মেইড ইন বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করাই বাংলাদেশি তরুণ কাদেরের লক্ষ্য - Textile Lab | Textile Learning Blog
মেইড ইন বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করাই বাংলাদেশি তরুণ কাদেরের লক্ষ্য





নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : 

বাংলাদেশি তরুণ মোহম্মদ কাদের। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে বায়ার খোঁজার মাধ্যমে তার ব্যবসা শুরু। বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমানে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছে মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। দেশে-বিদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে আমেরিকার মেইন স্ট্রিমের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করছেন। 

আমেরিকায় সপরিবারে আছেন এলওয়ান ক্যাটাগরির ভিসা নিয়ে। এই অল্প বয়সে তিনি আমেরিকা, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। লক্ষ্য আগামী ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২২ লাইনের একটি গার্মেন্ট কারখানা করার, যেখানে কাজ করবেন ২২০০ মানুষ। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গার্মেন্টের তৈরি পোশাক আমদানি করছেন। তবে এটা নিজেদের জন্য নয়, আমেরিকার বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা কোম্পানির হয়ে তার কোম্পানি কাজ করছে। আমেরিকার বড় বড় কোম্পানির পক্ষে সব দেশে নিজস্ব লোক দিয়ে কোয়ালিটি এনশিওর করা সম্ভব নয় বলে তারা বিভিন্ন দেশে পণ্যের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা ও আমদানি করার জন্য বায়াররা মিডিলম্যান নিয়োগ করে, যারা কোয়ালিটি এনশিওর করে। ওয়াইটিএ তেমনই একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির নামেই মোহম্মদ কাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ২০১৬ সালে ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিবছর তিনি বাংলাদেশ থেকে ১০০ কনটেইনার পণ্য আনেন। এক-একটি কনটেইনারে পণ্য থাকে প্রায় ৫০০০ কেজি, যার জন্য ৮০০০ ডলার ডিউটি ও ট্যাক্স দিতে হয়। ব্যক্তিগত কোম্পানি পর্যায়ে যে কজন বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করছেন, তিনি তাদের একজন। তার পরিকল্পনা রয়েছে আগামী বছর এটাকে ১৫০-২০০ কনটেইনারে উন্নীত করা। এখন বিভিন্ন কোম্পানিতে পণ্য সরবরাহ করছেন। ভবিষ্যতে মেসি, গ্যাপের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য তারা বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য সরবরাহ করবেন।


মোহম্মদ কাদেরের বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। এই অল্প বয়সেই কাজ করেছেন জাতিসংঘে ইয়ুথ অ্যাসেম্বলিতে ইয়ুথ অবজারভার হিসেবে, গড়ে তুলেছেন গ্লোবাল এডুকেশন নিউইয়র্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জ্যামাইকা থেকে ট্রেনিং করানো হয়, পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন ইউএসএ ইনক গঠন করেছেন, ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করছেন আইটি জোন ইউএসের, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন পাইওনিয়র ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের, মেম্বার এব অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশÑআটাবের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ গ্রোসির বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ২০১০ সাল থেকে, ২০১৬ সালে ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হন, ২০১৪ সালে আমেরিকান- মালয়েশিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সদস্য, পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন এসডিএনবিএইচডির বোর্ড অব ডিরেক্টরস, ২০১০ সাল থেকে মেম্বার স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম বিজনেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আমেরিকান বাংলাদেশি বিজনেস অ্যালায়েন্সের (আবা) সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ইউএসএর ওয়াইটিএ কোম্পানির সিইওর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন ইউএসএর প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে পাইওনিয়র ট্রেডিং করপোরেশন আর মালয়েশিয়ায় পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন এসডিএনবিএইচডি নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব ধরনের গার্মেন্ট পণ্য আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি দেশ থেকে ব্যবসা করছেন।
মোহম্মদ কাদের এখানে আসার পর লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সিটি ইউনিভার্সিটির বারুখ কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ই-কমার্স বিষয়ে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করেন। এর আগে বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছেন। স্কুল ও কলেজ ছিল ঢাকা সিটি কলেজ ও ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল। নিউইয়র্কে বসবাস করলেও ব্যবসার কাজে প্রায়ই তাকে বাংলাদেশে যেতে হয়।
সম্প্রতি জ্যামাইকায় তার সঙ্গে ঠিকানার কথা হয়। এ দেশে তার আসা এবং এখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, কাজ করা এবং আগামী দিনের পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। দেশ থেকে ব্যবসা করা প্রসঙ্গে বলেন, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মূলত এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করব। আমি এখানে ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি এবং করছিও, তবে কোনো আলোচনায় থাকতে চাই না। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছি। মেইন স্ট্রিমের অনেকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে। তবে আমাদের কমিউনিটিতেও আমার যাতায়াত কম। এ কারণে অনেকেই আমাকে না-ও চিনতে পারেন। আমি কাজের মাধ্যমে পরিচিত হতে চাই।

তিনি বলেন, পাইওনিয়ার ট্রেডিং থেকে আমরা যেকোনো পণ্য বেচা-কেনার জন্য সাপ্লাইয়ার আর বায়ারদের সাহায্য করছি। ওয়াইটিএ থেকে ম্যানুফ্যাকচারার ও বায়ারদের সঙ্গে কাজ করছি হোলসেলার হিসেবে। ওয়াইটিএ থেকে আমরা প্রথমে একটি পণ্যের ডিজাইন করে সেটা ডেভেলপ করাচ্ছি। এরপর ম্যানুফ্যাকচার করাচ্ছি। পণ্য ইন্সপেকশন করছি। পরে পণ্য আমদানি করছি ইউএসএতে। এরপর ডিস্ট্রিবিউশন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই কাজের জন্য আমার এখানে চারজন আমেরিকান রয়েছেন। তারা এখানকার কাজ করছেন। এর বাইরে বাংলাদেশে আমার অফিসে বেশ কয়েকজন কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে ২০০৬ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। মালয়েশিয়ায় শুরু করি ২০১০ সালে আর ইউএসতে ২০১৬ সালে। ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে আরও বেশ কয়েকটি দেশে কোম্পানি করার।


কুমিল্লার ছেলে হলেও তার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের শুরুটা কেটেছে ঢাকায়। এরপর মালয়েশিয়ায়, এখন আমেরিকায়। তিনি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময়ে ইন্টার্নি করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্টে যেতাম। 


সেখানে যেতে যেতেই একটি গার্মেন্ট আমাকে বলল আপনি এ বিষয়ে কাজ করেন। আমি গার্মেন্টের ডিজাস্টার বিষয়ে কাজ করছিলাম। বিশেষ করে, রানা প্লাজা ধসের পরে। এ কারণে তারা বলল আপনাদের সঙ্গে তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বায়ারদের যোগাযোগ হয়। আপনি আমাদের বায়ার জোগাড় করে দেন। তাদের অফিস হচ্ছে কারওয়ান বাজার মোড়ে নায়েগ্রা গার্মেন্টস। মূলত তারা বায়ার জোগাড় করে দেওয়ার কথা বলার পর আমিও দেখলাম কাজটা খারাপ নয়। কারণ, বায়াররা সরাসরি নিজেরা পণ্য ইন্সপেকশন করতে পারে না। আবার অনেক গার্মেন্টস এই সুযোগ নিয়ে মাঝেমধ্যে সব কাপড়ের কোয়ালিটি একই রকমভাবে ধরে রাখতে পারে না। পণ্যের মানও একই হয় না। এ কারণে তারা মিডিয়াম্যান রাখে। বায়িং হাউসটি লিয়েন ফার্ম হিসেবে কাজ করে। বায়ার খোঁজার জন্য প্রথমে চীনের গোয়াংজুতে একটি ফেয়ারে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর সাকসেস হতে পারলাম না। কারণ, সেখানে আমাদের চেয়ে কম দামে ও কম মজুরিতে তারা পণ্য তৈরি করে। এ কারণে তারা আমাদের কাছ থেকে অর্ডার নিতে আগ্রহ দেখায়নি। পরে ঠিক করলাম মালয়েশিয়ায় যাব। কারণ মালয়েশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্পোডিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর কাছে। মোটামুটি ১-২ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু রিচ করা সম্ভব। এই চিন্তা করে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বায়ার পেলাম। আস্তে আস্তে বাংলাদেশে কোম্পানি করলাম। মালয়েশিয়ার পরে বিস্তার ঘটতে ঘটতে এখন ইউএসএতে। আমরা ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত ইউএসএতে পণ্য পাঠাতাম। এখন এখান থেকে নিজেরাই আনছি।


বাংলাদেশ থেকে কী কী পণ্য আমদানি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, টি-শার্ট, ট্রাকস্যুট, হুডিস, লিনজেরিসহ নারীদের বিভিন্ন আইটেম আমদানি করা হয়। তিনি বলেন, আমেরিকায় আমরা ১০টি কোম্পানিতে পণ্য সরবরাহ করছি। এর মধ্যে নর্থ রিপাবলিক, বিগবস, জেনুইন, ব্লু ওয়াটার, ডলার, আল্টিমেট অ্যাপরেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে আমাদের পণ্য সম্পর্কে জানানোর জন্য অনলাইন মার্কেটিং করি। প্রথম যখন এখানে সরাসরি কাজ করা শুরু করি, তখন সেটা সহজ ছিল না। কষ্ট করতে হয়েছে। লাসভেগাসে একটি ম্যাজিক শো হয়েছিল। সেখানে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমাদের অপারেশনাল সিস্টেম সম্পর্কে জানতে পারে এবং আমাদের সম্পর্কে জানে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহ করার জন্য অর্ডার দেয়। তাদের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর বাংলাদেশে আমরা বেশ কয়েকটি গার্মেন্ট কোম্পানির সঙ্গে কথা বলি। তারা বিভিন্ন পণ্য আমাদের দিচ্ছে। এখানে পণ্য আনছি। এর মধ্যে আইমান গার্মেন্টস, বিশ্বাস গার্মেন্ট, হালিমা গার্মেন্টসহ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। নিউজার্সিতে ওয়্যারহাউস রয়েছে আমাদের, সেখানে সব পণ্য এনে রাখি, পরে বিভিন্ন কোম্পানিতে সাপ্লাই দেওয়া হয়। তিনি ম্যানহাটানের ৮ অ্যাভিনিউতে তার মূল অফিসে বসেন। পাশাপাশি জ্যামাইকা ১৬৭-এর অফিসেও বসেন।


মোহম্মদ কাদের বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার। সেটি হতে পারছি না। কারণ, বাংলাদেশের পণ্য তৈরি করার সময়ের যে কমিটমেন্ট, এটা অনেক সময় গার্মেন্ট মালিকরা নির্দিষ্ট সময়ে করতে পারেন না। কমিটমেন্ট ঠিক না থাকার কারণে অনেক সময় সমস্যা হয়। অনেক সময় ক্রেডিটে পণ্য বিক্রি করতে হয়। একটি পণ্য তৈরি করার পর যদি যথাসময়ে না পৌঁছানো যায়, তাহলে বায়ার তা না নিলে মালিককে অনেক বিপদে পড়তে হয়। এ জন্য দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মালিকদের কাজ করতে সুবিধা হয়। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদাকে আরও বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ দূতাবাস ও কনসাল জেনারেলের বিজনেস কনসুলার এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের পণ্য প্রমোট করতে পারে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসতে পারেন। এতে ব্যবসা কিছুটা হলেও বাড়বে।


জিএসপির বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জিএসপি-সুবিধা পাচ্ছে না। জিএসপি-সুবিধা পেলে অনেক সুবিধা হতো। এখন ইউএসএতে আমরা শতকরা সাড়ে ১৬ শতাংশ ডিউটি দিচ্ছি। এটা অনেক বেশি। বিষয়টি নিয়ে ইউএসএর ট্রেড ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে আমাদের সরকারকে। তারা যাতে এটি রিলাক্স ডিউটির ব্যবস্থা করার সুযোগ দেয়। এ জন্য অনেক কাজ করার আছে। ডিউটি রিলাক্স হলে বাংলাদেশের আরো সুবিধা হবে। ব্যবসায়ীদের সুযোগটি নিশ্চিত করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।


নিজের পরিকল্পনার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মসলিন কাপড়ের একসময় অনেক চাহিদা ছিল। চেষ্টা করব এই মসলিন তৈরি করতে এবং একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচিত করে তুলতে। এ দেশে অনেক দেশের নামে ব্যবসা চলে। মেইড ইন ইউএসের পণ্যের জন্য আলাদা শপিং সেন্টারই রয়েছে। সেখানে অন্য কোনো দেশের পণ্য পাওয়া যায় না। তেমনি একটি পরিকল্পনা আছে, যদি আমরা এখানে মেইড ইন বাংলাদেশ নামে একটি শপিং সেন্টার করতে পারি ও এটাকে এখানে ব্র্যান্ডিং করতে পারি। সেখানে সব বাংলাদেশি কোয়ালিটিসম্পন্ন পণ্য বিক্রি হবে। এটা করা গেলে আরও ভালো ভালো ডিজাইন করতে হবে, নতুন নতুন পোশাক তৈরি করতে হবে। যারা কাজ করছেন, তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের পণ্যের মান আরও বাড়বে। মেইড ইন বাংলাদেশ নামে এখানেও মেসি, বিগবসসহ বিভিন্ন কোম্পানির মতো ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমি এই স্বপ্ন নিয়ে মেইড ইন বাংলাদেশ নামে একটি সাইট শুরু করেছিলাম। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেটাকে বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী দিনে প্ল্যানিং আছে, এখানে যারা তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে আনছেন, বাজারজাত করছেন, বায়ারের সঙ্গে ট্রেডিং হাউস হিসেবে কাজ করছেন এবং কোনো না কোনোভাবে তৈরি পোশাক উৎপাদন, রপ্তানি ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত, তাদের সম্পৃক্ত করা। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

এম কাদের এখানে তার স্ত্রী শিপা আমিনকে নিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী সেভ লাইফ নামের একটি এনজিও করেছেন। পিছিয়ে পড়া মানুষ, নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেন। ইয়ুথ ডেলিগেশন হিসেবেও তিনি কাজ করেন।

মোহম্মদ কাদের আরো বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি চেষ্টা করছি তরুণদের জন্য কিছু করার। সেই হিসেবে আমি ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন ইয়ুথ অবজারভার হিসেবে কাজ করছি জাতিসংঘে। এর কাজ হলো প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাদের বয়স ১৬-১৮, তাদের জাতিসংঘে আসার সুযোগ দেওয়া। তাদের এখানে আনার পর তিন দিনের একটি ট্রেনিং দেওয়া হয়। ওই ট্রেনিং নিয়ে তারা যাতে তাদের নিজ নিজ দেশে কাজে লাগাতে পারে, সেই চেষ্টা করা হয়। তাদের আসা-যাওয়ার কোনো খরচ দেওয়া হয় না। তারা নিজ খরচে এখানে আসেন। ফেব্রুয়ারি ও আগস্ট মাসে এই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের সঙ্গে জাতিসংঘ ছাড়াও ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৭টি দেশ থেকে ১০০০ প্রতিনিধি যোগ দেন অনুষ্ঠানে। করিম বেবী নামের একজন অ্যারাবিয়ান আছেন, তিনি ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্যরা নিহত হন। পরিবারের সদস্যদের হারানোর পর গড়ে তোলেন ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন।
তিনি বলেন, আমি এখানে গ্লোবাল এডুকেশন নিউইয়র্ক নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখানে যারা নতুন আসে, ফ্রেশম্যান হিসেবে আসে, তাদের আমরা ছয় মাসের ট্রেনিং দিই। নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, কম্পিউটার ও ইএসএল বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে পারে। এটি মূলত একটি প্রাইভেট ক্যারিয়ার স্কুল। এ জন্য আমরা ২০০ জনকে ট্রেনিং দিয়েছি। তারা এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন। আইটি জোন ইউএসএ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, সেটা থেকেও আমরা ট্রেনিং দিই। প্রতি ব্যাচে ২০ জন করে শিখতে পারে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আমরা চাকরির জন্য সাহায্য করি।
সম্প্রতি মোহম্মদ কাদের আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করার জন্য অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এটা পেয়েছি। এতে খুব ভালো লাগছে। এই পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে আরো বেশি করে কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।

সবশেষে মোহম্মদ কাদের বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পাঠাচ্ছি। আগামী দিনে আরও বিভিন্ন দেশে পণ্য পাঠাব। একজন ইন্টারপ্রেনিওর হিসেবে দেশের পণ্যের প্রসারে কাজ করব। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করাও জরুরি। কারণ দেশের পণ্যের প্রতি মমত্ববোধ এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এখানে কাজ করতে করতে নিজেই দেশে একটি গার্মেন্ট করার পরিকল্পনা করেছি। ইতিমধ্যে প্রজেক্ট প্রোফাইলও তৈরি করা হয়েছে। ২২ লাইনের একটি গার্মেন্ট করব। সেখানে ২২০০ মানুষ কাজ করতে পারবে।

মেইড ইন বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করাই বাংলাদেশি তরুণ কাদেরের লক্ষ্য

মেইড ইন বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করাই বাংলাদেশি তরুণ কাদেরের লক্ষ্য





নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : 

বাংলাদেশি তরুণ মোহম্মদ কাদের। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে বায়ার খোঁজার মাধ্যমে তার ব্যবসা শুরু। বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমানে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছে মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। দেশে-বিদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে আমেরিকার মেইন স্ট্রিমের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করছেন। 

আমেরিকায় সপরিবারে আছেন এলওয়ান ক্যাটাগরির ভিসা নিয়ে। এই অল্প বয়সে তিনি আমেরিকা, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। লক্ষ্য আগামী ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২২ লাইনের একটি গার্মেন্ট কারখানা করার, যেখানে কাজ করবেন ২২০০ মানুষ। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গার্মেন্টের তৈরি পোশাক আমদানি করছেন। তবে এটা নিজেদের জন্য নয়, আমেরিকার বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা কোম্পানির হয়ে তার কোম্পানি কাজ করছে। আমেরিকার বড় বড় কোম্পানির পক্ষে সব দেশে নিজস্ব লোক দিয়ে কোয়ালিটি এনশিওর করা সম্ভব নয় বলে তারা বিভিন্ন দেশে পণ্যের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা ও আমদানি করার জন্য বায়াররা মিডিলম্যান নিয়োগ করে, যারা কোয়ালিটি এনশিওর করে। ওয়াইটিএ তেমনই একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির নামেই মোহম্মদ কাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ২০১৬ সালে ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিবছর তিনি বাংলাদেশ থেকে ১০০ কনটেইনার পণ্য আনেন। এক-একটি কনটেইনারে পণ্য থাকে প্রায় ৫০০০ কেজি, যার জন্য ৮০০০ ডলার ডিউটি ও ট্যাক্স দিতে হয়। ব্যক্তিগত কোম্পানি পর্যায়ে যে কজন বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করছেন, তিনি তাদের একজন। তার পরিকল্পনা রয়েছে আগামী বছর এটাকে ১৫০-২০০ কনটেইনারে উন্নীত করা। এখন বিভিন্ন কোম্পানিতে পণ্য সরবরাহ করছেন। ভবিষ্যতে মেসি, গ্যাপের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য তারা বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য সরবরাহ করবেন।


মোহম্মদ কাদেরের বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। এই অল্প বয়সেই কাজ করেছেন জাতিসংঘে ইয়ুথ অ্যাসেম্বলিতে ইয়ুথ অবজারভার হিসেবে, গড়ে তুলেছেন গ্লোবাল এডুকেশন নিউইয়র্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জ্যামাইকা থেকে ট্রেনিং করানো হয়, পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন ইউএসএ ইনক গঠন করেছেন, ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করছেন আইটি জোন ইউএসের, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন পাইওনিয়র ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের, মেম্বার এব অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশÑআটাবের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ গ্রোসির বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ২০১০ সাল থেকে, ২০১৬ সালে ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হন, ২০১৪ সালে আমেরিকান- মালয়েশিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সদস্য, পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন এসডিএনবিএইচডির বোর্ড অব ডিরেক্টরস, ২০১০ সাল থেকে মেম্বার স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম বিজনেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আমেরিকান বাংলাদেশি বিজনেস অ্যালায়েন্সের (আবা) সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ইউএসএর ওয়াইটিএ কোম্পানির সিইওর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন ইউএসএর প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে পাইওনিয়র ট্রেডিং করপোরেশন আর মালয়েশিয়ায় পাইওনিয়র ট্রেডিং চেইন এসডিএনবিএইচডি নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব ধরনের গার্মেন্ট পণ্য আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি দেশ থেকে ব্যবসা করছেন।
মোহম্মদ কাদের এখানে আসার পর লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সিটি ইউনিভার্সিটির বারুখ কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ই-কমার্স বিষয়ে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করেন। এর আগে বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছেন। স্কুল ও কলেজ ছিল ঢাকা সিটি কলেজ ও ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল। নিউইয়র্কে বসবাস করলেও ব্যবসার কাজে প্রায়ই তাকে বাংলাদেশে যেতে হয়।
সম্প্রতি জ্যামাইকায় তার সঙ্গে ঠিকানার কথা হয়। এ দেশে তার আসা এবং এখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, কাজ করা এবং আগামী দিনের পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। দেশ থেকে ব্যবসা করা প্রসঙ্গে বলেন, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মূলত এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করব। আমি এখানে ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি এবং করছিও, তবে কোনো আলোচনায় থাকতে চাই না। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছি। মেইন স্ট্রিমের অনেকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে। তবে আমাদের কমিউনিটিতেও আমার যাতায়াত কম। এ কারণে অনেকেই আমাকে না-ও চিনতে পারেন। আমি কাজের মাধ্যমে পরিচিত হতে চাই।

তিনি বলেন, পাইওনিয়ার ট্রেডিং থেকে আমরা যেকোনো পণ্য বেচা-কেনার জন্য সাপ্লাইয়ার আর বায়ারদের সাহায্য করছি। ওয়াইটিএ থেকে ম্যানুফ্যাকচারার ও বায়ারদের সঙ্গে কাজ করছি হোলসেলার হিসেবে। ওয়াইটিএ থেকে আমরা প্রথমে একটি পণ্যের ডিজাইন করে সেটা ডেভেলপ করাচ্ছি। এরপর ম্যানুফ্যাকচার করাচ্ছি। পণ্য ইন্সপেকশন করছি। পরে পণ্য আমদানি করছি ইউএসএতে। এরপর ডিস্ট্রিবিউশন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই কাজের জন্য আমার এখানে চারজন আমেরিকান রয়েছেন। তারা এখানকার কাজ করছেন। এর বাইরে বাংলাদেশে আমার অফিসে বেশ কয়েকজন কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে ২০০৬ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। মালয়েশিয়ায় শুরু করি ২০১০ সালে আর ইউএসতে ২০১৬ সালে। ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে আরও বেশ কয়েকটি দেশে কোম্পানি করার।


কুমিল্লার ছেলে হলেও তার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের শুরুটা কেটেছে ঢাকায়। এরপর মালয়েশিয়ায়, এখন আমেরিকায়। তিনি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময়ে ইন্টার্নি করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্টে যেতাম। 


সেখানে যেতে যেতেই একটি গার্মেন্ট আমাকে বলল আপনি এ বিষয়ে কাজ করেন। আমি গার্মেন্টের ডিজাস্টার বিষয়ে কাজ করছিলাম। বিশেষ করে, রানা প্লাজা ধসের পরে। এ কারণে তারা বলল আপনাদের সঙ্গে তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বায়ারদের যোগাযোগ হয়। আপনি আমাদের বায়ার জোগাড় করে দেন। তাদের অফিস হচ্ছে কারওয়ান বাজার মোড়ে নায়েগ্রা গার্মেন্টস। মূলত তারা বায়ার জোগাড় করে দেওয়ার কথা বলার পর আমিও দেখলাম কাজটা খারাপ নয়। কারণ, বায়াররা সরাসরি নিজেরা পণ্য ইন্সপেকশন করতে পারে না। আবার অনেক গার্মেন্টস এই সুযোগ নিয়ে মাঝেমধ্যে সব কাপড়ের কোয়ালিটি একই রকমভাবে ধরে রাখতে পারে না। পণ্যের মানও একই হয় না। এ কারণে তারা মিডিয়াম্যান রাখে। বায়িং হাউসটি লিয়েন ফার্ম হিসেবে কাজ করে। বায়ার খোঁজার জন্য প্রথমে চীনের গোয়াংজুতে একটি ফেয়ারে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর সাকসেস হতে পারলাম না। কারণ, সেখানে আমাদের চেয়ে কম দামে ও কম মজুরিতে তারা পণ্য তৈরি করে। এ কারণে তারা আমাদের কাছ থেকে অর্ডার নিতে আগ্রহ দেখায়নি। পরে ঠিক করলাম মালয়েশিয়ায় যাব। কারণ মালয়েশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্পোডিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর কাছে। মোটামুটি ১-২ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু রিচ করা সম্ভব। এই চিন্তা করে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বায়ার পেলাম। আস্তে আস্তে বাংলাদেশে কোম্পানি করলাম। মালয়েশিয়ার পরে বিস্তার ঘটতে ঘটতে এখন ইউএসএতে। আমরা ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত ইউএসএতে পণ্য পাঠাতাম। এখন এখান থেকে নিজেরাই আনছি।


বাংলাদেশ থেকে কী কী পণ্য আমদানি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, টি-শার্ট, ট্রাকস্যুট, হুডিস, লিনজেরিসহ নারীদের বিভিন্ন আইটেম আমদানি করা হয়। তিনি বলেন, আমেরিকায় আমরা ১০টি কোম্পানিতে পণ্য সরবরাহ করছি। এর মধ্যে নর্থ রিপাবলিক, বিগবস, জেনুইন, ব্লু ওয়াটার, ডলার, আল্টিমেট অ্যাপরেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে আমাদের পণ্য সম্পর্কে জানানোর জন্য অনলাইন মার্কেটিং করি। প্রথম যখন এখানে সরাসরি কাজ করা শুরু করি, তখন সেটা সহজ ছিল না। কষ্ট করতে হয়েছে। লাসভেগাসে একটি ম্যাজিক শো হয়েছিল। সেখানে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমাদের অপারেশনাল সিস্টেম সম্পর্কে জানতে পারে এবং আমাদের সম্পর্কে জানে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহ করার জন্য অর্ডার দেয়। তাদের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর বাংলাদেশে আমরা বেশ কয়েকটি গার্মেন্ট কোম্পানির সঙ্গে কথা বলি। তারা বিভিন্ন পণ্য আমাদের দিচ্ছে। এখানে পণ্য আনছি। এর মধ্যে আইমান গার্মেন্টস, বিশ্বাস গার্মেন্ট, হালিমা গার্মেন্টসহ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। নিউজার্সিতে ওয়্যারহাউস রয়েছে আমাদের, সেখানে সব পণ্য এনে রাখি, পরে বিভিন্ন কোম্পানিতে সাপ্লাই দেওয়া হয়। তিনি ম্যানহাটানের ৮ অ্যাভিনিউতে তার মূল অফিসে বসেন। পাশাপাশি জ্যামাইকা ১৬৭-এর অফিসেও বসেন।


মোহম্মদ কাদের বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার। সেটি হতে পারছি না। কারণ, বাংলাদেশের পণ্য তৈরি করার সময়ের যে কমিটমেন্ট, এটা অনেক সময় গার্মেন্ট মালিকরা নির্দিষ্ট সময়ে করতে পারেন না। কমিটমেন্ট ঠিক না থাকার কারণে অনেক সময় সমস্যা হয়। অনেক সময় ক্রেডিটে পণ্য বিক্রি করতে হয়। একটি পণ্য তৈরি করার পর যদি যথাসময়ে না পৌঁছানো যায়, তাহলে বায়ার তা না নিলে মালিককে অনেক বিপদে পড়তে হয়। এ জন্য দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মালিকদের কাজ করতে সুবিধা হয়। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদাকে আরও বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ দূতাবাস ও কনসাল জেনারেলের বিজনেস কনসুলার এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের পণ্য প্রমোট করতে পারে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসতে পারেন। এতে ব্যবসা কিছুটা হলেও বাড়বে।


জিএসপির বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জিএসপি-সুবিধা পাচ্ছে না। জিএসপি-সুবিধা পেলে অনেক সুবিধা হতো। এখন ইউএসএতে আমরা শতকরা সাড়ে ১৬ শতাংশ ডিউটি দিচ্ছি। এটা অনেক বেশি। বিষয়টি নিয়ে ইউএসএর ট্রেড ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে আমাদের সরকারকে। তারা যাতে এটি রিলাক্স ডিউটির ব্যবস্থা করার সুযোগ দেয়। এ জন্য অনেক কাজ করার আছে। ডিউটি রিলাক্স হলে বাংলাদেশের আরো সুবিধা হবে। ব্যবসায়ীদের সুযোগটি নিশ্চিত করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।


নিজের পরিকল্পনার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মসলিন কাপড়ের একসময় অনেক চাহিদা ছিল। চেষ্টা করব এই মসলিন তৈরি করতে এবং একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচিত করে তুলতে। এ দেশে অনেক দেশের নামে ব্যবসা চলে। মেইড ইন ইউএসের পণ্যের জন্য আলাদা শপিং সেন্টারই রয়েছে। সেখানে অন্য কোনো দেশের পণ্য পাওয়া যায় না। তেমনি একটি পরিকল্পনা আছে, যদি আমরা এখানে মেইড ইন বাংলাদেশ নামে একটি শপিং সেন্টার করতে পারি ও এটাকে এখানে ব্র্যান্ডিং করতে পারি। সেখানে সব বাংলাদেশি কোয়ালিটিসম্পন্ন পণ্য বিক্রি হবে। এটা করা গেলে আরও ভালো ভালো ডিজাইন করতে হবে, নতুন নতুন পোশাক তৈরি করতে হবে। যারা কাজ করছেন, তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের পণ্যের মান আরও বাড়বে। মেইড ইন বাংলাদেশ নামে এখানেও মেসি, বিগবসসহ বিভিন্ন কোম্পানির মতো ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমি এই স্বপ্ন নিয়ে মেইড ইন বাংলাদেশ নামে একটি সাইট শুরু করেছিলাম। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেটাকে বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী দিনে প্ল্যানিং আছে, এখানে যারা তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে আনছেন, বাজারজাত করছেন, বায়ারের সঙ্গে ট্রেডিং হাউস হিসেবে কাজ করছেন এবং কোনো না কোনোভাবে তৈরি পোশাক উৎপাদন, রপ্তানি ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত, তাদের সম্পৃক্ত করা। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

এম কাদের এখানে তার স্ত্রী শিপা আমিনকে নিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী সেভ লাইফ নামের একটি এনজিও করেছেন। পিছিয়ে পড়া মানুষ, নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেন। ইয়ুথ ডেলিগেশন হিসেবেও তিনি কাজ করেন।

মোহম্মদ কাদের আরো বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি চেষ্টা করছি তরুণদের জন্য কিছু করার। সেই হিসেবে আমি ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন ইয়ুথ অবজারভার হিসেবে কাজ করছি জাতিসংঘে। এর কাজ হলো প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাদের বয়স ১৬-১৮, তাদের জাতিসংঘে আসার সুযোগ দেওয়া। তাদের এখানে আনার পর তিন দিনের একটি ট্রেনিং দেওয়া হয়। ওই ট্রেনিং নিয়ে তারা যাতে তাদের নিজ নিজ দেশে কাজে লাগাতে পারে, সেই চেষ্টা করা হয়। তাদের আসা-যাওয়ার কোনো খরচ দেওয়া হয় না। তারা নিজ খরচে এখানে আসেন। ফেব্রুয়ারি ও আগস্ট মাসে এই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের সঙ্গে জাতিসংঘ ছাড়াও ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৭টি দেশ থেকে ১০০০ প্রতিনিধি যোগ দেন অনুষ্ঠানে। করিম বেবী নামের একজন অ্যারাবিয়ান আছেন, তিনি ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্যরা নিহত হন। পরিবারের সদস্যদের হারানোর পর গড়ে তোলেন ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন।
তিনি বলেন, আমি এখানে গ্লোবাল এডুকেশন নিউইয়র্ক নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখানে যারা নতুন আসে, ফ্রেশম্যান হিসেবে আসে, তাদের আমরা ছয় মাসের ট্রেনিং দিই। নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, কম্পিউটার ও ইএসএল বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে পারে। এটি মূলত একটি প্রাইভেট ক্যারিয়ার স্কুল। এ জন্য আমরা ২০০ জনকে ট্রেনিং দিয়েছি। তারা এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন। আইটি জোন ইউএসএ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, সেটা থেকেও আমরা ট্রেনিং দিই। প্রতি ব্যাচে ২০ জন করে শিখতে পারে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আমরা চাকরির জন্য সাহায্য করি।
সম্প্রতি মোহম্মদ কাদের আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করার জন্য অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এটা পেয়েছি। এতে খুব ভালো লাগছে। এই পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে আরো বেশি করে কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।

সবশেষে মোহম্মদ কাদের বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পাঠাচ্ছি। আগামী দিনে আরও বিভিন্ন দেশে পণ্য পাঠাব। একজন ইন্টারপ্রেনিওর হিসেবে দেশের পণ্যের প্রসারে কাজ করব। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করাও জরুরি। কারণ দেশের পণ্যের প্রতি মমত্ববোধ এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এখানে কাজ করতে করতে নিজেই দেশে একটি গার্মেন্ট করার পরিকল্পনা করেছি। ইতিমধ্যে প্রজেক্ট প্রোফাইলও তৈরি করা হয়েছে। ২২ লাইনের একটি গার্মেন্ট করব। সেখানে ২২০০ মানুষ কাজ করতে পারবে।

কোন মন্তব্য নেই: