ডেনিম-জিনসের শত বছরের ইতিহাস | Denim Jeans - Textile Lab | Textile Learning Blog
ডেনিম-জিনসের শত বছরের ইতিহাস | Denim Jeans 
সমুদ্র পাড়ি দেওয়া নাবিক-বণিকদের পরনের আঁটসাঁট টুইল ট্রাউজার থেকে আজকের দিনে যেকোনো রুচিসম্মত ওয়ার্ডরোব প্রধান পোশাক ডেনিম হেঁটেছে এক লম্বা পথ।

ডেনিমের মতো আর কোনো কাপড়ই এখন অবধি ফ্যাশনজগতে এতটা বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারেনি। 

'ফ্যাশনের নিয়ম হলো, এটি রহস্যময়। ব্লু জিনস কেন ক্লাসিক? কারণ, আপনি হুট করেই এমন কিছু একটা পেয়ে যান, যেটি আপনার জন্য সঠিক এবং যাকে সময়ের সীমায় বন্দী করা যাবে না।'

এভাবেই জিনস সম্পর্কে নিজের অভিমত জানিয়েছিলেন বেলজিয়ামের বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ডায়ান ফন ফার্স্টেনবার্গ।

অথচ ডেনিম জিনস আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যে আমরা খুব কমসংখ্যক ব্যবহারকারীই এ প্রশ্ন তুলি: কীভাবে তৈরি হয় এ জিনস, আর কী-ই বা এর ইতিহাস?

বাজারে আজকাল হরেক রকমের ডেনিম জিনসের সমাহার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো এটি সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও টেকসই কাপড়। এর আবেদনও চিরন্তন, সব সময় অমলিন।

ডেনিমের মতো আর কোনো কাপড়ই এখন অবধি ফ্যাশনজগতে এতটা বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারেনি। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া নাবিক-বণিকদের পরনের আঁটসাঁট টুইল ট্রাউজার থেকে আজকের দিনে যেকোনো রুচিসম্মত ওয়ার্ডরোব প্রধান পোশাক ডেনিম হেঁটেছে এক লম্বা পথ।

চলুন একে একে জেনে নিই ডেনিমের জন্ম-ইতিহাস ও পথচলার আখ্যান।

ডেনিমের জন্মঃ

ইংরেজি জিনস (jeans) শব্দটির আবির্ভাব ১৫৬৭ সালের  'জেনোয়িজ' (genoese) বা 'জিনস' (genes) থেকে। এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো ইতালিয়ান সমুদ্রতীরবর্তী শহর জেনোয়া থেকে আগত বণিকদের পরনের শক্ত টুইল ট্রাউজারকে বর্ণনা করতে।

কোন কাপড় থেকে তৈরি হতো এই টুইল ট্রাউজার? ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটারের ইনস্টিটিউট অব আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের অনারারি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং 'ইন্ডিগো ইন দ্য আরব ওয়ার্ল্ড' (রওটলেজ, ১৯৯৬)-সহ ইন্ডিগোর ওপর বেশ কিছু বইয়ের রচয়িতা জেনি বেলফোর-পল আমাদের ধারণা দেন এ ব্যাপারে। তার মতে, 'ইসলামিক যুগের শুরুর দিকে বেশ শক্ত ও বলিষ্ঠ একটি মিসরীয় কাপড় ইতালিতে আমদানি করা হয়। কাপড়টির নাম ছিল ফুসতিয়ান (কথাটি এসেছে ফুসতাত থেকে, যেটি ছিল কায়রোর পূর্ববর্তী নগরী)। এই কাপড়ের অনুকরণে জেনোয়ার তাঁতিরা তাদের নিজস্ব একটি সংস্করণ তৈরি করতে থাকে। সেটির নাম তারা দেয় জিন ফুসতিয়ান, যাতে ইন্ডিগো নীল রং ব্যবহার করত তারা। জিন ফুসতিয়ানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটির জিন নামটুকুই লোকমুখে অধিক প্রচলিত হয়ে যায়। সে জন্যই এ কাপড়কে বলা হতো জিনস বা জেনোয়িজ।'

পরবর্তীতে ফ্রান্সের নিমসের তাঁতিরাও এ কাপড়ের পুনরুৎপাদন শুরু করে। তারা সেই কাপড়কে বলত 'টুইল উইভ ফ্যাব্রিক' নামে, যেখানে ব্যবহৃত হতো একটি রঙিন সুতো (প্রধানত ইন্ডিগো ডাই করা) এবং একটি সাদা সুতো। সেই কাপড়টির ছিল এক ভিন্নধর্মী স্বাতন্ত্র্য এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষের পরনের জন্যও কাপড়টি খুব ভালোভাবে মানিয়ে যায়।

আজকে আমরা সেই কাপড়কেই বলি ডেনিম নামে। এই ডেনিম শব্দটি এসেছে "সার্জ দে নিমস' থেকে, অর্থাৎ 'সার্জ ফ্রম নিমস' বা নিমসের কাপড় থেকে।

ডেনিমের ব্র্যান্ডিংঃ

ডেনিম জিনসের ব্র্যান্ডিংয়ের নেপথ্যে রয়েছেন লেভি স্ট্রসের হাত। ১৮৫৩ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে চলে আসেন 'গোল্ড রাশ'-এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের জন্য একটি ড্রাই গুড স্টোর খুলতে। তার দোকানে তখন পাওয়া যেত আমদানি করা সুতি কাপড় ও ডেনিম। ওই সময় জ্যাকব ডব্লিউ ডেভিস নামের আরেক দর্জি তৈরি করতেন তাঁবু, ঘোড়ার কম্বল, ওয়্যাগন কভার ইত্যাদি। একপর্যায়ে তিনি স্ট্রসকে প্রস্তাব দেন তার সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ধাতুযুক্ত কাপড়ের পেটেন্ট করে সেগুলো বিক্রির। এভাবেই নানা ধাতব পিন বা প্লেট যোগ করে স্ট্রসের ডেনিমকে আরও টেকসই ও মজবুত করে তোলা হয়।

এভাবেই স্ট্রস ও ডেভিস পার্টনার হয়ে যান এবং ১৮৭৩ সালের ২০ মে তারা ইউনাইটেড স্টেটস পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস থেকে পেটেন্ট লাভ করেন। কম বয়সীদের কাছে তাদের নতুন চেহারার জিনস অনেক জনপ্রিয়তা পায়। শুরুর দিকে স্ট্রস ও ডেভিস যুগল দুই ধরনের কাপড় বানাতেনÑব্রাউন ডার্ক ও ব্লু ডেনিম। কিন্তু এরপর ১৮৯০ সালে ডেনিম ৫০১ স্টাইলের আবির্ভাবের মাধ্যমে ডেনিমের আধুনিকীকরণের পথ সুগম হয়।

ক্রমে ডেনিম জিনসে অনেক ধরনের পরিবর্তন ও উন্নতিই আসতে থাকে। যেমন ১৯২২ সালে বেল্ট লুপ আসে, এবং বোতামের জায়গা দখল করে জিপার। কিন্তু ১৮৯০ সালের সেই পার্টনারশিপের সমাপ্তি ঘটে, যখন অশকশ বিগশ, র‌্যাংলার ও লি মার্সেন্টাইলরা লাইমলাইটে আসে।

ডেনিমের বিবর্তনঃ

১৫০ বছরে জিনসের মধ্যে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকেও জিনস ছিল প্রধানত 'ওয়েইস্ট ওভারাল' এবং যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো ওয়েস্টার্ন কাউবয়, খনিশ্রমিক ও কৃষকরাই কেবল পরতেন। দামে সস্তা ও শক্তপোক্ত হওয়ায় এটি শ্রমজীবী পুরুষদের দৈনন্দিন পোশাকে পরিণত হয়।

বিংশ শতকের শুরুর দিকে, বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের মাঝে ডেনিম পরার প্রবণতা বেড়ে যায়। যোদ্ধারা লি ইউনিয়ন জিনস বেশি পরতেন। এভাবে সামরিক শক্তির সঙ্গেও ডেনিমের যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

মধ্য-পঞ্চাশের দশকে এসে জিনস শব্দটির ব্যবহার বেড়ে যায়, এটিকে অন্যান্য কাপড়ের থেকে আলাদা করার জন্য। মারলন ব্র্যান্ডোর 'দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান' ও জেমস ডিনের 'রেবেল উইদাউট আ কজ' ইত্যাদি ছবি দেখে তরুণেরা বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে ডেনিম পরা শুরু করে।

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদে বারবার আসার সুবাদে বেলবটম তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্ক ইস্ট ভিলেজের একটি বুটিক এক অভূতপূর্ব ধারণার জন্ম দেয়। তারা চেয়েছিল এক জোড়া জিনসকে এমনভাবে ধুতে যেন সেটিকে ব্যবহৃত ও ছেড়া মনে হয়। পাশাপাশি তারা সেটিতে কাপড়ে তালিও লাগায়।

১৯৬০-এর দশকজুড়ে এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে হিপি ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকারীরাও জিনস পরতে শুরু করেন। এর মাধ্যমে তারা শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে সংহতি দেখাতেন। এদিকে নারীবাদী ও উইমেনস লিবের সংগঠকেরাও জেন্ডার ইকুইটি বা ন্যায়বিচারের প্রতীকী হিসেবে ব্লু জিনসকে বেছে নেন।

১৯৭৬ সালে ক্যালভিন ক্লেইন প্রথম রানওয়েতে জিনস দেখান। এরপর তাকে অনুসরণ করেন ডিজাইনার গ্লোরিয়া ভ্যান্ডারবিল্টও। এভাবে ১৯৮০-এর দশকে অ্যাসিড-ওয়াশ জিনসের পরিচিতি গড়ে ওঠে।

ঢিলেঢালা, ছেড়া জিনস বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয় ১৯৯০-এর দশকে। সেই সময়ে ভার্সেস, ডলসে অ্যান্ড গ্যাবানা এবং ডায়রের মতো ফ্যাশনহাউসও জিনসের বাজারে প্রবেশ করে। তাদের পথ ধরেই নতুন শতাব্দীতে স্কিনি বা গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা জিনসের নিজস্ব ফ্যানবেজ গড়ে ওঠে।

শেষ কয়েক দশক ধরে ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি-পেশার মাঝেও জিনসের অভিন্ন ব্যবহারের চল শুরু হয়েছে। তাই আলাদা করে আর কোন শ্রেণি-পেশার জন্য কোন ধরনের ডেনিম জিনস, তা আর বলা যায় না। বরং পরিহিত জিনস এখন কেবলই যেকোনো শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব রুচি ও শৈলীর পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।

ডেনিম ও হলিউডঃ

১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ব্লু জিনসকে রোমান্টিসাইজ করতে সাহায্য করেছে হলিউড। সে সময় জন ওয়েইন ও গ্যারি কুপারের মতো সুদর্শন অভিনেতারা কাউবয় চরিত্রে অভিনয় করতেন ডেনিম ট্রাউজার পরে।

এই গ্ল্যামারাস নতুন রূপ নজর কাড়ে সেসব ক্রেতাদের, যারা উইকেন্ডসহ অন্যান্য ছুটির দিনে সাদাসিধে, আরামদায়ক অথচ আকর্ষণীয় কোনো পোশাকের সন্ধান করছিল।

এদিকে নারীরাও জিনসের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে জিনজার রজার্স ও ক্যারোল লোম্বার্ডের মতো তারকাদের জিনস পরতে দেখে। ১৯৩০-এর দশকে বিখ্যাত ম্যাগাজিন 'ভোগ'ও জিনসের ব্যাপারে তাদের অনুমোদন দেয় একে 'ওয়েস্টার্ন চিক' নামে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে। তাই তো ১৯৪২ সালে আমেরিকান ডিজাইনার ক্লেয়ার ম্যাককারডেল তার ডেনিম পপওভার র‌্যাপ ড্রেস বিক্রি করেন ৭৫ হাজারেরও বেশি পিস।

তবে যেমনটি আগেই বলেছি, ১৯৫০-এর দশকে এসেই কেবল জিনসের সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম বিপ্লবী, প্রথাবিরোধী ভাবমূর্তির সন্ধান পায় মারলন ব্র্যান্ডো ও জেমস ডিনদের কল্যাণে। এই তারকাদের কারণে জিনসের বিপুল যৌনাবেদনও তৈরি হয়। রক 'এন' রোল তারকাদের কারণে জিনস পরা 'কুল' ব্যাপারও হয়ে ওঠে।

ডেনিমের বর্তমানঃ

ডেনিম এখন বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় 'ক্যাজুয়াল ওয়্যারড্রোব'। ২০২০ সালে ডেনিম কাপড়ের বাজারমূল্য ছিল ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। আশা করা হচ্ছে, ২০২৬ সাল নাগাদ তা ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

ডেনিম বা ব্লু জিনসের খুচরা বিক্রি ডেনিম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে মূল্যবান চ্যানেল। ২০২৭ সাল নাগাদ খুচরা বিক্রির মূল্যমান ৭১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। তা ছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, ওই বছর বৈশ্বিক ডেনিম জিনসের বাজারের মূল্য দাঁড়াবে ৮৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

চীন এখন বিশ্বে ডেনিম কাপড়ের শীর্ষ রপ্তানিকারক। তারা অন্তত ৮৫ শতাংশ তুলা দিয়ে তৈরি ডেনিম রপ্তানি করে। তাদের ডেনিমে তুলার শতাংশ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এই সুতাগুলোর ব্যাপ্তি বাড়বে, কিন্তু কখনো সংকুচিত হবে না।

এদিকে চীন ও হংকং সবচেয়ে বেশি ডেনিম কাপড় আমদানিও করে, বিশেষত যেসব ডেনিম তৈরি হয় ৮৫ শতাংশের কম তুলা দিয়ে। অন্যদিকে মিসর অন্তত ৮৫ শতাংশের কম তুলা দিয়ে তৈরিকৃত ডেনিমের শীর্ষ রপ্তানিকারক।

এই মুহূর্তে লেভি স্ট্রসের হাতে রয়েছে বৈশ্বিক জিনসের বাজারের সবচেয়ে বড় শেয়ার। ২০২০ সালে তাদের বিক্রি ছিল ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে লেভি স্ট্রসের বিক্রির ৮৭ শতাংশই ছিল লেভিস ব্র্যান্ডের আওতায়। অন্যদিকে ২০২০ সালে ভিএফ করপোরেশনের জিনসের পোশাকের বিক্রি ছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। নর্থ ফেস, টিম্বারল্যান্ড ও ভ্যানসের মতো ব্র্যান্ডগুলো রয়েছে তাদের মালিকানায়।

কপিরাইটঃ 
দ্যা বিজনেস স্টেন্ডার্ড 
ইজেল
জান্নাতুল নাঈম পিয়াল

ডেনিম-জিনসের শত বছরের ইতিহাস | Denim Jeans

ডেনিম-জিনসের শত বছরের ইতিহাস | Denim Jeans 
সমুদ্র পাড়ি দেওয়া নাবিক-বণিকদের পরনের আঁটসাঁট টুইল ট্রাউজার থেকে আজকের দিনে যেকোনো রুচিসম্মত ওয়ার্ডরোব প্রধান পোশাক ডেনিম হেঁটেছে এক লম্বা পথ।

ডেনিমের মতো আর কোনো কাপড়ই এখন অবধি ফ্যাশনজগতে এতটা বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারেনি। 

'ফ্যাশনের নিয়ম হলো, এটি রহস্যময়। ব্লু জিনস কেন ক্লাসিক? কারণ, আপনি হুট করেই এমন কিছু একটা পেয়ে যান, যেটি আপনার জন্য সঠিক এবং যাকে সময়ের সীমায় বন্দী করা যাবে না।'

এভাবেই জিনস সম্পর্কে নিজের অভিমত জানিয়েছিলেন বেলজিয়ামের বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ডায়ান ফন ফার্স্টেনবার্গ।

অথচ ডেনিম জিনস আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যে আমরা খুব কমসংখ্যক ব্যবহারকারীই এ প্রশ্ন তুলি: কীভাবে তৈরি হয় এ জিনস, আর কী-ই বা এর ইতিহাস?

বাজারে আজকাল হরেক রকমের ডেনিম জিনসের সমাহার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো এটি সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও টেকসই কাপড়। এর আবেদনও চিরন্তন, সব সময় অমলিন।

ডেনিমের মতো আর কোনো কাপড়ই এখন অবধি ফ্যাশনজগতে এতটা বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারেনি। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া নাবিক-বণিকদের পরনের আঁটসাঁট টুইল ট্রাউজার থেকে আজকের দিনে যেকোনো রুচিসম্মত ওয়ার্ডরোব প্রধান পোশাক ডেনিম হেঁটেছে এক লম্বা পথ।

চলুন একে একে জেনে নিই ডেনিমের জন্ম-ইতিহাস ও পথচলার আখ্যান।

ডেনিমের জন্মঃ

ইংরেজি জিনস (jeans) শব্দটির আবির্ভাব ১৫৬৭ সালের  'জেনোয়িজ' (genoese) বা 'জিনস' (genes) থেকে। এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো ইতালিয়ান সমুদ্রতীরবর্তী শহর জেনোয়া থেকে আগত বণিকদের পরনের শক্ত টুইল ট্রাউজারকে বর্ণনা করতে।

কোন কাপড় থেকে তৈরি হতো এই টুইল ট্রাউজার? ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটারের ইনস্টিটিউট অব আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের অনারারি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং 'ইন্ডিগো ইন দ্য আরব ওয়ার্ল্ড' (রওটলেজ, ১৯৯৬)-সহ ইন্ডিগোর ওপর বেশ কিছু বইয়ের রচয়িতা জেনি বেলফোর-পল আমাদের ধারণা দেন এ ব্যাপারে। তার মতে, 'ইসলামিক যুগের শুরুর দিকে বেশ শক্ত ও বলিষ্ঠ একটি মিসরীয় কাপড় ইতালিতে আমদানি করা হয়। কাপড়টির নাম ছিল ফুসতিয়ান (কথাটি এসেছে ফুসতাত থেকে, যেটি ছিল কায়রোর পূর্ববর্তী নগরী)। এই কাপড়ের অনুকরণে জেনোয়ার তাঁতিরা তাদের নিজস্ব একটি সংস্করণ তৈরি করতে থাকে। সেটির নাম তারা দেয় জিন ফুসতিয়ান, যাতে ইন্ডিগো নীল রং ব্যবহার করত তারা। জিন ফুসতিয়ানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটির জিন নামটুকুই লোকমুখে অধিক প্রচলিত হয়ে যায়। সে জন্যই এ কাপড়কে বলা হতো জিনস বা জেনোয়িজ।'

পরবর্তীতে ফ্রান্সের নিমসের তাঁতিরাও এ কাপড়ের পুনরুৎপাদন শুরু করে। তারা সেই কাপড়কে বলত 'টুইল উইভ ফ্যাব্রিক' নামে, যেখানে ব্যবহৃত হতো একটি রঙিন সুতো (প্রধানত ইন্ডিগো ডাই করা) এবং একটি সাদা সুতো। সেই কাপড়টির ছিল এক ভিন্নধর্মী স্বাতন্ত্র্য এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষের পরনের জন্যও কাপড়টি খুব ভালোভাবে মানিয়ে যায়।

আজকে আমরা সেই কাপড়কেই বলি ডেনিম নামে। এই ডেনিম শব্দটি এসেছে "সার্জ দে নিমস' থেকে, অর্থাৎ 'সার্জ ফ্রম নিমস' বা নিমসের কাপড় থেকে।

ডেনিমের ব্র্যান্ডিংঃ

ডেনিম জিনসের ব্র্যান্ডিংয়ের নেপথ্যে রয়েছেন লেভি স্ট্রসের হাত। ১৮৫৩ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে চলে আসেন 'গোল্ড রাশ'-এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের জন্য একটি ড্রাই গুড স্টোর খুলতে। তার দোকানে তখন পাওয়া যেত আমদানি করা সুতি কাপড় ও ডেনিম। ওই সময় জ্যাকব ডব্লিউ ডেভিস নামের আরেক দর্জি তৈরি করতেন তাঁবু, ঘোড়ার কম্বল, ওয়্যাগন কভার ইত্যাদি। একপর্যায়ে তিনি স্ট্রসকে প্রস্তাব দেন তার সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ধাতুযুক্ত কাপড়ের পেটেন্ট করে সেগুলো বিক্রির। এভাবেই নানা ধাতব পিন বা প্লেট যোগ করে স্ট্রসের ডেনিমকে আরও টেকসই ও মজবুত করে তোলা হয়।

এভাবেই স্ট্রস ও ডেভিস পার্টনার হয়ে যান এবং ১৮৭৩ সালের ২০ মে তারা ইউনাইটেড স্টেটস পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস থেকে পেটেন্ট লাভ করেন। কম বয়সীদের কাছে তাদের নতুন চেহারার জিনস অনেক জনপ্রিয়তা পায়। শুরুর দিকে স্ট্রস ও ডেভিস যুগল দুই ধরনের কাপড় বানাতেনÑব্রাউন ডার্ক ও ব্লু ডেনিম। কিন্তু এরপর ১৮৯০ সালে ডেনিম ৫০১ স্টাইলের আবির্ভাবের মাধ্যমে ডেনিমের আধুনিকীকরণের পথ সুগম হয়।

ক্রমে ডেনিম জিনসে অনেক ধরনের পরিবর্তন ও উন্নতিই আসতে থাকে। যেমন ১৯২২ সালে বেল্ট লুপ আসে, এবং বোতামের জায়গা দখল করে জিপার। কিন্তু ১৮৯০ সালের সেই পার্টনারশিপের সমাপ্তি ঘটে, যখন অশকশ বিগশ, র‌্যাংলার ও লি মার্সেন্টাইলরা লাইমলাইটে আসে।

ডেনিমের বিবর্তনঃ

১৫০ বছরে জিনসের মধ্যে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকেও জিনস ছিল প্রধানত 'ওয়েইস্ট ওভারাল' এবং যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো ওয়েস্টার্ন কাউবয়, খনিশ্রমিক ও কৃষকরাই কেবল পরতেন। দামে সস্তা ও শক্তপোক্ত হওয়ায় এটি শ্রমজীবী পুরুষদের দৈনন্দিন পোশাকে পরিণত হয়।

বিংশ শতকের শুরুর দিকে, বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের মাঝে ডেনিম পরার প্রবণতা বেড়ে যায়। যোদ্ধারা লি ইউনিয়ন জিনস বেশি পরতেন। এভাবে সামরিক শক্তির সঙ্গেও ডেনিমের যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

মধ্য-পঞ্চাশের দশকে এসে জিনস শব্দটির ব্যবহার বেড়ে যায়, এটিকে অন্যান্য কাপড়ের থেকে আলাদা করার জন্য। মারলন ব্র্যান্ডোর 'দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান' ও জেমস ডিনের 'রেবেল উইদাউট আ কজ' ইত্যাদি ছবি দেখে তরুণেরা বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে ডেনিম পরা শুরু করে।

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদে বারবার আসার সুবাদে বেলবটম তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্ক ইস্ট ভিলেজের একটি বুটিক এক অভূতপূর্ব ধারণার জন্ম দেয়। তারা চেয়েছিল এক জোড়া জিনসকে এমনভাবে ধুতে যেন সেটিকে ব্যবহৃত ও ছেড়া মনে হয়। পাশাপাশি তারা সেটিতে কাপড়ে তালিও লাগায়।

১৯৬০-এর দশকজুড়ে এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে হিপি ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকারীরাও জিনস পরতে শুরু করেন। এর মাধ্যমে তারা শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে সংহতি দেখাতেন। এদিকে নারীবাদী ও উইমেনস লিবের সংগঠকেরাও জেন্ডার ইকুইটি বা ন্যায়বিচারের প্রতীকী হিসেবে ব্লু জিনসকে বেছে নেন।

১৯৭৬ সালে ক্যালভিন ক্লেইন প্রথম রানওয়েতে জিনস দেখান। এরপর তাকে অনুসরণ করেন ডিজাইনার গ্লোরিয়া ভ্যান্ডারবিল্টও। এভাবে ১৯৮০-এর দশকে অ্যাসিড-ওয়াশ জিনসের পরিচিতি গড়ে ওঠে।

ঢিলেঢালা, ছেড়া জিনস বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয় ১৯৯০-এর দশকে। সেই সময়ে ভার্সেস, ডলসে অ্যান্ড গ্যাবানা এবং ডায়রের মতো ফ্যাশনহাউসও জিনসের বাজারে প্রবেশ করে। তাদের পথ ধরেই নতুন শতাব্দীতে স্কিনি বা গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা জিনসের নিজস্ব ফ্যানবেজ গড়ে ওঠে।

শেষ কয়েক দশক ধরে ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি-পেশার মাঝেও জিনসের অভিন্ন ব্যবহারের চল শুরু হয়েছে। তাই আলাদা করে আর কোন শ্রেণি-পেশার জন্য কোন ধরনের ডেনিম জিনস, তা আর বলা যায় না। বরং পরিহিত জিনস এখন কেবলই যেকোনো শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব রুচি ও শৈলীর পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।

ডেনিম ও হলিউডঃ

১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ব্লু জিনসকে রোমান্টিসাইজ করতে সাহায্য করেছে হলিউড। সে সময় জন ওয়েইন ও গ্যারি কুপারের মতো সুদর্শন অভিনেতারা কাউবয় চরিত্রে অভিনয় করতেন ডেনিম ট্রাউজার পরে।

এই গ্ল্যামারাস নতুন রূপ নজর কাড়ে সেসব ক্রেতাদের, যারা উইকেন্ডসহ অন্যান্য ছুটির দিনে সাদাসিধে, আরামদায়ক অথচ আকর্ষণীয় কোনো পোশাকের সন্ধান করছিল।

এদিকে নারীরাও জিনসের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে জিনজার রজার্স ও ক্যারোল লোম্বার্ডের মতো তারকাদের জিনস পরতে দেখে। ১৯৩০-এর দশকে বিখ্যাত ম্যাগাজিন 'ভোগ'ও জিনসের ব্যাপারে তাদের অনুমোদন দেয় একে 'ওয়েস্টার্ন চিক' নামে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে। তাই তো ১৯৪২ সালে আমেরিকান ডিজাইনার ক্লেয়ার ম্যাককারডেল তার ডেনিম পপওভার র‌্যাপ ড্রেস বিক্রি করেন ৭৫ হাজারেরও বেশি পিস।

তবে যেমনটি আগেই বলেছি, ১৯৫০-এর দশকে এসেই কেবল জিনসের সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম বিপ্লবী, প্রথাবিরোধী ভাবমূর্তির সন্ধান পায় মারলন ব্র্যান্ডো ও জেমস ডিনদের কল্যাণে। এই তারকাদের কারণে জিনসের বিপুল যৌনাবেদনও তৈরি হয়। রক 'এন' রোল তারকাদের কারণে জিনস পরা 'কুল' ব্যাপারও হয়ে ওঠে।

ডেনিমের বর্তমানঃ

ডেনিম এখন বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় 'ক্যাজুয়াল ওয়্যারড্রোব'। ২০২০ সালে ডেনিম কাপড়ের বাজারমূল্য ছিল ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। আশা করা হচ্ছে, ২০২৬ সাল নাগাদ তা ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

ডেনিম বা ব্লু জিনসের খুচরা বিক্রি ডেনিম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে মূল্যবান চ্যানেল। ২০২৭ সাল নাগাদ খুচরা বিক্রির মূল্যমান ৭১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। তা ছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, ওই বছর বৈশ্বিক ডেনিম জিনসের বাজারের মূল্য দাঁড়াবে ৮৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

চীন এখন বিশ্বে ডেনিম কাপড়ের শীর্ষ রপ্তানিকারক। তারা অন্তত ৮৫ শতাংশ তুলা দিয়ে তৈরি ডেনিম রপ্তানি করে। তাদের ডেনিমে তুলার শতাংশ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এই সুতাগুলোর ব্যাপ্তি বাড়বে, কিন্তু কখনো সংকুচিত হবে না।

এদিকে চীন ও হংকং সবচেয়ে বেশি ডেনিম কাপড় আমদানিও করে, বিশেষত যেসব ডেনিম তৈরি হয় ৮৫ শতাংশের কম তুলা দিয়ে। অন্যদিকে মিসর অন্তত ৮৫ শতাংশের কম তুলা দিয়ে তৈরিকৃত ডেনিমের শীর্ষ রপ্তানিকারক।

এই মুহূর্তে লেভি স্ট্রসের হাতে রয়েছে বৈশ্বিক জিনসের বাজারের সবচেয়ে বড় শেয়ার। ২০২০ সালে তাদের বিক্রি ছিল ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে লেভি স্ট্রসের বিক্রির ৮৭ শতাংশই ছিল লেভিস ব্র্যান্ডের আওতায়। অন্যদিকে ২০২০ সালে ভিএফ করপোরেশনের জিনসের পোশাকের বিক্রি ছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। নর্থ ফেস, টিম্বারল্যান্ড ও ভ্যানসের মতো ব্র্যান্ডগুলো রয়েছে তাদের মালিকানায়।

কপিরাইটঃ 
দ্যা বিজনেস স্টেন্ডার্ড 
ইজেল
জান্নাতুল নাঈম পিয়াল

২টি মন্তব্য:

Textile BD বলেছেন...

Awesome..Visit textilebd.org!

নামহীন বলেছেন...

ডেনিম এবং জিনস এর মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে?