনেট অফ থিংস,আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, থ্রিডি প্রিন্টার ও মাইক্রো প্রযুক্তি ইত্যাদি। 

যেহেতু ইন্টারনেট-ই  হলো এই শিল্প বিপ্লবের ধারক-বাহক তাহলে আমাদের জানা দরকার ইন্টারনেট অফ থিংস আসলে কি? ইন্টার্নেট অফ থিংস হলো বাসার সকল আসবাব ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সাথে যুক্ত এই সিস্টেমকে বলা হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস। এর দ্বারা  আমরা সহজেই আমাদের দৈনন্দিন কাজের সকল তথ্যাদি নিজেদের মুঠোফোনে পেয়ে যাবো।এমকি আমাদের শরীরের জন্য কতটুকু ক্যালরি দরকার সে বিষয়ে তথ্য দিয়ে জানিয়ে দেবে আমাদের মুঠোফোনগুলো। 

ইন্টার্নেট অফ থিংস এর কারণে আমাদের কোন কিছুর বিল পরিশোধের জন্য ক্যালেন্ডারের তারিখ গুনতে হবে না। নির্দিষ্ট দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেবে আমাদের বিভিন্ন বিল পরিশোধের তথ্য। 

কারখানার বিপদজনক কাজ, স্থাপনার শ্রমিক, নিরাপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থলীর কাজ সব কাজই করতে শুরু করবে রোবট। শুধু আমাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রোগ্রামের কারণেই রোবট এ সকল কাজ অনায়াসে  করে দিয়ে আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে আরো সহজতর করে তুলবে। 


অটোমেশন কারখানার সবগুলো মেশিন এমন একটি সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে। একেই বলা হচ্ছে অটোমেশন। অটোমেশনের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানিতে লক্ষ্য করা যায়। ঠিক এই সময়ে আপনি যেই কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন হাতের নাগালে পেয়েছেন তার কোনো না কোনো যন্ত্রাংশ  অটোমেশন কারখানার উপাদান। অটোমেশন কারখানাগুলোর ফলে স্বল্প সময়ে উৎপাদন বাড়বে শ্রম কমবে। কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়া পুরোটাই রোবট নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। যেখানে রোবটগুলো কন্ট্রোল করা ছাড়া সাধারণ শ্রমিকদের আর তেমন কাজ থাকবে না। যার ফলে কারখানার মালিকদের স্বল্প সময়ে উৎপাদন যেমন বাড়বে পক্ষান্তরে তাদের উৎপাদন খরচটাও কমে যাবে। কারণ মানুষের বদলে রোবটগুলো স্থাপন করা হলে তখন কারখানার মালিকদের আর কোটি কোটি টাকা শ্রমিকদের মাসিক বেতন দিতে হচ্ছে না। যদি একটি কোম্পানির সর্বক্ষেত্রে অটোমেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায় তাহলে কোন একপর্যায়ে পণ্য উৎপাদন ব্যয় শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ে ভিন্ন গ্রহে বসতি গড়তে মানুষকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। মানুষকে নিরাপদে রাখতে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শক্তিশালী কম্পিউটিং।মানুষের বিভিন্ন জটিল রোগের অস্ত্রোপচার করার জন্য উদ্ভাবিত হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি।

 এবার আসি বাংলাদেশের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক খাত।সম্প্রতি  বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে লেজার কাটিং মেশিন ব্যবহার করেছে। যা কয়েকটি ব্যাচে অজস্র কাপড় কেটে ফেলতে পারে স্বল্প সময়েই। ক্রমান্বয়ে কারখানার সকল কাজেই মানুষের বিকল্প হবে প্রযুক্তি। 


নিউইয়র্কের শিমি টেকনোলজি নামে একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সারাহ ক্রেশলি তিনি দশ বছর পরের পোশাক কারখানা কল্পনা করতে গিয়ে বলেছেন দশ বছর পরের পোশাক কারখানার খুব অল্প শ্রমিকই আসলে কাজ করবে।রোবোটিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি তখনো আমরা হয়তো কিছু কর্মীকে কাজ করতে দেখব। কারখানা জুড়ে তখন বেশি থাকবে নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় রোবটিক যন্ত্রপাতি। থাকবে অনেক কম্পিউটার।কারখানার বড় অংশ জুড়ে  থাকবে ডিভাইস রুম। বেশীরভাগ কর্মী কাজ করবে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে। 

এর ফলে বিশাল জনসম্পদ কিংবা স্বল্পশিক্ষিত কেবল কায়িক শ্রমে উপার্জনে নির্ভর মানুষগুলোর কর্মহীন হয়ে যাবে অর্থাৎ এদের মধ্যে প্রায় ৬০ থেকে ৮৮ শতাংশ মানুষ কাজ হারাবে অটোমেশনের কারণে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হবে এটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে। যেখানে আমেরিকার মতো প্রযুক্তিনির্ভর দেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ কাজ হারাবে।

তাহলে এখন থেকে বাংলাদেশ সরকারের ভাবা উচিত এই বিশাল কর্মহীন মানুষকে কীভাবে সামাল দেবে। এর জন্য কি বাংলাদেশ প্রস্তুত? 

তবে গত বছরের ১৫ ই অক্টোবর ২০১৯ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর জানিয়েছেন যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবটিক্সসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন করা হবে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা যেন সকল বিষয়ে মৌলিক ধারণা পায় সেলক্ষ্যে সমন্বিত সিলেবাস প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। 


বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আজ আমরা প্রযুক্তিখাতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি। দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট প্রযুক্তি; যা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগমাধ্যম আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে ২৮টি হাই-টেক পার্ক; যা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলীদের এগিয়ে চলার পথকে আরো সুগম করে তুলছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং উদ্ভাবনের ফলে দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠছে উন্নত ও আধুনিক ল্যাব।

বর্তমান সরকারের এমন প্রশংসনীয় পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে আমরা যদি লাভবান হতে চাই, তাহলে আমাদের দেশকে প্রযুক্তিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। 

বিশ্বজুড়ে চলমান মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ স্থিতিশীল জিডিপি অর্জন করেছে। বিশ্বে সপ্তম জনবহুল (১৬০ মিলিয়ন) দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। 

এদেশের ১৫ থেকে ৩৫ বছরের ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি) যুবশক্তিকে আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জিত হবে। আমাদের ৮ কোটি ১৫-৩৫ বছরের যুবক-ই আমাদের বিশাল সম্পদ। 

ধারণা করা যায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন তৈরী হওয়া সকল সম্ভাবনা(অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস,উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন)  বাংলাদেশ দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়ে সামনে আরো এগিয়ে যাবে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১,২০৩০,২০৪১ ডেল্টা প্ল্যান অর্জন করা সম্ভব হবে।





কে.এম.ওলিউল্লাহ মনির
STEC 

কোন মন্তব্য নেই: