ব্লক প্রিন্ট
কাঠের উপর খোদাই বিভিন্ন ধরনের নকশার ব্লক দিয়ে রং লগিয়ে হাতের সাহায্যে কাপড়ে পছন্দ অনুযায়ী প্রিন্ট করাকে ব্লক প্রিন্ট বলে। ব্লককের সঠিক ইতিহাস বলা মুশকিল। তবে ধারনা করা হয়ে থাকে যে প্রাচ্যদেশ থেকে এই ব্লককের প্রচলন শুরু হয়। যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সারা বিশেষ ছড়িয়ে পড়ে। হাত বা মেশিনের মাধ্যমে এই ব্লক দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে এই শিল্পের উপর নির্ভর করে বংলাদেশে বিশাল বানিজ্য গড়ে উঠেছে।
ব্লক করার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস:
ব্লক করতে যে সকল জিনিসের প্রয়োজন হয় তার তালিকা নিচে দেয়া হলো।
উপকরণের নাম সমূহ:
টেবিল চামচ ও চা চামচ কাঠের স্কেল (৩৬-৪০ ইঞ্চি)
ছালা বা কম্বল বিছানো টেবিল চারকোনা ফ্রেমের তলায় রেক্সিন লাগানো ট্রে
পাতলা ফোম ব্রাউন পেপার
পেন্সিল কাঠের ব্লক
ইঞ্চি টেপ চট
রং মেশানোর জন্য কয়েকটি বাটি ব্রাশ
১টি বড় সাইজের টেবিল এপ্রোন
কি কাপড়ে ব্লক করা যায়:
সাধারণত সব ধরনের কাপড়েই ব্লক করা যায়। সুতি, পপলিন, জর্জেট ইত্যাদি কাপড় কিন্তু পশমী কাপড়ের বøক করা যায় না।
ব্লক করার আগে কাপড়ে করণীয়:
১. কাপড়টি যদি সুতি হয় তাহলে মাড়মুক্ত করে নিতে হবে। এর ফলে বøক স্থায়ী হবে।
২. কাপড়টি শুকানো পর আয়রন করতে হবে।
অন্য কাপড়ের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
ব্লক শেষে কাপড়ে করণীয়:
সব কাপড় ব্লক শেষে ২/৩ দিন কড়া রোদে দিতে হবে। রোদে দিতে না পারলে উল্টো পাশে ভালোভাবে আয়রন করে নিতে হবে।
ব্লকের টেবিল তৈরির নিয়ম:
আপনি যখন কাজ করবেন তখন কাপড়ের অনুপাতে টেবিল বা জায়গা নির্বাচন করে নিতে হবে। যে স্থানটি নির্বাচন করবেন সেটি যেন আলো বাতাসপূর্ণ হয়। কাঠের উপর একটি কম্বল বিছিয়ে তার উপর ছালা বিছিয়ে টেবিল তৈরি করতে হবে।
কালার ট্রে:
ব্লক করার সময় কালার ট্রে লাগে। এটি চারকোনা ফ্রেমের তলায় রেক্সিন লাগানো একটি ট্রে। পাতলা ফোম ভিজিয়ে পানি চেপে বের করে কালার এই ট্রের মধ্যে বিছিয়ে নিয়ে ২ ইঞ্চি ব্রাশের সাহায্যে ফোমের উপর রং লাগিয়ে দিতে হবে।
রং তৈরির নিয়ম:
হোয়াইট পেস্ট তৈরির নিয়ম নিউটেক্স তৈরির নিয়ম
টি. টি. পাউডার ৩ টেবিল চামচ নিউটেক্স ৩ টেবিল চামচ
অকজেল হাফ টেবিল চামচ অকজেল হাফ টেবিল চামচ
এপিটন ২ টেবিল চামচ এপিটন ২ টেবিল চামচ
বাইন্ডার ৫ টেবিল চামচ বাইন্ডার ৫ টেবিল চামচ
এন. কে ১ চা চামচ এন. কে ১ চা চামচ
রং মেশানোর সময় ভালোভাবে মেশাতে হবে। মেশানোর পর যদি আঠালো হয় তাহলে রং মেশানো ঠিক আছে। আর যদি পাতলা হয় তাহলে এর মধ্যে আরো একটু এপিটন দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে।
এফ-৫৩ + এপিটন + এন কে + আফসান (সোনালী/সিলভার) এক সাথে মিশিয়ে কাপড়ে আফসানের কাজ করতে হয়।
রং পরিবর্তন করার নিয়ম:
১. রং যদি বেশি ঘন হয় তবে বাইন্ডার দিয়ে পাতলা করতে হবে।
২. পাতলা হলে এপিটন বা নিউটেক্স দিয়ে ঘন করতে হবে।
৩. যদি বেশি গাড় হয় তবে অনেক সময় পানি ব্যবহার করা যাবে।
৪. কালো রং করার সময় বাইন্ডার কম দিতে হবে।
ব্লককের রং এই দুই পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। এই রং এবং এই পদ্ধতিতে কামিজ, সালোয়ার এবং ওড়নাতে ব্লক করে দেখানো হবে।
বিভিন্ন ধরনের ছাপার পদ্ধতি:
ব্লক প্রিন্ট ছাড়াও অন্যান্য বহুবিধ পদ্ধতিতে কাপড়ে ছাপা করা হয়ে থাকে।
১. মেশিনে ব্লক পিন্ট
২. মেশিনে স্কিন পিন্ট
৩. হাতে ব্লক পিন্ট
৪. বাটিক প্রিন্ট
৫. কপার রোলার প্রিন্ট ইত্যাদি।
বাটিকের নিয়ম ও পদ্ধতি
কাপড়কে বেঁধে বিভিন্ন রংয়ে ভিজিয়ে যে নকশা করা হয় তাকে বাটিক বলে। বাটিক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থকে।
১. সালফার বাটিক
২. ভ্যাট বাটিক
৩. প্রুশিয়ান বাটিক
৪. মোম বটিক ইত্যাদি।
সালফার বাটিক:
ক্রমিক নং উপকরণ পরিমান
১ সালফার রং ১ তোলা
২ সোডিয়াম ১ তোলা
৩ লবণ ১ টেবিল চামচ
৪ পানি ১.৫ লিটার
৫ কাপড় ১ গজ
প্রণালী:
পছন্দমতো কাপড় ভাঁজ করে ভালোভাবে বেঁধে নিতে হবে। কাপড়টি ঠান্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। এবার চুলায় পানি ফুটাতে হবে। পানি ফুটে গেলে প্রথমে লবণ, সোডিয়াম ও রং দিয়ে মিশিয়ে কাপড়টি দিয়ে দিতে হবে। এবার ৩০ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। ৩০ মিনিট পর কাপড়টি তুলে ঠান্ডা পানিতে ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। এই ধরনের বাটিকের রং সহজে উঠে যায় না। এটি ৬টি রং এর হয়ে থাকে, যেমন: হলুদ, সবুজ, কালো, ব্রাউন, নীল ও জলপাই রংয়ের। এ ধরনের বাটিক শুধুমাত্র সুতি কাপড়ে করা হয়ে থাকে।
ভ্যাট বাটিক:
ক্রমিক নং উপকরণ পরিমান
১ ভ্যাট রং ১ তোলা
২ কস্টিক সোডা ৩ তোলা
৩ হাইড্রোজ ৩ তোলা
৪ পানি ১ লিটার
৫ কাপড় ১ গজ
প্রণালী:
পছন্দমতো কাপড় ভাঁজ করে ভালোভাবে বেঁধে নিতে হবে। কাপড়টি ঠান্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। এবার চুলায় পানি ফুটাতে হবে। পানি ফুটে গেলে প্রথমে কস্টিক সোডা, হাইড্রোজ ও রং দিয়ে মিশিয়ে কাপড়টি দিয়ে দিতে হবে। এবার চুলা থেকে হাড়ি নামিয়ে ঐ গরম পানিতে ৩০ মিনিট রাখতে হবে। ৩০ মিনিট পর কাপড়টি তুলে সাথে সাথে পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। ১০ মিনিট অপেক্ষা করার পর ঠান্ডা পানিতে ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। এই ধরনের বাটিকের রং সহজে উঠে যায় না। এই ধরনের বাটিক সালফারের তুলনায় বেশি টেকসই হয়ে থাকে। পানি ফোটার পর ক্যেমিকেল দিতে হবে। তবে কস্টিক সোডা দেয়ার সময় চুলার জ্বাল কমিয়ে দিতে হবে। এটা পানিতে দেয়ার সাথে সাথে পানি ফুলে দ্বিগুন হয়ে যায়।
প্রুশিয়ান বাটিক:
ক্রমিক নং উপকরণ পরিমান
১ প্রæশিয়ান রং ১ তোলা
২ কাপড় ধোয়ার সোডা ২ টে. চা.
৩ লবণ ১.৫ টে. চা.
৪ পানি ৩ লিটার
৫ কাপড় ১ গজ
প্রণালী:
প্রথমে সুতা দিয়ে কাপড়টিকে পছন্দমতো নকশা দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে নিতে হবে। পরিমানমতো গরম পানি দিয়ে রং গুলে নিতে হবে। এবার একটি প্লাস্টিকের গামলায় ৩ লিটার পানি নিতে হবে। এবার এতে গোলানো রং দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার এর মধ্যে কাপড় দিয়ে একটি কাঠি দিয়ে নেড়ে চুবিয়ে দিতে হবে। এবার ১৫ মিনিট কাপড়টি ভিজিয়ে রাখবো। এরপর কাপড়টি তুলে অন্য একটি পাত্রে লবন গুলে গামলার পানিতে দিতে হবে। এবার কাপড়টি আবার ভিজিয়ে রাখবো ১৫ মিনিট। আবার কাপড়টি তুলে অন্য একটি পাত্রে সোডা গুলে গামলার পানিতে দিতে হবে। এবার কাপড়টি আবার ভিজিয়ে রাখবো ৩০ মিনিট। সুতি ও জর্জেট কাপড়ে এই রং ভালো হয়।
এই পদ্ধতিগুলো অনুসরন করে কামিজ, সেলোয়ার, ওড়না ও শাড়ীতে বাটিক করা যাবে।
মোম বটিক:
ক্রমিক নং উপকরণ পরিমান
১ সাদা মোম ১ পোয়া
২ লাল মোম হাফ পোয়া
৩ রজন ১ তোলা
৪ ব্রাশ ১টি
৫ ডাইস পছন্দমতো
প্রণালী:
প্রথমে একটি কাপড়ে পছন্দমতো নকশা এঁকে নিতে হবে। একটি দস্তার বা সিলভারের পাত্রে মাপ মতো সাদা মোম, লাল মোম ও রজন নিয়ে চুলায় দিয়ে গলিয়ে নিতে হবে। এবার চুলা থেকে না নামিয়ে ব্রাশের সাহায্যে নকশার উপর মোম ব্রাশ করতে হবে। অথবা একটি পলিথিন বিছিয়ে তার উপর কাপড়টি রেখে ডাইসের সাহায্যে গোলানো মোম দিয়ে ব্লককের মতো করে ছাপ দিতে হবে। ছাপ দেয়া হয়ে গেলে মোম চুলা থেকে নামিয়ে রাখতে হবে। এই মোম এভাবে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। মোম লাগানোর একদিন পর রং করতে হয়। মোম কাপড়ে এমনভাবে লাগাতে হবে যেন কাপড়ের উভয় দিকেই লাগে।
রং করার পদ্ধতি:
মোম বাটিকের কাপড় প্রুশিয়ান রংয়ের মাধ্যমে করলে ভালো হয়। ভ্যাট রং দিয়েও করা যায় তবে সেক্ষেত্রে পানি একটু ঠান্ডা করে নিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন