চলমান করোনা সংকট এবং আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি - Textile Lab | Textile Learning Blog
**চলমান করোনা সংকট এবং আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি**


চলমান করোনা সংকটে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক স্ট্যাটাস নিউজফিডে ভেসে বেড়াচ্ছে।এই ভেসে বেড়ানো স্ট্যাটাসে যেমন সমালোচকদের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা দেখেছি ঠিক তেমনি যারা কখনো এই সেক্টরে জব করেনি এমনকি কখনো কোন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টেও জব করেনি তাদেরও অনেক নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাসও দেখেছি। এর অনেকগুলোই যৌক্তিক আবার অনেকগুলো এতোটাই অযৌক্তিক যে বিবেকের তাড়নায় ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই সেক্টরের একজন ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে কিছু কথা লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি। 


১) প্রথমে একটা কথা বলে নেই সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি এই কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঠিক কতটুকু বড়? BGMEA র ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশের টোটাল এক্সপোর্ট ছিলো ৪০.৫ বিলিয়ন ডলার যেখানে এককভাবে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিলো ৩৪.১ বিলিয়ন ডলার যেটা কিনা টোটাল এক্সপোর্টের ৮৪.২১%।পার্সেন্টেজের হিসেবে তো বড় বটেই সংখ্যার হিসাবটা কিন্তু আরো বড়।আমরা জানি ১ মিলিয়ন সমান ১০ লাখ, ১০০০ মিলিয়ন সমান এক বিলিয়ন। অর্থাৎ ১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন। তার মানে ২০১৮-১৯ সালে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর থেকে রপ্তানি বাবদ দেশে অর্থ এসেছে  মোটামুটিভাবে ৩৪০০ কোটি ডলার বা ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (1 USD = 82 BDT হিসাবে)। এই টাকার পুরোটা কিন্তু দেশে রাখা যায়নি কেননা ফেব্রিক অথবা অন্যান্য ট্রিমস হয়তো বাহিরের দেশ থেকে ইমপোর্ট করা লেগেছে। যদি গড়ে ইমপোর্টেড আইটেম কস্টের ৬০% বাদও দেই তাহলেও দেখা যাবে  ৪০% অর্থ দেশে থেকে যাবে যার পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এই টাকা ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি এবং তারা যেসব লোকাল সাপ্লায়ারের কাছ থেকে ম্যাটারিয়াল কিনেছে তাদের কাছে থাকছে। 


কেউ কি ধারনা করতে পারেন যে এই যে আনুমানিক ১ লাখ ১১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা দেশে থাকছে তার দ্বারা কারা কারা উপকৃত হচ্ছে। সরাসরি বললে যারা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে জব করছে তারা উপকৃত হচ্ছে। সেই সংখ্যাটা কারো কারো মতে ৪.৫ মিলিয়ন বা ৪৫ লক্ষ। এখানে পোশাক শ্রমিক আছে, আছে মার্চেন্ডাইজার,আছে অফিস পিয়ন থেকে শুরু করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সবাই। আর কারা আছে? আছে যেসব সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো লোকাল ট্রিমস কিনে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই, আছে ব্যাংকগুলো। কেননা ব্যাংকগুলো সরাসরিভাবে এলসির মাধ্যমে ফ্যাক্টরিগুলোর প্রাথমিক অর্থের যোগান দেয়, তাছাড়া তাদের মাধ্যমে এতো পোশাক শিল্পের বিশাল সংখ্যক মানুষের মান্থলি স্যালারি ট্র্যানজেকশন হচ্ছে, নতুন একাউন্ট ওপেন হচ্ছে, সেভিংস একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে, নতুন নতুন ক্রেডিট কার্ড ওপেন হচ্ছে। আর কারা হচ্ছে? ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ডেভেলপার কোম্পানি, বাড়িওয়ালা, মুদি দোকানদারসহ আরো নানা স্তরের মানুষ এই পোশাক শিল্পের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে উপকৃত হচ্ছে। এর মূল কারন হচ্ছে যেখানে ক্যাশ ফ্লো থাকে সেখানে বেনিফিটেড মানুষও বেশি থাকবে। আল্লাহ পাক না করুন যদি কোন কারনে পোশাক শিল্পের এই বৈদেশিক মুদ্রা আসা বন্ধ হয়ে যায় তবে যাদের কথা বললাম তারা কম বেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 


২)  প্রথম অংশে আমরা এই বিশাল সেক্টরের বিশালতা জানলাম। কিন্তু এই বিশালতার পিছনেও অন্ধকার আছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরে গড়ে উঠা এই সেক্টর আমার মতে এখনো সাসটেইনেবল ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পুরোপুরিভাবে গড়ে উঠতে পারে নাই। কারনটা কি হতে পারে? আমার কাছে যেই কারনটা মনে হয় সেটার আশীর্বাদ এবং অভিশাপ দুইটা দিকই আছে। আগে অভিশাপের ব্যাপারটা বলি। এই যে আমরা কথায় কথায় অনেকেই বলি যে মালিকরা এতো টাকা কি করে যে অনেকসময় ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হয়,অনেক সময় স্যালারি দিতে পারে না। অধিকাংশ ফ্যাক্টরিগুলোতেই প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা গ্র্যাচুইটির মতো সুবিধা নাই যার ফলে দীর্ঘ ১৫/২০ বছরও এই সেক্টরে জব করার পরও শেষ বেলায় অনেককেই শূন্য হাতেই বিদায় নিতে হয়। আবার অনেককেই মালিকরা মুখের কথায় কোন সময় দেওয়া ছাড়াই বিদায় করে দেয়।যার ফলে সেসব এম্পলয়ির জীবনে হঠাৎ করে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। আবার প্ল্যানিং ঠিক না থাকার কারনে কিংবা অতিরিক্ত ব্যাংক লোনের সাথে অর্ডার না থাকলে অনেক ফ্যাক্টরিকেই পথে বসে যেতে হয়। কেনো গার্মেন্টস মালিকরা প্ল্যানিং এবং সুনির্দিষ্ট কাঠামো এতো দিনেও দাড় করতে পারলেন না যার ফলে এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়? আজকে যদি এম্পলয়ীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটি থাকতো তাহলে ফ্যাক্টরি কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলেও প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকা দিয়ে এম্পলয়িরা চাকরি হারানোর সেই প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিতে পারতো। পাশাপাশি তারাও মালিকের দুর্দিনে কিছুটা হলেও সহমর্মিতা দেখাতো। আর কারন ছাড়া এম্পলয়ি ছাটাইয়ের ব্যাপারেও মালিকদের দাম্ভিকতার সুনির্দিষ্ট কোন জবাব এই দীর্ঘ চল্লিশ বছরে এই সেক্টরের এম্পলয়িরা জানতে পারে নাই।






অভিশাপের পর যদি কিছুটা আশির্বাদের কথা বলতে চাই তাহলে সেটাও শুনুন। এই সেক্টরটা এমনি এমনি গড়ে উঠে নাই। এই সেক্টরের শ্রমিকরা যেমন ঘাম ঝড়িয়েছেন তেমনি মালিকদেরও হয়তো রাতের পর রাত ঘুম হারাম হয়েছে তার ইন্ডাস্ট্রিকে দাড় করাতে। কিছু কিছু মালিক আছেন যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন কিংবা দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মালিকই দেখবেন তাদের টাকাগুলো আবার রিইনভেস্ট করেছেন।আমার কথা বিশ্বাস না হলে খোজ নিয়ে দেখবেন দেশের অধিকাংশ নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশের বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো নতুন করে ইনভেস্ট করছে যাতে কিনা লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যদিও তারা শ্রমিকদের টাকা কম দিয়ে লাভ বেশি করেছেন অথবা অন্যান্য যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত ছিলো সেই অর্থ দিয়ে নতুন আরেকটা ইন্ডাস্ট্রি দাড় করিয়েছেন কিন্তু সেই ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেন নতুন করে আবার ঠিকই আরো অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ধরুন যাদের ভাতের সাথে প্রতিবেলা মাছ খাওয়ার কথা ছিলো তারা সেটা পারছেনা কিন্তু যারা ভাত থেতে পারতো না তারা সেই ভাতের সুযোগ পেয়েছে। এই সেক্টরের শ্রমিক থেকে শুরু করে অন্যান্য এম্পলয়িরা অন্য অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু দিনশেষে এটাও সত্য কথা যে এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিন্ম শিক্ষিত শ্রমিক যারা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা আজকে ঠিকই এই সেক্টরের মাধ্যমে করাচ্ছেন। আজকে আমরা আমাদের ন্যায্য অনেক দাবির কথাই বলছি এবং বলবো কিন্তু একইসাথে এটাও আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে কালকে যদি এই ইন্ডাস্ট্রি না থাকে তবে দাবি তো দূরের কথা মাসের বাজারের টাকাও আদায় করতে পারবো না। সুতরাং এই ইন্ডাস্ট্রিকে মালিকদের স্বার্থে না বর্ং আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমাদের বাচিয়ে রাখতে হবে। 

৩) এবার আসুন চলমান করোনা প্রসঙ্গে কথা বলি। করোনা প্রসংগ শুরু করার আগে দুইটা ব্যাপারে আপনাদের ধারনা দিতে চাই। প্রথমটি হচ্ছে আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন আমাদের দেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি চলছে প্রচলিত এলসির মাধ্যমে বা বলা চলে বাকির মাধ্যমে।একটু ভেঙ্গে বলি। বায়ার আপনাকে অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু টাকা পাঠায় দেয় না। 


গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকে প্রাথমিকভাবে ব্যাংকের সহায়তায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে সবকিছু নিজেকে কিনে আনতে হয়।এরপর শিপমেন্ট করার পর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সাবমিট করলে বায়ার টাকা ট্রান্সফার করে। এখানে কিন্তু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোর অনেক বড় রিস্ক থেকে যায় যা কিনা করোনার কারনে আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো পড়তে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে বহির্বিশ্বের সাপ্লাই চেইন কিংবা পন্য ব্যবস্থাপনা আর আমাদের দেশেরটা কিন্তু এক না। আমরা বছরের পর বছর একই জামা পড়ি, ছিড়ে গেলে পট্টি লাগায় পড়ি।ফ্যাশন হাউজগুলোর দুই তিন বছর ধরে ঝুলে থাকা জিনিসও আমরা পছন্দ হলে একই দামে কিনি। আবার এক সিজনের জামা অন্য সিজনেও একই দামে কিনি। কিন্তু বহির্বিশ্বের মার্কেট এবং কনজিউমার অনেক আপডেটেড এবং ফাস্ট। তারা প্রতি সিজনের শুরুতেই নতুন প্রোডাক্ট কিনার জন্য মার্কেটে হুড়োহুড়ি শুরু করে,আমাদের দেশ থেকে ১০ ডলারে কিনে ৫০ ডলারে বিক্রি করা প্রোডাক্ট ও তাদের স্টোরে কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর ডিসকাউন্টে দাম কমতে থাকে। যাহোক যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, তারা তাদের প্রোডাক্টের ইনভেনটরি খুব সুন্দরভাবে মেইনটেইন করে। আমাদের দেশ থেকে গার্মেন্টস গুলো শুরুতে তারা তাদের ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার বা সেন্ট্রাল ওয়ারহাউজে রাখে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন ছোট ছোট স্টোরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। ছোট ছোট স্টোরগুলোর চাহিদার ব্যাপারে তাদের আগে থেকেই মার্কেট এনালাইসিস করা থাকে ফলে সবকিছু মোটামুটি প্ল্যানমাফিক করা থাকে যে কখন বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস শিপ করা হবে, কবে তাদের পোর্টে পৌছাবে, কবে তাদের ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে আর কবে তাদের স্টোরে ডিসপ্লে করবে।
উপরের দুইটি ব্যাপার আগে থেকে বলে নিলাম এই কারনে যাতে করোনা ক্রাইসিস সম্পর্কে বলতে সুবিধা হয়। আরেকটা ব্যাপার একটু বলে নেই, গত বছরের ৩৪.১ বিলিয়ন ডলার রেডিমেড গার্মেন্টস এক্সপোর্টের মধ্যে USA তে ৬.১ বিলিয়ন ডলার, জার্মানিতে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার, UK তে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার, স্পেনে ২.৪ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্সে ২ বিলিয়ন ডলার, ইটালিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট করা হয়েছিলো। অর্থাৎ যেসব দেশে করোনা সবচেয়ে মারাত্মক ভাবে আঘাত হেনেছে সেসব দেশগুলোতেই প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের উপর প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট করা হয়েছিলো। এবার আসি মূল পয়েন্টে। করোনা যখন দেশগুলোতে আঘাত হানলো তখন কি সমস্যা দেখা দিলো? ফেব্রুয়ারি - মার্চের দিকেই মারাত্মক করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে সুপারশপ আর প্রয়োজনীয় স্টোরগুলো ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে দিতে হলো। ফলে স্টোরে যেসব পন্য ছিলো সেগুলো স্টোরেই পড়ে রইলো।অন্যদিকে কেউ তো আর বুঝে নাই যে করোনা এতো বাজেভাবে আঘাত হানবে তাই ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারগুলো আগের শিপমেন্ট করা গুডস লোড করলো। এখন সমস্যা হয়ে দাড়ালো যে স্টোরগুলো যেহেতু বন্ধ তাই নতুন করে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার থেকেও প্রোডাক্ট স্টোরগুলোতে যাচ্ছে না ফলে বায়াররা নতুন করে যেগুলো বাংলাদেশ থেকে শিপমেন্ট করার কথা সেই অর্ডারগুলো নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলো।যেহেতু বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমানে প্রোডাক্টস বায়ারদের নির্দিষ্ট ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে যায় সেহেতু তারা নতুন প্রোডাক্ট রাখতে পারবে না দেখে যেসব অর্ডার কনফার্ম করা হয়েছিলো সেই অর্ডার বাতিল করা শুরু করলো। এখন কথা হচ্ছে এভাবে হুট করে বায়ার অর্ডার বাতিল করলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোই বা কেনো মেনে নিবে? কেননা তারা তো অলরেডি এলসির মাধ্যমে সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে ফেব্রিক এবং অন্যান্য ট্রিমস কিনে নিয়ে আসছে। এখন বায়ার অর্ডার বাতিল করলে সেটার দায়ভার তো বায়ারের নেওয়ার কথা।


বহুত গুনীজন এখন বলবেন এতোদিন গার্মেন্টস মালিকরা অনেক কামাইছে এইবার অর্ডার বাতিল করলে তাদের সমস্যা নাই কিংবা এইটা মালিকদের ব্যাপার। এইসব গুনীজনদের বলছি আপনার কি ধারনা আছে যে এতো অর্ডার বাতিল করলে সেটার লোকসান গার্মেন্টস মালিকরা কিভাবে সামাল দিবে? অনেকে আমাকে বলতে পারেন আমি মালিকদের হয়ে দালালি করছি। কেউ যদি এটা ভেবে থাকেন তাহলে বলবো, অন্য আরো আটদশজন এম্পলয়ির মতো আমিও এই সেক্টরের একজন খেটে খাওয়া এম্পলয়ি। এতোগুলো কথা বলছি এই কারনে যে, গার্মেন্টস মালিকদের অবশ্যই দোষ আছে কিন্তু যতটুকু বাস্তবতা আমি নিজে বুঝতে পারছি ঠিক ততটুকু আপনাদেরও জানানো যাতে কোন ভুল ধারনা নিয়ে না থাকেন। 


যাহোক গার্মেন্টস মালিকদের লোকসান নিয়ে যেটা বলছিলাম।যদিও আমি সরাসরি কোন মালিকপক্ষের সাথে কথা বলি নাই। কিন্তু একটু ধারনা নেওয়ার চেষ্টা করি যে ফ্যাক্টরিগুলো কি পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমি প্রথমে যেই কোম্পানিতে জব শুরু করি তাদের ইয়ারলি টার্নওভার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তাহলে গড়ে প্রতিমাসে টার্নওভার ৪১.৬৬ মিলিয়ন ডলার। যদি এই ফ্যাক্টরির সব বায়ার দুই মাসের অর্ডার বাতিল করে যার অর্ডারের সবকিছু অলরেডি ফ্যাক্টরিটি এলসির মাধ্যমে নিয়ে আসে তাহলে সেই দুই মাসের শিপমেন্টযোগ্য অর্ডারের ভ্যালু আসে ৮৩ মিলিয়ন ডলারের মতো। এখন যদি ধরেও নেই যে, মালিক প্রতি অর্ডারের বিপরীতে ১৫% লাভ করেন তবে তার লাভের অংক বাদ দিলেও এই বাতিল অর্ডারের জন্য তার লায়াবেলিটি ৭০.৮৩ মিলিয়ন ডলার বা বাংলা টাকায় ৫৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা (!!!!)। আপনার কাছে কি এই টাকাটা নিতান্তই সামান্য মনে হয়? এই কোম্পানির ম্যানপাওয়ার ৫০ হাজারেরও বেশি এবং আমি যদ্দুর জানি মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে তারা নতুন ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য কয়েকটি প্লটও কিনেছে। এখন যদি বায়াররা আদতেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই এই কোম্পানির পুরো দুই মাসের অর্ডার বাতিল করে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা তাদের জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা হবে এবং একইসাথে তাদের নতুন প্রজেক্টসহ বর্তমান এমপ্লয়িদের উপরও এটার বিরূপ প্রভাব পড়বে। এরকম করে ছোট বড় সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো বিপদে পড়বে যদি বায়াররা কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই অর্ডার বাতিল করে। 


যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পের এমপ্লয়ীদের বেতন বাবদ ৫০০০ কোটি টাকার একটি প্রনোদনা দিয়েছে সেহেতু এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা আশার আলো তবে এই দুঃসময়ে মন থেকে অন্তত এতোটুকু দোয়া করবেন যাতে এই বেতন নেওয়া যাতে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে শেষ বেতন নেওয়া না হয় এবং আমাদের গার্মেন্টস মালিকগুলো যাতে এই দু:সময় থেকে ঘুরে দাড়াতে পারে। এটা গার্মেন্টস মালিকদের জন্য দোয়া না বরংচ আমাদের নিজেদের জন্য নিজেদের দোয়া।

লিখেছেনঃ আসিফ আজগর 

চলমান করোনা সংকট এবং আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি

**চলমান করোনা সংকট এবং আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি**


চলমান করোনা সংকটে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক স্ট্যাটাস নিউজফিডে ভেসে বেড়াচ্ছে।এই ভেসে বেড়ানো স্ট্যাটাসে যেমন সমালোচকদের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা দেখেছি ঠিক তেমনি যারা কখনো এই সেক্টরে জব করেনি এমনকি কখনো কোন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টেও জব করেনি তাদেরও অনেক নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাসও দেখেছি। এর অনেকগুলোই যৌক্তিক আবার অনেকগুলো এতোটাই অযৌক্তিক যে বিবেকের তাড়নায় ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই সেক্টরের একজন ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে কিছু কথা লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি। 


১) প্রথমে একটা কথা বলে নেই সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি এই কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঠিক কতটুকু বড়? BGMEA র ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশের টোটাল এক্সপোর্ট ছিলো ৪০.৫ বিলিয়ন ডলার যেখানে এককভাবে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিলো ৩৪.১ বিলিয়ন ডলার যেটা কিনা টোটাল এক্সপোর্টের ৮৪.২১%।পার্সেন্টেজের হিসেবে তো বড় বটেই সংখ্যার হিসাবটা কিন্তু আরো বড়।আমরা জানি ১ মিলিয়ন সমান ১০ লাখ, ১০০০ মিলিয়ন সমান এক বিলিয়ন। অর্থাৎ ১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন। তার মানে ২০১৮-১৯ সালে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর থেকে রপ্তানি বাবদ দেশে অর্থ এসেছে  মোটামুটিভাবে ৩৪০০ কোটি ডলার বা ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (1 USD = 82 BDT হিসাবে)। এই টাকার পুরোটা কিন্তু দেশে রাখা যায়নি কেননা ফেব্রিক অথবা অন্যান্য ট্রিমস হয়তো বাহিরের দেশ থেকে ইমপোর্ট করা লেগেছে। যদি গড়ে ইমপোর্টেড আইটেম কস্টের ৬০% বাদও দেই তাহলেও দেখা যাবে  ৪০% অর্থ দেশে থেকে যাবে যার পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এই টাকা ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি এবং তারা যেসব লোকাল সাপ্লায়ারের কাছ থেকে ম্যাটারিয়াল কিনেছে তাদের কাছে থাকছে। 


কেউ কি ধারনা করতে পারেন যে এই যে আনুমানিক ১ লাখ ১১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা দেশে থাকছে তার দ্বারা কারা কারা উপকৃত হচ্ছে। সরাসরি বললে যারা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে জব করছে তারা উপকৃত হচ্ছে। সেই সংখ্যাটা কারো কারো মতে ৪.৫ মিলিয়ন বা ৪৫ লক্ষ। এখানে পোশাক শ্রমিক আছে, আছে মার্চেন্ডাইজার,আছে অফিস পিয়ন থেকে শুরু করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সবাই। আর কারা আছে? আছে যেসব সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো লোকাল ট্রিমস কিনে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই, আছে ব্যাংকগুলো। কেননা ব্যাংকগুলো সরাসরিভাবে এলসির মাধ্যমে ফ্যাক্টরিগুলোর প্রাথমিক অর্থের যোগান দেয়, তাছাড়া তাদের মাধ্যমে এতো পোশাক শিল্পের বিশাল সংখ্যক মানুষের মান্থলি স্যালারি ট্র্যানজেকশন হচ্ছে, নতুন একাউন্ট ওপেন হচ্ছে, সেভিংস একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে, নতুন নতুন ক্রেডিট কার্ড ওপেন হচ্ছে। আর কারা হচ্ছে? ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ডেভেলপার কোম্পানি, বাড়িওয়ালা, মুদি দোকানদারসহ আরো নানা স্তরের মানুষ এই পোশাক শিল্পের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে উপকৃত হচ্ছে। এর মূল কারন হচ্ছে যেখানে ক্যাশ ফ্লো থাকে সেখানে বেনিফিটেড মানুষও বেশি থাকবে। আল্লাহ পাক না করুন যদি কোন কারনে পোশাক শিল্পের এই বৈদেশিক মুদ্রা আসা বন্ধ হয়ে যায় তবে যাদের কথা বললাম তারা কম বেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 


২)  প্রথম অংশে আমরা এই বিশাল সেক্টরের বিশালতা জানলাম। কিন্তু এই বিশালতার পিছনেও অন্ধকার আছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরে গড়ে উঠা এই সেক্টর আমার মতে এখনো সাসটেইনেবল ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পুরোপুরিভাবে গড়ে উঠতে পারে নাই। কারনটা কি হতে পারে? আমার কাছে যেই কারনটা মনে হয় সেটার আশীর্বাদ এবং অভিশাপ দুইটা দিকই আছে। আগে অভিশাপের ব্যাপারটা বলি। এই যে আমরা কথায় কথায় অনেকেই বলি যে মালিকরা এতো টাকা কি করে যে অনেকসময় ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হয়,অনেক সময় স্যালারি দিতে পারে না। অধিকাংশ ফ্যাক্টরিগুলোতেই প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা গ্র্যাচুইটির মতো সুবিধা নাই যার ফলে দীর্ঘ ১৫/২০ বছরও এই সেক্টরে জব করার পরও শেষ বেলায় অনেককেই শূন্য হাতেই বিদায় নিতে হয়। আবার অনেককেই মালিকরা মুখের কথায় কোন সময় দেওয়া ছাড়াই বিদায় করে দেয়।যার ফলে সেসব এম্পলয়ির জীবনে হঠাৎ করে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। আবার প্ল্যানিং ঠিক না থাকার কারনে কিংবা অতিরিক্ত ব্যাংক লোনের সাথে অর্ডার না থাকলে অনেক ফ্যাক্টরিকেই পথে বসে যেতে হয়। কেনো গার্মেন্টস মালিকরা প্ল্যানিং এবং সুনির্দিষ্ট কাঠামো এতো দিনেও দাড় করতে পারলেন না যার ফলে এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়? আজকে যদি এম্পলয়ীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটি থাকতো তাহলে ফ্যাক্টরি কোন কারনে বন্ধ হয়ে গেলেও প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকা দিয়ে এম্পলয়িরা চাকরি হারানোর সেই প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিতে পারতো। পাশাপাশি তারাও মালিকের দুর্দিনে কিছুটা হলেও সহমর্মিতা দেখাতো। আর কারন ছাড়া এম্পলয়ি ছাটাইয়ের ব্যাপারেও মালিকদের দাম্ভিকতার সুনির্দিষ্ট কোন জবাব এই দীর্ঘ চল্লিশ বছরে এই সেক্টরের এম্পলয়িরা জানতে পারে নাই।






অভিশাপের পর যদি কিছুটা আশির্বাদের কথা বলতে চাই তাহলে সেটাও শুনুন। এই সেক্টরটা এমনি এমনি গড়ে উঠে নাই। এই সেক্টরের শ্রমিকরা যেমন ঘাম ঝড়িয়েছেন তেমনি মালিকদেরও হয়তো রাতের পর রাত ঘুম হারাম হয়েছে তার ইন্ডাস্ট্রিকে দাড় করাতে। কিছু কিছু মালিক আছেন যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন কিংবা দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মালিকই দেখবেন তাদের টাকাগুলো আবার রিইনভেস্ট করেছেন।আমার কথা বিশ্বাস না হলে খোজ নিয়ে দেখবেন দেশের অধিকাংশ নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশের বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো নতুন করে ইনভেস্ট করছে যাতে কিনা লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যদিও তারা শ্রমিকদের টাকা কম দিয়ে লাভ বেশি করেছেন অথবা অন্যান্য যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত ছিলো সেই অর্থ দিয়ে নতুন আরেকটা ইন্ডাস্ট্রি দাড় করিয়েছেন কিন্তু সেই ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেন নতুন করে আবার ঠিকই আরো অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ধরুন যাদের ভাতের সাথে প্রতিবেলা মাছ খাওয়ার কথা ছিলো তারা সেটা পারছেনা কিন্তু যারা ভাত থেতে পারতো না তারা সেই ভাতের সুযোগ পেয়েছে। এই সেক্টরের শ্রমিক থেকে শুরু করে অন্যান্য এম্পলয়িরা অন্য অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু দিনশেষে এটাও সত্য কথা যে এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিন্ম শিক্ষিত শ্রমিক যারা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা আজকে ঠিকই এই সেক্টরের মাধ্যমে করাচ্ছেন। আজকে আমরা আমাদের ন্যায্য অনেক দাবির কথাই বলছি এবং বলবো কিন্তু একইসাথে এটাও আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে কালকে যদি এই ইন্ডাস্ট্রি না থাকে তবে দাবি তো দূরের কথা মাসের বাজারের টাকাও আদায় করতে পারবো না। সুতরাং এই ইন্ডাস্ট্রিকে মালিকদের স্বার্থে না বর্ং আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমাদের বাচিয়ে রাখতে হবে। 

৩) এবার আসুন চলমান করোনা প্রসঙ্গে কথা বলি। করোনা প্রসংগ শুরু করার আগে দুইটা ব্যাপারে আপনাদের ধারনা দিতে চাই। প্রথমটি হচ্ছে আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন আমাদের দেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি চলছে প্রচলিত এলসির মাধ্যমে বা বলা চলে বাকির মাধ্যমে।একটু ভেঙ্গে বলি। বায়ার আপনাকে অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু টাকা পাঠায় দেয় না। 


গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকে প্রাথমিকভাবে ব্যাংকের সহায়তায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে সবকিছু নিজেকে কিনে আনতে হয়।এরপর শিপমেন্ট করার পর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সাবমিট করলে বায়ার টাকা ট্রান্সফার করে। এখানে কিন্তু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোর অনেক বড় রিস্ক থেকে যায় যা কিনা করোনার কারনে আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো পড়তে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে বহির্বিশ্বের সাপ্লাই চেইন কিংবা পন্য ব্যবস্থাপনা আর আমাদের দেশেরটা কিন্তু এক না। আমরা বছরের পর বছর একই জামা পড়ি, ছিড়ে গেলে পট্টি লাগায় পড়ি।ফ্যাশন হাউজগুলোর দুই তিন বছর ধরে ঝুলে থাকা জিনিসও আমরা পছন্দ হলে একই দামে কিনি। আবার এক সিজনের জামা অন্য সিজনেও একই দামে কিনি। কিন্তু বহির্বিশ্বের মার্কেট এবং কনজিউমার অনেক আপডেটেড এবং ফাস্ট। তারা প্রতি সিজনের শুরুতেই নতুন প্রোডাক্ট কিনার জন্য মার্কেটে হুড়োহুড়ি শুরু করে,আমাদের দেশ থেকে ১০ ডলারে কিনে ৫০ ডলারে বিক্রি করা প্রোডাক্ট ও তাদের স্টোরে কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর ডিসকাউন্টে দাম কমতে থাকে। যাহোক যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, তারা তাদের প্রোডাক্টের ইনভেনটরি খুব সুন্দরভাবে মেইনটেইন করে। আমাদের দেশ থেকে গার্মেন্টস গুলো শুরুতে তারা তাদের ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার বা সেন্ট্রাল ওয়ারহাউজে রাখে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন ছোট ছোট স্টোরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। ছোট ছোট স্টোরগুলোর চাহিদার ব্যাপারে তাদের আগে থেকেই মার্কেট এনালাইসিস করা থাকে ফলে সবকিছু মোটামুটি প্ল্যানমাফিক করা থাকে যে কখন বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস শিপ করা হবে, কবে তাদের পোর্টে পৌছাবে, কবে তাদের ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে আর কবে তাদের স্টোরে ডিসপ্লে করবে।
উপরের দুইটি ব্যাপার আগে থেকে বলে নিলাম এই কারনে যাতে করোনা ক্রাইসিস সম্পর্কে বলতে সুবিধা হয়। আরেকটা ব্যাপার একটু বলে নেই, গত বছরের ৩৪.১ বিলিয়ন ডলার রেডিমেড গার্মেন্টস এক্সপোর্টের মধ্যে USA তে ৬.১ বিলিয়ন ডলার, জার্মানিতে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার, UK তে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার, স্পেনে ২.৪ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্সে ২ বিলিয়ন ডলার, ইটালিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট করা হয়েছিলো। অর্থাৎ যেসব দেশে করোনা সবচেয়ে মারাত্মক ভাবে আঘাত হেনেছে সেসব দেশগুলোতেই প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের উপর প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট করা হয়েছিলো। এবার আসি মূল পয়েন্টে। করোনা যখন দেশগুলোতে আঘাত হানলো তখন কি সমস্যা দেখা দিলো? ফেব্রুয়ারি - মার্চের দিকেই মারাত্মক করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে সুপারশপ আর প্রয়োজনীয় স্টোরগুলো ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে দিতে হলো। ফলে স্টোরে যেসব পন্য ছিলো সেগুলো স্টোরেই পড়ে রইলো।অন্যদিকে কেউ তো আর বুঝে নাই যে করোনা এতো বাজেভাবে আঘাত হানবে তাই ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারগুলো আগের শিপমেন্ট করা গুডস লোড করলো। এখন সমস্যা হয়ে দাড়ালো যে স্টোরগুলো যেহেতু বন্ধ তাই নতুন করে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার থেকেও প্রোডাক্ট স্টোরগুলোতে যাচ্ছে না ফলে বায়াররা নতুন করে যেগুলো বাংলাদেশ থেকে শিপমেন্ট করার কথা সেই অর্ডারগুলো নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলো।যেহেতু বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমানে প্রোডাক্টস বায়ারদের নির্দিষ্ট ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে যায় সেহেতু তারা নতুন প্রোডাক্ট রাখতে পারবে না দেখে যেসব অর্ডার কনফার্ম করা হয়েছিলো সেই অর্ডার বাতিল করা শুরু করলো। এখন কথা হচ্ছে এভাবে হুট করে বায়ার অর্ডার বাতিল করলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোই বা কেনো মেনে নিবে? কেননা তারা তো অলরেডি এলসির মাধ্যমে সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে ফেব্রিক এবং অন্যান্য ট্রিমস কিনে নিয়ে আসছে। এখন বায়ার অর্ডার বাতিল করলে সেটার দায়ভার তো বায়ারের নেওয়ার কথা।


বহুত গুনীজন এখন বলবেন এতোদিন গার্মেন্টস মালিকরা অনেক কামাইছে এইবার অর্ডার বাতিল করলে তাদের সমস্যা নাই কিংবা এইটা মালিকদের ব্যাপার। এইসব গুনীজনদের বলছি আপনার কি ধারনা আছে যে এতো অর্ডার বাতিল করলে সেটার লোকসান গার্মেন্টস মালিকরা কিভাবে সামাল দিবে? অনেকে আমাকে বলতে পারেন আমি মালিকদের হয়ে দালালি করছি। কেউ যদি এটা ভেবে থাকেন তাহলে বলবো, অন্য আরো আটদশজন এম্পলয়ির মতো আমিও এই সেক্টরের একজন খেটে খাওয়া এম্পলয়ি। এতোগুলো কথা বলছি এই কারনে যে, গার্মেন্টস মালিকদের অবশ্যই দোষ আছে কিন্তু যতটুকু বাস্তবতা আমি নিজে বুঝতে পারছি ঠিক ততটুকু আপনাদেরও জানানো যাতে কোন ভুল ধারনা নিয়ে না থাকেন। 


যাহোক গার্মেন্টস মালিকদের লোকসান নিয়ে যেটা বলছিলাম।যদিও আমি সরাসরি কোন মালিকপক্ষের সাথে কথা বলি নাই। কিন্তু একটু ধারনা নেওয়ার চেষ্টা করি যে ফ্যাক্টরিগুলো কি পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমি প্রথমে যেই কোম্পানিতে জব শুরু করি তাদের ইয়ারলি টার্নওভার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তাহলে গড়ে প্রতিমাসে টার্নওভার ৪১.৬৬ মিলিয়ন ডলার। যদি এই ফ্যাক্টরির সব বায়ার দুই মাসের অর্ডার বাতিল করে যার অর্ডারের সবকিছু অলরেডি ফ্যাক্টরিটি এলসির মাধ্যমে নিয়ে আসে তাহলে সেই দুই মাসের শিপমেন্টযোগ্য অর্ডারের ভ্যালু আসে ৮৩ মিলিয়ন ডলারের মতো। এখন যদি ধরেও নেই যে, মালিক প্রতি অর্ডারের বিপরীতে ১৫% লাভ করেন তবে তার লাভের অংক বাদ দিলেও এই বাতিল অর্ডারের জন্য তার লায়াবেলিটি ৭০.৮৩ মিলিয়ন ডলার বা বাংলা টাকায় ৫৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা (!!!!)। আপনার কাছে কি এই টাকাটা নিতান্তই সামান্য মনে হয়? এই কোম্পানির ম্যানপাওয়ার ৫০ হাজারেরও বেশি এবং আমি যদ্দুর জানি মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে তারা নতুন ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য কয়েকটি প্লটও কিনেছে। এখন যদি বায়াররা আদতেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই এই কোম্পানির পুরো দুই মাসের অর্ডার বাতিল করে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা তাদের জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা হবে এবং একইসাথে তাদের নতুন প্রজেক্টসহ বর্তমান এমপ্লয়িদের উপরও এটার বিরূপ প্রভাব পড়বে। এরকম করে ছোট বড় সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো বিপদে পড়বে যদি বায়াররা কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই অর্ডার বাতিল করে। 


যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পের এমপ্লয়ীদের বেতন বাবদ ৫০০০ কোটি টাকার একটি প্রনোদনা দিয়েছে সেহেতু এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা আশার আলো তবে এই দুঃসময়ে মন থেকে অন্তত এতোটুকু দোয়া করবেন যাতে এই বেতন নেওয়া যাতে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে শেষ বেতন নেওয়া না হয় এবং আমাদের গার্মেন্টস মালিকগুলো যাতে এই দু:সময় থেকে ঘুরে দাড়াতে পারে। এটা গার্মেন্টস মালিকদের জন্য দোয়া না বরংচ আমাদের নিজেদের জন্য নিজেদের দোয়া।

লিখেছেনঃ আসিফ আজগর 

কোন মন্তব্য নেই: