ক্যাটস আই | Cats Eye - Textile Lab | Textile Learning Blog

ক্যাটস আই | Cats Eye

ফ্যাশনে নতুন ধারা এনেছে যে ক্যাটস আই
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।

আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

ফ্যাশনে নতুন ধারা এনেছে যে ক্যাটস আই
বাংলাদেশের ফ্যাশন মানচিত্রে ক্যাটস আইয়ের উদয় অনেকটা ধূমকেতুর মতো। পরোক্ষে পিয়ারসন্স তুল্য হতে পারে উল্কার সঙ্গে; যার শুরুটা সাড়াজাগানো হলেও সমাপ্তি ছিল আকস্মিক। ফলে ক্যাটস আই ধূমকেতুর মতোই পার করেছে ৪০টি ঘটনাময় বছর।

১৯৮০-এর দশকের শুরুর কথা। কানাডাফেরত এক জোড়া তরুণ-তরুণী গ্রিন সুপার মার্কেটে মনের ক্ষুধা মেটানোর একটা ঘেরাটোপ বানিয়ে হইচই ফেলে দেন। নাম ‘গীতবিতান’। প্রতিদিন নগরীর সংগীতপ্রিয় থেকে উঠতি কিংবা তারকা সংগীতশিল্পীদের পদচারণে আসর গুলজার হতে সময় লাগেনি। মাত্র ৫৪ হাজার টাকা পুঁজির সেই স্বপ্নতরু আজ অর্থের নিযুত সংখ্যা ছাড়ানো মহিরুহ। প্রজন্ম পেরোনো প্রতিষ্ঠান।

তাহলে বলে নেওয়া যাক ক্যাটস আইয়ের সূচনাকাহিনি। যে দুজনের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁরা প্রতিবেশী, বন্ধু, অনেকটা পিঠাপিঠি বেড়ে ওঠা আর অজান্তেই আবদ্ধ হয়ে যাওয়া হৃদিবাঁধনে। বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন। সেই সময়ে তাঁরা জীবন ভাগাভাগি করে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। উভয় পরিবারের জন্য বিষয়টা যতটা বিস্ময়কর ছিল, তাঁদের জন্যও ছিল না কম রোমাঞ্চক! কারণ, মেয়েটি তখন মাত্র ১৭। এসএসসি পাস করেছেন। আর ছেলেটি ইংরেজি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে। তখন তাঁরা পাড়ি জমালেন কানাডায়। টানা ১০ বছর সেখানে দুজনে মিলে শিখলেন ফ্যাশন রিটেইলের আদ্যোপান্ত। তারপর দেশে এসে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে নেমে পড়ে যেটা করলেন, সেটাই হয়ে গেল আমাদের ফ্যাশনশিল্প খাতের জন্য মাইলফলক। হয়ে উঠল পরিবর্তনের পথিকৃৎ। পুরুষের ফ্যাশনে বইয়ে দিলেন সতেজ বাতাস।
ক্যাটস আইয়ের চল্লিশে পাঃ

দিন কয়েক আগে ভার্চ্যুয়ালি কথা হচ্ছিল এই চিত্রনাট্যের অন্যতম কুশীলব সাইদ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তাঁর জীবনসঙ্গী আশরাফুন সিদ্দিকীও ছিলেন। সবার কাছে অবশ্য তাঁরা রুমি আর ডোরা হিসেবে। উভয়েই বর্তমানে কানাডায় আছেন। রুমি এখন চেয়ারম্যান। ডোরা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ক্যাটস আইয়ে এরই মধ্যে প্রজন্মান্তর হয়েছে। তাঁরা নতুনদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার। তারপরও তাঁদের অমূল্য অভিজ্ঞতা আর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এখনো নেপথ্য নেতৃত্বের দায়িত্ব অলক্ষ্যে পালন করে চলেছে।

ক্যাটস আইয়ের সাফল্যের রসায়ন কী, এমন প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। তারপর তিনটি মাত্র শব্দে উত্তর দিলেন: ব্র্যান্ড প্রতিশ্রুতি ও সম্পর্ক। শেষেরটাও রসায়ন আছে। সেটা না হয় সমাপ্তিরেখা টানার আগে বলা যাবে। তবে প্রথম উত্তরের রেশ ধরেই জানতে চাওয়া, শুরুর ব্র্যান্ড প্রতিশ্রুতি কী ছিল। আর সেসব কি বজায় আছে? বললেন, মধ্যবিত্ত পুরুষের গৎবাঁধা ফ্যাশন বা স্টেরিওটাইপটা ভেঙে তার ‘আমি’কে পোশাকের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান করা। অর্থাৎ সাধ্যের মধ্যে রেখে সমসাময়িক সঠিক পোশাকটা উপহার দেওয়া। যে পোশাক একাধারে ‘ট্রেন্ডি ও সফিস্টিকেটেড’। এ জন্যই আমাদের চেষ্টা ছিল সেই সময়ের ২০ ডলারে যে মানের শার্ট দেশের বাইরে পাওয়া যেত, সেই মানের শার্ট দু-তিন ডলারে দেওয়া। আর চিরাচরিত দোকানের অভ্যন্তর ও বিক্রয় প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে ভুবন-আবহে ক্রেতাকে অভ্যস্ত করে তোলা। ফলে ক্রেতাদের কাছে ক্যাটস আই ‘আমার ব্র্যান্ড’ হতে সময় লাগেনি।

ব্র্যান্ড প্রতিশ্রুতি পালনে ক্রেতাদের সঙ্গে সুগভীর সম্পর্কও যে তৈরি হয়েছে, সেটা উল্লেখ করে সাঈদ সিদ্দিকী বলেন, কেবল দেশে নয়, এই দূরদেশেও মানুষ আমাকে দেখে চিনে ফেলে যখন বুকে জড়িয়ে ধরে, তখন যে আনন্দটা হয়, তা বর্ণনাতীত। আরও যোগ করলেন, ক্রেতার আস্থা অর্জনে ডিজাইন, গুণগত মান আর ক্রয়সাধ্যকে গুরুত্ব দিয়ে কম লাভে মানসম্পন্ন পণ্যে আমরা ক্রেতার আস্থা অর্জন করেছি। এসবই আমাদের ইউনিক সেলিং পয়েন্ট হয়েছে।

এখানে একটু বলে রাখা ভালো, ক্যাটস আইকে রিটেইল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনাটা ছিল আশরাফুন সিদ্দিকীর। তবে ’৮০ সালে গ্রিন রোডে যে লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা শুরু করেছিলেন, সেটা ঠিকঠাকমতো করে উঠতে পরাছিলেন না। বরং ভোক্তা চাহিদায় তাঁদের প্রায়শই অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হচ্ছিল। অতএব গ্রিন সুপার মার্কেট থেকে চলে এলেন এলিফ্যান্ট রোডের মনসুর ভবনে, যেটা আজও ক্যাটস আইয়ের আপন আলয় হয়ে রয়েছে। এ জন্য তাঁদের প্রচারের প্রয়োজন পড়েনি। সে সামর্থ্যও তখন তাঁদের ছিল না। বরং গ্রিন সুপার মার্কেটের পরিচিতিই হয়েছে প্রচারসহায়। মুখ মুখে ছড়িয়েছে গুণিতক হারে। আর প্রথম বছর শেষে তাঁদের টার্নওভার (লেনদেন) দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকা। অঙ্কটা পাশ থেকে বলে দিলেন আশরাফুন সিদ্দিকী।

কানাডায় সাঈদ সিদ্দিকী কাজ করতেন কানাডিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ড লা শাতোতে। পরে তিনি এরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান শু ব্র্যান্ড অ্যালডোতে চলে যান। আর আশরাফুন সিদ্দিকী কাজ করতেন হোল্ট রেনফ্রিউতে। সাঈদ সিদ্দিকী কিছুটা হতাশা নিয়ে জানান, করোনার ধকল সামলাতে না পেরে এ বছর বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর প্রিয় ব্র্যান্ড লা শাতো। তবে ধকল যথেষ্ট গেলেও ক্যাটস আই আছে, থাকবে। আবার ফিরলেন কানাডা প্রসঙ্গে। বললেন, দুটো ব্র্যান্ডে কাজ করার দিনগুলো ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো। একটা রিটেইল ব্র্যান্ড পরিচালনার খুঁটিনাটি তো আমি সেখান থেকেই শিখেছি। হয়েছি যোগ্যতর বিপণনকর্মী।

এই জুটির অভিযাত্রায় যোগ হয়েছে একের পর এক প্রথম। যেমন ছেলেদের ভালো পোশাকের অভাব থেকেই তাঁরা কেবল পুরুষ পোশাককে বেছে নেন। সাফল্যের সমান্তরালে শাখা বিস্তার করেছেন। প্রথমে ঢাকায়, পরে অন্যান্য জেলায়। প্রথম সহযোগী ব্র্যান্ড করার কৃতিত্বও ক্যাটস আইয়ের, মনসুন রেইন। পরে আনলিমিটেড আর রুবি রেড। পরের দুটো পরিস্থিতির কারণে টিকে থাকতে পারেনি। তবে মনসুন রেইন আছে। সহযোগী ব্র্যান্ড করার সিদ্ধান্তে অনুঘটক হয়েছে প্রয়োজনীয়তা; এক্সিকিউটিভ লাইন করার জন্যই জন্ম মনসুন রেইনের। ঢাকায় স্থানীয় বাজারের জন্য তৈরি পোশাকের কারাখানা করার পথিকৃতের ভূমিকাও পালন করেছে ক্যাটস আই। প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দরজিদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঢাকায় আনতে কম কষ্ট করতে হয়নি।

তবে চার দশক পেরিয়ে এসে, বিশেষ করে করোনাকালের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সাইদ সিদ্দিকীর মনে হয়েছে, নিজেদের আরেকটু ব্যবসায়িক মনোভাব থাকা উচিত ছিল। কারণ, সারা পৃথিবীর রিটেইলারদের মতোই তাঁরাও বিপদে আছেন। বললেন, এ জন্য এখন ভাবি, আমাদের একটা রপ্তানিমুখী শাখা থাকার প্রয়োজন ছিল। ক্যাটস আইকে বিদেশে নিয়ে যেতে না পারার খেদ তাঁর আছে। আছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। এ ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। অন্যদিকে ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রিতে সন্তুষ্ট হলেও আরও ভালো করার সুযোগ রয়েছে বলেই তাঁর অভিমত।

ছেলেদের পোশাকে ক্যাটস আইয়ের ৩৫ বছরঃ

৪০ বছর পেরিয়ে অবিকল তারুণ্য কি ধরে রাখতে পেরেছে ক্যাটস আই? নাকি চালশে হয়েছে, পড়েছে সময়ের ছাপ, ভর করেছে স্থবিরতা? কিছুটা যে পড়েছে, সেটা অস্বীকার না করেই বললেন, বিষয়টা কয়েক বছর আগে থেকে অনুধাবন করে পরিস্থিতি উত্তরণের উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনা সব ভেস্তে দেয়। তবে আমরা হাল ছাড়িনি। বরং পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। স্বাভাবিকতায় ফিরলে আমরা শেওলা সরানোর কাজ শুরু করব।

ক্যাটস আই সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের স্থানীয় ফ্যাশনে পরিবর্তন এনেছে। ক্যাটসে আইয়ের পথ ধরে আসে মেনজ ক্লাব। কয়েক বছর আগে সেটাই হাতবদল হয়ে হয়েছে ক্লাবহাউস। এরপর আসে অধুনা বিলুপ্ত সোলপড্যান্স। এরপর এক্সটাসি ও তানজিম। তৈরি পোশাকশিল্প খাতের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসেছে অনেকগুলো ব্র্যান্ড—ইয়েলো, টেক্সমার্ট, ট্রেন্ডজ, সেইলর, রাইজ, গ্রামীণ ইউনিক্লো, র নেশন, ডিমান্ড, সোলাস্তা, নোয়া, সারা, টুয়েলভ ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে লা রিভ, জেন্টল পার্ক, ঢাকা রিপাবলিক। এ ছাড়া আমাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক ব্র্যান্ডগুলো তো আছেই। ফলে গত ৪০ বছর বলতে গেলে এই শিল্প খাতের চেহারাই বদলে গেছে।

সেই না-বলা বিষয় দিয়েই যতিরেখাটা এবার না হয় টানা যাক। বন্ধু, জীবনসঙ্গী, ব্যবসায়িক অংশীদার, সহযোদ্ধা ইত্যাদি নানা পরিচয় তাঁদের ঘটনাবহুল জীবনকে দিয়েছে মাত্রা। কিন্তু সম্পর্কের এই রসায়নে মূল অনুঘটকটা কী? র‌্যাপিড ফায়ারের মতো করেই তাঁর ছোট্ট উত্তর: বন্ধুত্ব। সবকিছু ছাপিয়ে আমরা একে অন্যের চমৎকার বন্ধু। একেই বলে জাদুজুটি। ফলাফল অনবদ্য ইন্দ্রজাল। ক্যাটস আই তারই অনিন্দ্য দৃষ্টান্ত।

কপিরাইটঃ প্রথম আলো 

কোন মন্তব্য নেই: