তাঁত শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত - Textile Lab | Textile Learning Blog
পুরানো সেই দিনের কথা: বঙ্গে তাঁত শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত-



বাংলার তাঁতের কাপড়ের সুখ্যাতির জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একদিন লিখেছিলেন,
“বাংলার মসলিন বাগদাদ রোম চিন
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন”...

তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতো থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভন্ন রকমের হতে পারে। খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সাধারণত তাঁত নামক যন্ত্রটিতে সুতা কুণ্ডলী আকারে টানটান করে ঢুকিয়ে দেয়া থাকে। লম্বালম্বি সুতাগুলিকে "টানা" এবং আড়াআড়ি সুতাগুলিকে "পোড়েন" বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে নেয়া হয় এবং সেলাই করা হয়। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বাংলা তাঁত যন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল - "শানা", "দক্তি" ও "নরাজ"। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তাঁর উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তাঁর নাম "মুঠ-কাঠ"। শানা ধরে রাখার এই দুখানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম "দক্তি"।
শানায় গাঁথা আবশ্যকমত প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার "নরাজ"। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনেন, সেখানে তাঁর কোলেও একটী নরাজ থাকে- তাঁর নাম "কোল-নরাজ"। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।

"তাঁত বোনা" শব্দ কটি এসেছে "তন্তু বয়ন" থেকে। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।
তাঁত শিল্পের ইতিহাস সঠিক বলা মুশকিল ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। এদেরকে এক শ্রেণীর যাযাবর বলা চলে- শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া শাড়ির মান ভালো হচ্ছে না দেখে তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন, চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। ধামরাইয়ে কাজ শুরু করতে না করতেই বসাকরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভাগ হয়ে অনেক বসাক চলে যান প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে। এর পর থেকে বসাক তাঁতিরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়া’ এ দু’গ্রুপে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তাঁত শিল্প মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশা করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারী ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয় হয়ে ওঠে।

তবে এই শিল্প কিভাবে বিকাশ লাভ করে সেই ঘটনাবলী বিশেষ আকর্ষণীয়৷ কুটির শিল্প হিসাবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল৷ বংশ পরস্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে বয়ন উৎকর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য স্থান৷ তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট ‘‘নরসিন্দির শেখের মাঠ’’ গ্রামে গড়ে উঠেছিল যা ‘‘বাবুর হাট’’ নামে পরিচিত ছিল৷ অবিভক্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের চরের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ ছিল না। সুলতানি ও মোঘল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখানকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের রং, নকশা ও বনন পদ্ধতি অন্যান্য সমস্ত এলাকা থেকে আলাদা। এক সময় এদের পূর্বপুরুষরাই জগদ্বিখ্যাত মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে অসম কর গ্রহণ, তাঁতের ওপর আরোপিত নানা বিধি নিষেধ এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জন্য ভারতীয় তাঁত শিল্পের সর্বনাশ ঘটে। এরপর স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ও এই শিল্পের বিকাশের জন্য বিশেষ কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ এই অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে নানা ডিজাইনের , নানা রঙের, নানা ধরণের কাপড়ের ভারতীয় বাজারে অবাধ প্রবেশের ফলে তাঁত শিল্পীরা আরো সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।

ভারতীয় তাঁত শিল্পের অবনতির অন্যতম প্ৰধান কারণ হলো কারখানায় তৈরি কাপড়ের ব্যাপক বিস্তৃতি, সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এইসব বস্ত্রের মান ও গুণ তুলনামূলকভাবে উন্নত। এই কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে যে ব্যাবসায়িক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রয়োজন তা তাঁত শিল্পীরা পাচ্ছেন না। এই পেশার সাথে জড়িত মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো ব্যাবস্থা নেই। পরিবর্তিত রুচি ও পছন্দের সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁত বস্ত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ তাঁতি সমাজের কাছে নেই ফলে তারা সনাতন পদ্ধতিতে সেই সনাতনী মানের কাপড় উৎপাদন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থা তাঁত শিল্পের বিকাশের পথে প্রধানতম অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।
তাঁত শিল্প নিয়ে এতক্ষন যা যা আলোচনা করলাম তা সমস্তই তথ্যভিত্তিক। তাঁত শিল্পের প্রকৃত অবস্থা জানতে হলে বাংলার এমন জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন যেখানের মানুষরা এখনও তাঁত শিল্পের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের দুই স্থানের তাঁত বিখ্যাত- ধনেখালি ও শান্তিপুর।

ধনেখালি, নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় তাঁত, বালুচরি আর তসর-এর হাজারো বৈঢিত্র্য, যেমন রং তেমনি তার বাহার। তবে তাঁতের শাড়ির কদরই যেন সবথেকে বেশি। হুগলি জেলার এই অঞ্চলের কারিগররা নানা সুতোর নিপুণ বুননে তাঁতের শাড়িকে যেভাবে তৈরি করেন তা এক কথায় অনবদ্য। কিন্তু এই কাজ করতে করতে আজ তাদের জীবনই রংহীন হয়ে পড়েছে। এনাদের কথা বলতে গেলেসেই পুরোনো কথাই বলতে হবে আবার। সময় হয়তো অনেকটাই বদলেছে কিন্তু ধনেখালির তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ধনেখালি ও মামুদপুর, পাশাপাশি এই দুই এলাকাকে নিয়ে মোট চারটি তাঁত সমবায় রয়েছে তাঁতিদের। এক সময় প্রতিটি সমবায়ে চারশোজনেরও বেশি তাঁতি কাজ করতেন। তাদের সবরকম সহায়তা এই সমবায়গুলি থেকেই করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এই সব সমবায়ে তাঁতির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। নতুন প্রজন্ম আর এই শিল্পে আসছে না। পুরোনোরাও যারা আছেন তারা অনেকে ছেড়ে যাচ্ছেন, আর যারা আছেন তারা মনে করছেন এই শিল্পে থেকে প্রাপ্য মূল্য তারা পাচ্ছেন না। তাদের দাবি যে একটা শাড়ি বুনে তারা ১০০ টাকা পান কিন্তু তা দিয়ে সংসার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই কোনো তাঁতিই আর চাইছেন না যে তাদের সন্তানরা এই শিল্পে আসুক। আর তাঁতিরা এখন সমবায়গুলি থেকে সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেননা, ফলে ধনেখালির তাঁত ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো নানা সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তাঁতিদের জন্য। সেই সুদিনের আশায় বুক বাধছে নয়া প্রজন্মের তাঁতিরা।

বাংলার আর এক তাঁত শিল্পের পীঠস্থান শান্তিপুর, তাঁত শিল্পের জন্য যার প্রসিদ্ধি সারা ভারত তথা সারা বিশ্ব জুড়ে। প্রথমেই শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। মোঘল আমলেই সর্বপ্রথম শান্তিপুরের উৎকৃষ্ট তাঁতের কাপড় সারা ভারত জুড়ে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। শান্তিপুরের তাঁত নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও আগ্রহী ছিল, তাদের আমলে বছরে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মূল্যের তাঁত বস্ত্র রপ্তানি করা হতো।
শান্তিপুরের তাঁত শিল্প সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন –
‘‘শান্তিপুরে ডুরে শাড়ী সরমের অরি
নীলাম্বরী, উলাঙ্গিনী, সর্বাঙ্গ সুন্দরী’’...

কিন্তু সময় বদলেছে আর তার সাথে সাথে পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। সেই স্বর্ণযুগ আজ আর নেই, বর্তমানে শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী৷ শান্তিপুরী তাঁত এখনও পুরোনো ঐতিহ্য বজায় রাখতে গিয়ে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। আর তাঁত বুনে তাঁতিরা যে টাকা উপার্জন করেন, তাতে সংসার চালানো সম্ভব নয় বর্তমান যুগে। কিন্তু তাঁতিরা এই পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে রাজি নন, কারণ এ শুধু তাদের জীবিকা নয়, এ তাদের বংশগৌরব। সরকারও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে, তাই আশা করাই যায় যে শান্তিপুরের তাঁত শিল্প তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।



● ছবিতে- হস্তচালিত তাঁত যন্ত্রে কর্মব্যস্ত এক তাঁতি। ১৮৭৩ সালে, বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালে তোলা ছবি।

(ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম।)
(তথ্যসূত্র:
১- Saga of Bengal Silk and Handloom Industry by
Dr. Chandan Roy.

২- The warp and woof: An enquiry into the handloom industry in West Bengal by Sujit Kumar Das.

৩- A Study on Bengal Silk Industry: Glorious Past to Deplorable Present by Dr. Chandan Roy.)

তাঁত শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

পুরানো সেই দিনের কথা: বঙ্গে তাঁত শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত-



বাংলার তাঁতের কাপড়ের সুখ্যাতির জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একদিন লিখেছিলেন,
“বাংলার মসলিন বাগদাদ রোম চিন
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন”...

তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতো থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভন্ন রকমের হতে পারে। খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সাধারণত তাঁত নামক যন্ত্রটিতে সুতা কুণ্ডলী আকারে টানটান করে ঢুকিয়ে দেয়া থাকে। লম্বালম্বি সুতাগুলিকে "টানা" এবং আড়াআড়ি সুতাগুলিকে "পোড়েন" বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে নেয়া হয় এবং সেলাই করা হয়। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বাংলা তাঁত যন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল - "শানা", "দক্তি" ও "নরাজ"। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তাঁর উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তাঁর নাম "মুঠ-কাঠ"। শানা ধরে রাখার এই দুখানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম "দক্তি"।
শানায় গাঁথা আবশ্যকমত প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার "নরাজ"। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনেন, সেখানে তাঁর কোলেও একটী নরাজ থাকে- তাঁর নাম "কোল-নরাজ"। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।

"তাঁত বোনা" শব্দ কটি এসেছে "তন্তু বয়ন" থেকে। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।
তাঁত শিল্পের ইতিহাস সঠিক বলা মুশকিল ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। এদেরকে এক শ্রেণীর যাযাবর বলা চলে- শুরুতে এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া শাড়ির মান ভালো হচ্ছে না দেখে তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন, চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। ধামরাইয়ে কাজ শুরু করতে না করতেই বসাকরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভাগ হয়ে অনেক বসাক চলে যান প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে। এর পর থেকে বসাক তাঁতিরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়া’ এ দু’গ্রুপে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তাঁত শিল্প মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশা করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারী ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয় হয়ে ওঠে।

তবে এই শিল্প কিভাবে বিকাশ লাভ করে সেই ঘটনাবলী বিশেষ আকর্ষণীয়৷ কুটির শিল্প হিসাবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল৷ বংশ পরস্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে বয়ন উৎকর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য স্থান৷ তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট ‘‘নরসিন্দির শেখের মাঠ’’ গ্রামে গড়ে উঠেছিল যা ‘‘বাবুর হাট’’ নামে পরিচিত ছিল৷ অবিভক্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের চরের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ ছিল না। সুলতানি ও মোঘল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখানকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের রং, নকশা ও বনন পদ্ধতি অন্যান্য সমস্ত এলাকা থেকে আলাদা। এক সময় এদের পূর্বপুরুষরাই জগদ্বিখ্যাত মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে অসম কর গ্রহণ, তাঁতের ওপর আরোপিত নানা বিধি নিষেধ এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জন্য ভারতীয় তাঁত শিল্পের সর্বনাশ ঘটে। এরপর স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ও এই শিল্পের বিকাশের জন্য বিশেষ কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ এই অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে নানা ডিজাইনের , নানা রঙের, নানা ধরণের কাপড়ের ভারতীয় বাজারে অবাধ প্রবেশের ফলে তাঁত শিল্পীরা আরো সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।

ভারতীয় তাঁত শিল্পের অবনতির অন্যতম প্ৰধান কারণ হলো কারখানায় তৈরি কাপড়ের ব্যাপক বিস্তৃতি, সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এইসব বস্ত্রের মান ও গুণ তুলনামূলকভাবে উন্নত। এই কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে যে ব্যাবসায়িক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রয়োজন তা তাঁত শিল্পীরা পাচ্ছেন না। এই পেশার সাথে জড়িত মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো ব্যাবস্থা নেই। পরিবর্তিত রুচি ও পছন্দের সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁত বস্ত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ তাঁতি সমাজের কাছে নেই ফলে তারা সনাতন পদ্ধতিতে সেই সনাতনী মানের কাপড় উৎপাদন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থা তাঁত শিল্পের বিকাশের পথে প্রধানতম অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।
তাঁত শিল্প নিয়ে এতক্ষন যা যা আলোচনা করলাম তা সমস্তই তথ্যভিত্তিক। তাঁত শিল্পের প্রকৃত অবস্থা জানতে হলে বাংলার এমন জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন যেখানের মানুষরা এখনও তাঁত শিল্পের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের দুই স্থানের তাঁত বিখ্যাত- ধনেখালি ও শান্তিপুর।

ধনেখালি, নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় তাঁত, বালুচরি আর তসর-এর হাজারো বৈঢিত্র্য, যেমন রং তেমনি তার বাহার। তবে তাঁতের শাড়ির কদরই যেন সবথেকে বেশি। হুগলি জেলার এই অঞ্চলের কারিগররা নানা সুতোর নিপুণ বুননে তাঁতের শাড়িকে যেভাবে তৈরি করেন তা এক কথায় অনবদ্য। কিন্তু এই কাজ করতে করতে আজ তাদের জীবনই রংহীন হয়ে পড়েছে। এনাদের কথা বলতে গেলেসেই পুরোনো কথাই বলতে হবে আবার। সময় হয়তো অনেকটাই বদলেছে কিন্তু ধনেখালির তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ধনেখালি ও মামুদপুর, পাশাপাশি এই দুই এলাকাকে নিয়ে মোট চারটি তাঁত সমবায় রয়েছে তাঁতিদের। এক সময় প্রতিটি সমবায়ে চারশোজনেরও বেশি তাঁতি কাজ করতেন। তাদের সবরকম সহায়তা এই সমবায়গুলি থেকেই করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এই সব সমবায়ে তাঁতির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। নতুন প্রজন্ম আর এই শিল্পে আসছে না। পুরোনোরাও যারা আছেন তারা অনেকে ছেড়ে যাচ্ছেন, আর যারা আছেন তারা মনে করছেন এই শিল্পে থেকে প্রাপ্য মূল্য তারা পাচ্ছেন না। তাদের দাবি যে একটা শাড়ি বুনে তারা ১০০ টাকা পান কিন্তু তা দিয়ে সংসার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই কোনো তাঁতিই আর চাইছেন না যে তাদের সন্তানরা এই শিল্পে আসুক। আর তাঁতিরা এখন সমবায়গুলি থেকে সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেননা, ফলে ধনেখালির তাঁত ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো নানা সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তাঁতিদের জন্য। সেই সুদিনের আশায় বুক বাধছে নয়া প্রজন্মের তাঁতিরা।

বাংলার আর এক তাঁত শিল্পের পীঠস্থান শান্তিপুর, তাঁত শিল্পের জন্য যার প্রসিদ্ধি সারা ভারত তথা সারা বিশ্ব জুড়ে। প্রথমেই শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। মোঘল আমলেই সর্বপ্রথম শান্তিপুরের উৎকৃষ্ট তাঁতের কাপড় সারা ভারত জুড়ে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। শান্তিপুরের তাঁত নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও আগ্রহী ছিল, তাদের আমলে বছরে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মূল্যের তাঁত বস্ত্র রপ্তানি করা হতো।
শান্তিপুরের তাঁত শিল্প সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন –
‘‘শান্তিপুরে ডুরে শাড়ী সরমের অরি
নীলাম্বরী, উলাঙ্গিনী, সর্বাঙ্গ সুন্দরী’’...

কিন্তু সময় বদলেছে আর তার সাথে সাথে পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। সেই স্বর্ণযুগ আজ আর নেই, বর্তমানে শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী৷ শান্তিপুরী তাঁত এখনও পুরোনো ঐতিহ্য বজায় রাখতে গিয়ে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। আর তাঁত বুনে তাঁতিরা যে টাকা উপার্জন করেন, তাতে সংসার চালানো সম্ভব নয় বর্তমান যুগে। কিন্তু তাঁতিরা এই পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে রাজি নন, কারণ এ শুধু তাদের জীবিকা নয়, এ তাদের বংশগৌরব। সরকারও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে, তাই আশা করাই যায় যে শান্তিপুরের তাঁত শিল্প তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।



● ছবিতে- হস্তচালিত তাঁত যন্ত্রে কর্মব্যস্ত এক তাঁতি। ১৮৭৩ সালে, বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালে তোলা ছবি।

(ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম।)
(তথ্যসূত্র:
১- Saga of Bengal Silk and Handloom Industry by
Dr. Chandan Roy.

২- The warp and woof: An enquiry into the handloom industry in West Bengal by Sujit Kumar Das.

৩- A Study on Bengal Silk Industry: Glorious Past to Deplorable Present by Dr. Chandan Roy.)

কোন মন্তব্য নেই: