তাঁত শিল্প: বিবর্তন ইতিহাস | History of Handloom Industry - Textile Lab | Textile Learning Blog
তাঁত শিল্প: বিবর্তনের ধারায়
প্রচলিত অর্থে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম শিল্প হলো তাঁত। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে তাঁত শিল্পের প্রচলন শুরু হয়। তাঁত শিল্পে মণিপুরিরা অনেক আদিকাল থেকে তাঁতবস্ত্র তৈরি করে আসছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো টাঙ্গাইল জেলা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে প্রসিদ্ধ। সম্প্রতি দু-তিন বছর ধরে পাওয়ারলুমে শান্তিপুরের তাঁত শাড়ি উৎপাদন শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে। একই সুতায় রঙ-ডিজাইন করে উৎপাদন হচ্ছে শাড়ি।

১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁত ছিল। গত ২৮ বছরে তা কমে টিকে আছে মাত্র এক হাজার। হোসিয়ারি শিল্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ১৯১৮ সালে পাবনা শহরের আশপাশে তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটে। তাঁত শিল্পের প্রয়োজনে সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজারও পাবনায় গড়ে ওঠে।

১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষ বসু একবার পাবনায় আসেন। এ সময় তিনি পাবনায় সাতটি হোসিয়ারি শিল্প পরিদর্শন করেন। তিনি এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে মুগ্ধ হন। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্যের মান ও চাহিদা দেখে তিনি এ শিল্পকে বস্ত্র শিল্পের ‘মা’ বলে আখ্যায়িত করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পাবনায় হোসিয়ারি শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য গেঞ্জি, পাবনার তাঁত শিল্পের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে পাবনা জেলায় প্রায় ৫০০ হোসিয়ারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বহু শ্রমিক নিয়োজিত। পাবনায় তৈরি গেঞ্জি বর্তমানে নেপাল, ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ঢাকা মারফত রফতানি হয়।


তাঁত শিল্পের উদ্ভব সঠিক কবে থেকে তা বলা মুশকিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হলো আদি তাঁতি। এরা আদিকাল থেকে প্রধানত তাঁত বুনে আসছে। এ পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষ তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল। প্রথমে এরা সিন্ধু উপত্যকার অববাহিকায় বসবাস করত, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা সে স্থান পরিত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করে। আবহাওয়া প্রতিকূলতার কারণে পরে তারা রাজশাহী অঞ্চলে চলে আসে। তাঁত শিল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মণিপুরে অনেক আগে থেকেই তাঁত শিল্পের কাজ হয়ে আসছে। মণিপুরিরা মূলত নিজেদের পোশাকের প্রয়োজনে তাঁতের কাপড় তৈরি করত। তাদের তৈরি তাঁতের সামগ্রী পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কুটির শিল্প হিসেবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল। বংশপরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বয়ন উত্কর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য নিদর্শন।

দেশের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট নরসিংদীর শেখের মাঠ ও গ্রামে গড়ে ওঠেছিল যা, তা বাবুর হাট নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ নেই। সুলতানি ও মোগল যুগের উত্তরাধিকারী হিসেবে এখনকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁতের রঙ, নকশা, বুনন পদ্ধতি অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা।

একসময় তাদের পূর্বপুুুরুষরাই জগদ্বিখ্যাত মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।

সুপ্রাচীকাল থেকে সিরাজগঞ্জের শাড়ি এ দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছে। সিরাজগঞ্জের দক্ষ কারিগরেরা বংশানুক্রমে এ শাড়ি তৈরী করছেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের শাড়ির কথাটি উল্লেখ রয়েছে। তাঁতিরা ঠিক কবে থেকে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরি করছেন সে ইতিহাস সঠিকভাবে অজানা থাকলেও এ অঞ্চলের শাড়ির একটি ঐতিহ্য চলমান রয়েছে। বসাক শ্রেণীর তাঁতপল্লীর তাঁতিরা বংশানুক্রমে হাজার বছর ধরে এ শাড়ি তৈরি করে চলেছেন। এখানকার তাঁতিরা শুধু সুতি সুতাকে উপজিব্য করে নিজের দক্ষতায় তৈরি করেন তাঁতের শাড়ি, যা বেশ আরামদায়ক, মার্জিত ও রুচিশীল। এখানকার শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কাজ। তবে ৯০ দশকে এখানকার শাড়ি তৈরিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। সে সময় তৈরি কটন শাড়ির পাশাপাশি সফটসিল্ক ও হাফসিল্ক শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী নকশায় এখন তাঁতের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটি শাড়ি তৈরি করতে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়, এর সাথে তাঁতের শাড়ির পরতে পরতে সংশ্লিষ্টদের কী পরিমাণ মমতা জড়িয়ে আছে, সে কথা আজও অনেকের কাছে অজানা। তাঁতে তৈরি শাড়ি যেকোনো নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সক্ষম। সময়ের সাথে পরিবর্তিত অবস্থায় আধুনিক নারীর রুচি, পছন্দ ও বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সাথে সংগতি রেখে তৈরি হচ্ছে কারুকার্যখচিত আধুনিক নকশাসমৃদ্ধ তাঁতের শাড়ি। তাঁতে তৈরি হচ্ছে তাঁতের সুতির শাড়ি, দেবদাস, আনারকলি, জামদানি, সুতি জামদানি, জরি পাড়, স্বর্ণচূড়, কুমকুম, সানন্দা, কটকি, সুতিপাড়, নিলাম্বরী, ময়ূরকণ্ঠী, হাজারবুটি, ইককাত, সিল্ক, মণিপুরি, সুতিসিল্ক, হাফসিল্ক, বালুচরি, শান্তিপুরি, সফটসিল্ক, আধা রেশমি, গ্রামীণ চেকসহ নানা বাহারের ও নামের শাড়ি। আগে পদ্মপাড়, মাধবীলতা, মরবী, তেরবী, কুঞ্জলতা ও লতাপাতা পাড়ের শাড়ি তৈরি করা হলেও এখন তাঁতিরা পাড়ে পরিবর্তন এনেছেন। তাঁতে নারী ও পুরুষ উভয়ই কাজ করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেট, সপিংমলে শোভা পাচ্ছে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য নয়ন কাড়া এসব বাহারি তাঁতের শাড়ি ও থ্রি-পিস।

দেশের শাড়ি ও পোশাকের সিংহভাগ পূরণ করছে সিরাজগঞ্জের তাঁতের তৈরি শাড়ি ও পোশাক। বিদেশীরা ক্রয় করছেন সিরাজগঞ্জের তৈরি তাঁতের শাড়ি। শুধু বাঙালি বধূ ও ললনাদের পরিধানের বস্ত্র হিসেবে নয়, বিভিন্ন উৎসবে কিংবা ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশীদের কাছেও আকর্ষণীয় উপহার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে যমুনার পাড়ে তৈরি নজর কাড়া তাঁতের শাড়ি। উপহার হিসেবে দেয়া হয় তাঁতের শাড়ি। মান, বুনন, নকশার তারতম্য ভেদে ৪০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমানের শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। অর্ডার দিলে ১০-২০ হাজার টাকা মূল্যমানের শাড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন তাঁত মালিকরা। তবে জামদানি ও সিল্ক শাড়ির দাম অন্য শাড়ির তুলনায় একটু বেশি। জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, চৌহালী, কাজিপুরে তাঁত কারখানার সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। এ শিল্পে জড়িত আছেন আট-নয় লাখ শ্রমিক, মালিক ও কর্মচারী। প্রতি বছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদন হয়।

আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিদ্যুতের সাহায্যে চালিত পাওয়ারলুম চালু হলে এর মাধ্যমে কাপড় তৈরি শুরু হলেও হস্তচালিত তাঁত ও পাওয়ারলুমের সমন্বয় তাঁত শিল্পকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে। এর মাধ্যমে কাপড়ের পাড়ে মনোমুগ্ধকর সব নকশা করা হচ্ছে। মূলত পাড়ের নকশার ওপর ভিত্তি করে কাপড়ের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এবং কাপড় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তবে কালের বির্বতনে তাঁতের শাড়ির নকশা এখন অনেকটাই আধুনিক হয়ে একদিকে যেমন অভিনবত্ব এসেছে, তেমনি চমত্কারিত্ব ও গুণে-মানে হয়েছে খুবই উন্নত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, সদর, উল্লাপাড়া উপজেলাসহ যমুনা নদীর তীরঘেঁষা প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা তাঁত শিল্প হিসেবে পরিচিত। তাঁত শিল্পকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট, মুকন্দগাতী (সোহাগপুর), এনায়েতপুর ও জেলা সদরের নিউমার্কেট কাপড়ের হাট। এসব হাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাপড়ের ব্যবসায়ীরা কাপড় কেনার জন্য আসছেন, তেমনি এ হাটগুলো তাঁত উপকরণ ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম স্থান। তাঁত সাধারণত দুই প্রকার—দেশী ও চিত্তরঞ্জন। দেশী তাঁতে সাধারণত গামছা, চাদর প্রভৃতি তৈরি হয়। আর চিত্তরঞ্জন তাঁতে ১০০ কাউন্টের সুতার উন্নত মানের ধুতি, মনোমুগ্ধকর শাড়ি, চাদর, লুঙ্গিসহ প্রায় সব ধরনের কাপড়ই প্রস্তুত হয়। চিত্তরঞ্জন তাঁতের বড় সুবিধা হলো দ্রুত কাজ হয়, সময় কম লাগে। সুতা কাটে কম এবং তাঁতির পরিশ্রম কম হয়। 

কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় অনেকটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তাঁত শিল্প। আবহমান বাংলার তাঁতের শাড়ি এ দেশের কুটির শিল্পের অন্যতম একটি উপকরণ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গুণে-মানে উন্নত চাহিদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে তাঁতিদের এ পরিশ্রমকে অনেকে পুঁজি করে নজরদারির অভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এখানে তৈরি করা শাড়িতে নিজেদের কোম্পানির সিল মেরে নিজেদের তৈরি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। ফলে শাড়ি এবং এখানকার তাঁতিদের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে না, যা নীতিনৈতিকতাবিরোধী। ভাল ও উন্নত মানের সুতা দেশে তৈরি না হওয়ায় চোরাপথে আসা এবং ভারতের তৈরি (১০০ কাউন্ট) সুতাই এখন তাঁত শিল্পের প্রধান ভরসা। কিন্তু আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে ভারতীয় সুতা উচ্চমূল্যে কিনতে হয়। এর কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আধুনিক চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে মানসম্মত প্রয়োজনমতো পোশাক তৈরি করা যাচ্ছে না। তাঁত শ্রমিকদের সময়োপযোগী কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় গতানুগতিক সনাতন পদ্ধতিতে পোশাক তৈরির ধারার বাইরে এসে আধুনিক রুচিসম্মত পোশাক তৈরি করতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া মূলধনের সমস্যা তো রয়েছেই। তাঁত শিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একেবারেই কম। পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারির অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে তাঁত শিল্প। সরকারিভাবে মোটা অংকের ঋণপ্রাপ্তির কোনো সুযোগ না থাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। মূলধনের অভাবে অনেক তাঁত এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতকে সিরাজগঞ্জের ব্র্যান্ড হিসেবে নিয়েছে সরকার। তাই তাঁত শিল্প রক্ষায় এ শিল্পের জন্য সুতাসহ সব উপকরণের সহজলভ্যতা ও পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে তাঁত শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং তাঁত শিল্পের অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অশোক ব্যানার্জী
অশোক ব্যানার্জী: সাংবাদিক
বনিকবার্তা

তাঁত শিল্প: বিবর্তন ইতিহাস | History of Handloom Industry

তাঁত শিল্প: বিবর্তনের ধারায়
প্রচলিত অর্থে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম শিল্প হলো তাঁত। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে তাঁত শিল্পের প্রচলন শুরু হয়। তাঁত শিল্পে মণিপুরিরা অনেক আদিকাল থেকে তাঁতবস্ত্র তৈরি করে আসছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো টাঙ্গাইল জেলা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে প্রসিদ্ধ। সম্প্রতি দু-তিন বছর ধরে পাওয়ারলুমে শান্তিপুরের তাঁত শাড়ি উৎপাদন শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে। একই সুতায় রঙ-ডিজাইন করে উৎপাদন হচ্ছে শাড়ি।

১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁত ছিল। গত ২৮ বছরে তা কমে টিকে আছে মাত্র এক হাজার। হোসিয়ারি শিল্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ১৯১৮ সালে পাবনা শহরের আশপাশে তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটে। তাঁত শিল্পের প্রয়োজনে সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজারও পাবনায় গড়ে ওঠে।

১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষ বসু একবার পাবনায় আসেন। এ সময় তিনি পাবনায় সাতটি হোসিয়ারি শিল্প পরিদর্শন করেন। তিনি এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে মুগ্ধ হন। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্যের মান ও চাহিদা দেখে তিনি এ শিল্পকে বস্ত্র শিল্পের ‘মা’ বলে আখ্যায়িত করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পাবনায় হোসিয়ারি শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য গেঞ্জি, পাবনার তাঁত শিল্পের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে পাবনা জেলায় প্রায় ৫০০ হোসিয়ারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বহু শ্রমিক নিয়োজিত। পাবনায় তৈরি গেঞ্জি বর্তমানে নেপাল, ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ঢাকা মারফত রফতানি হয়।


তাঁত শিল্পের উদ্ভব সঠিক কবে থেকে তা বলা মুশকিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হলো আদি তাঁতি। এরা আদিকাল থেকে প্রধানত তাঁত বুনে আসছে। এ পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষ তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল। প্রথমে এরা সিন্ধু উপত্যকার অববাহিকায় বসবাস করত, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা সে স্থান পরিত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করে। আবহাওয়া প্রতিকূলতার কারণে পরে তারা রাজশাহী অঞ্চলে চলে আসে। তাঁত শিল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মণিপুরে অনেক আগে থেকেই তাঁত শিল্পের কাজ হয়ে আসছে। মণিপুরিরা মূলত নিজেদের পোশাকের প্রয়োজনে তাঁতের কাপড় তৈরি করত। তাদের তৈরি তাঁতের সামগ্রী পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কুটির শিল্প হিসেবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল। বংশপরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বয়ন উত্কর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য নিদর্শন।

দেশের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট নরসিংদীর শেখের মাঠ ও গ্রামে গড়ে ওঠেছিল যা, তা বাবুর হাট নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ নেই। সুলতানি ও মোগল যুগের উত্তরাধিকারী হিসেবে এখনকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁতের রঙ, নকশা, বুনন পদ্ধতি অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা।

একসময় তাদের পূর্বপুুুরুষরাই জগদ্বিখ্যাত মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।

সুপ্রাচীকাল থেকে সিরাজগঞ্জের শাড়ি এ দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছে। সিরাজগঞ্জের দক্ষ কারিগরেরা বংশানুক্রমে এ শাড়ি তৈরী করছেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের শাড়ির কথাটি উল্লেখ রয়েছে। তাঁতিরা ঠিক কবে থেকে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরি করছেন সে ইতিহাস সঠিকভাবে অজানা থাকলেও এ অঞ্চলের শাড়ির একটি ঐতিহ্য চলমান রয়েছে। বসাক শ্রেণীর তাঁতপল্লীর তাঁতিরা বংশানুক্রমে হাজার বছর ধরে এ শাড়ি তৈরি করে চলেছেন। এখানকার তাঁতিরা শুধু সুতি সুতাকে উপজিব্য করে নিজের দক্ষতায় তৈরি করেন তাঁতের শাড়ি, যা বেশ আরামদায়ক, মার্জিত ও রুচিশীল। এখানকার শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কাজ। তবে ৯০ দশকে এখানকার শাড়ি তৈরিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। সে সময় তৈরি কটন শাড়ির পাশাপাশি সফটসিল্ক ও হাফসিল্ক শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী নকশায় এখন তাঁতের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটি শাড়ি তৈরি করতে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়, এর সাথে তাঁতের শাড়ির পরতে পরতে সংশ্লিষ্টদের কী পরিমাণ মমতা জড়িয়ে আছে, সে কথা আজও অনেকের কাছে অজানা। তাঁতে তৈরি শাড়ি যেকোনো নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সক্ষম। সময়ের সাথে পরিবর্তিত অবস্থায় আধুনিক নারীর রুচি, পছন্দ ও বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সাথে সংগতি রেখে তৈরি হচ্ছে কারুকার্যখচিত আধুনিক নকশাসমৃদ্ধ তাঁতের শাড়ি। তাঁতে তৈরি হচ্ছে তাঁতের সুতির শাড়ি, দেবদাস, আনারকলি, জামদানি, সুতি জামদানি, জরি পাড়, স্বর্ণচূড়, কুমকুম, সানন্দা, কটকি, সুতিপাড়, নিলাম্বরী, ময়ূরকণ্ঠী, হাজারবুটি, ইককাত, সিল্ক, মণিপুরি, সুতিসিল্ক, হাফসিল্ক, বালুচরি, শান্তিপুরি, সফটসিল্ক, আধা রেশমি, গ্রামীণ চেকসহ নানা বাহারের ও নামের শাড়ি। আগে পদ্মপাড়, মাধবীলতা, মরবী, তেরবী, কুঞ্জলতা ও লতাপাতা পাড়ের শাড়ি তৈরি করা হলেও এখন তাঁতিরা পাড়ে পরিবর্তন এনেছেন। তাঁতে নারী ও পুরুষ উভয়ই কাজ করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেট, সপিংমলে শোভা পাচ্ছে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য নয়ন কাড়া এসব বাহারি তাঁতের শাড়ি ও থ্রি-পিস।

দেশের শাড়ি ও পোশাকের সিংহভাগ পূরণ করছে সিরাজগঞ্জের তাঁতের তৈরি শাড়ি ও পোশাক। বিদেশীরা ক্রয় করছেন সিরাজগঞ্জের তৈরি তাঁতের শাড়ি। শুধু বাঙালি বধূ ও ললনাদের পরিধানের বস্ত্র হিসেবে নয়, বিভিন্ন উৎসবে কিংবা ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশীদের কাছেও আকর্ষণীয় উপহার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে যমুনার পাড়ে তৈরি নজর কাড়া তাঁতের শাড়ি। উপহার হিসেবে দেয়া হয় তাঁতের শাড়ি। মান, বুনন, নকশার তারতম্য ভেদে ৪০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমানের শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। অর্ডার দিলে ১০-২০ হাজার টাকা মূল্যমানের শাড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন তাঁত মালিকরা। তবে জামদানি ও সিল্ক শাড়ির দাম অন্য শাড়ির তুলনায় একটু বেশি। জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, চৌহালী, কাজিপুরে তাঁত কারখানার সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। এ শিল্পে জড়িত আছেন আট-নয় লাখ শ্রমিক, মালিক ও কর্মচারী। প্রতি বছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদন হয়।

আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিদ্যুতের সাহায্যে চালিত পাওয়ারলুম চালু হলে এর মাধ্যমে কাপড় তৈরি শুরু হলেও হস্তচালিত তাঁত ও পাওয়ারলুমের সমন্বয় তাঁত শিল্পকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে। এর মাধ্যমে কাপড়ের পাড়ে মনোমুগ্ধকর সব নকশা করা হচ্ছে। মূলত পাড়ের নকশার ওপর ভিত্তি করে কাপড়ের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এবং কাপড় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তবে কালের বির্বতনে তাঁতের শাড়ির নকশা এখন অনেকটাই আধুনিক হয়ে একদিকে যেমন অভিনবত্ব এসেছে, তেমনি চমত্কারিত্ব ও গুণে-মানে হয়েছে খুবই উন্নত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, সদর, উল্লাপাড়া উপজেলাসহ যমুনা নদীর তীরঘেঁষা প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা তাঁত শিল্প হিসেবে পরিচিত। তাঁত শিল্পকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট, মুকন্দগাতী (সোহাগপুর), এনায়েতপুর ও জেলা সদরের নিউমার্কেট কাপড়ের হাট। এসব হাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাপড়ের ব্যবসায়ীরা কাপড় কেনার জন্য আসছেন, তেমনি এ হাটগুলো তাঁত উপকরণ ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম স্থান। তাঁত সাধারণত দুই প্রকার—দেশী ও চিত্তরঞ্জন। দেশী তাঁতে সাধারণত গামছা, চাদর প্রভৃতি তৈরি হয়। আর চিত্তরঞ্জন তাঁতে ১০০ কাউন্টের সুতার উন্নত মানের ধুতি, মনোমুগ্ধকর শাড়ি, চাদর, লুঙ্গিসহ প্রায় সব ধরনের কাপড়ই প্রস্তুত হয়। চিত্তরঞ্জন তাঁতের বড় সুবিধা হলো দ্রুত কাজ হয়, সময় কম লাগে। সুতা কাটে কম এবং তাঁতির পরিশ্রম কম হয়। 

কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় অনেকটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তাঁত শিল্প। আবহমান বাংলার তাঁতের শাড়ি এ দেশের কুটির শিল্পের অন্যতম একটি উপকরণ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গুণে-মানে উন্নত চাহিদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে তাঁতিদের এ পরিশ্রমকে অনেকে পুঁজি করে নজরদারির অভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এখানে তৈরি করা শাড়িতে নিজেদের কোম্পানির সিল মেরে নিজেদের তৈরি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। ফলে শাড়ি এবং এখানকার তাঁতিদের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে না, যা নীতিনৈতিকতাবিরোধী। ভাল ও উন্নত মানের সুতা দেশে তৈরি না হওয়ায় চোরাপথে আসা এবং ভারতের তৈরি (১০০ কাউন্ট) সুতাই এখন তাঁত শিল্পের প্রধান ভরসা। কিন্তু আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে ভারতীয় সুতা উচ্চমূল্যে কিনতে হয়। এর কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আধুনিক চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে মানসম্মত প্রয়োজনমতো পোশাক তৈরি করা যাচ্ছে না। তাঁত শ্রমিকদের সময়োপযোগী কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় গতানুগতিক সনাতন পদ্ধতিতে পোশাক তৈরির ধারার বাইরে এসে আধুনিক রুচিসম্মত পোশাক তৈরি করতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া মূলধনের সমস্যা তো রয়েছেই। তাঁত শিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একেবারেই কম। পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারির অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে তাঁত শিল্প। সরকারিভাবে মোটা অংকের ঋণপ্রাপ্তির কোনো সুযোগ না থাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। মূলধনের অভাবে অনেক তাঁত এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতকে সিরাজগঞ্জের ব্র্যান্ড হিসেবে নিয়েছে সরকার। তাই তাঁত শিল্প রক্ষায় এ শিল্পের জন্য সুতাসহ সব উপকরণের সহজলভ্যতা ও পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে তাঁত শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং তাঁত শিল্পের অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অশোক ব্যানার্জী
অশোক ব্যানার্জী: সাংবাদিক
বনিকবার্তা

কোন মন্তব্য নেই: