ইটালিয়ান ফ্যাশন ব্রেন্ড গুচির ইতিহাস | GUCCI History- Guccio Gucci S.p.A Italy - Textile Lab | Textile Learning Blog
ফ্যাশন আইকন এবং সেনসেশন্যাল ব্র্যান্ড হিসেবে গুচির পণ্যসামগ্রী বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের কাছে জনপ্রিয় ও সমাদৃত। বিশ্বের অভিজাত শ্রেণীর অনেকের কাছে প্রধান পছন্দের তালিকায় রয়েছে গুচি ব্র্যান্ডের হাতব্যাগ, তৈরি পোশাক, জুতা, ঘড়ি, মেকআপ পণ্য ও সুগন্ধি। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচি।

 ১০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ও ব্যবসায়ী গুচিও গুচি ইতালির ধনী এবং ফ্যাশনেবল উচ্চবিত্তদের জন্য বিলাসবহুল লাগেজ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। এই ১০০ বছরে (২০২০ সাল শেষে) গুচি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য, গুচিও গুচির নামের শেষাংশ থেকে গুচি ব্র্যান্ডের নামকরণ করা হয়।
গুচি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা গুচিও গুচির প্রাথমিক জীবনের পরিস্থিতি এবং কিশোর বয়সে লন্ডনের সেভয় হোটেলে কাজ করা কীভাবে তাকে ব্যবসায় প্রভাবিত করেছিল, সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন, মার্জিত উচ্চশ্রেণীর হোটেলে অতিথিদের আনাগোনা এবং এইচ জে কেভ অ্যান্ড সন্সের মতো লাগেজ কোম্পানি তাকে ভ্রমণ ব্যাগ এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রী তৈরি করার কাজে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি লন্ডন থেকে ফ্লোরেন্সে ফিরে যান এবং সেখানে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি ছিল পরিবারের একক মালিকানাধীন চামড়ার দোকান এবং পণ্যের মধ্যে ছিল ঘোড়সওয়ারদের জন্য স্যাডল, চামড়ার ব্যাগ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। 

গুচিও গুচি তার ছেলে আলডোর জেদের কারণে ১৯৩৮ সালে রোম শহরে দ্বিতীয় দোকান খোলেন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে গুচিও গুচি মিলান শহরে তাদের তৃতীয় দোকান খোলেন। তিনি ব্যবসা ছোট রাখতে চেয়েছিলেন এবং যখন তিনি বেঁচেছিলেন, কোম্পানিটি কেবল ইতালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে আলডো গুচি ব্র্যান্ডটিকে একটি আন্তর্জাতিক পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছিলেন। গুচিও গুচির মৃত্যুর (১৯৫৩ সালে) দুই সপ্তাহ আগে তার ছেলে আলডো নিউইয়র্ক শহরে গুচি বুটিক দোকানটি খোলেন। পরে তিনি ব্যবসাকে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোয় প্রসারিত করেছিলেন।


গুচিও গুচির মৃত্যুর পর ব্যবসার দায়িত্ব ছেলেরা নিজেদের হাতে তুলে নেন। নেতৃত্বের পরিবর্তনের পর পরই গুচি ব্র্যান্ডটি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রসারিত হয়েছিল এবং পণ্যসামগ্রীতে বৈচিত্র্যের দিকে নজর দেয়া হয়েছিল। অবশেষে একসময় একক ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসা পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়।

বিশ্বে গুচি ব্র্যান্ডের সামগ্রীর সুনাম অবিসংবাদিত। অন্তত নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গুচির বিলাসবহুল পণ্যসামগ্রী এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুটি ভিন্নধর্মী গল্প দেখা যায়, যা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত ছিল। গুচি পরিবারের গ্ল্যামার ও ঐশ্বর্যের পেছনে সদস্যদের মধ্যে ছিল কোন্দল, ক্ষমতার লড়াই, লোভ-লালসা, হত্যা, প্রতারণা, যৌনতা, বিশ্বাসঘাতকতা, কারাগার এবং পশু নির্যাতনের মতো অসংখ্য বিষয় এবং এসব নিয়ে নানা ধরনের চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটেছে। তাই গুচি পরিবারের কাহিনী শোনার পর কিংবা পড়ার পরে, প্রায় সবারই মনে হবে গুচি পরিবার যেন আলোকিত প্রদীপের নিচে জমে থাকা গাঢ় অন্ধকার। বর্তমান নিবন্ধে সেসব অন্ধকার জগতের কাহিনী থেকে বাছাই করা কয়েকটি ঘটনা তুলে করা হলো।

তবে মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে গুচির তত্কালীন চিফ ডিজাইনার ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পাওলো গুচি (গুচিও গুচির নাতি ও আলডো গুচির ছেলে) এবং তার স্ত্রী জেনি গুচি সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। জেনি যখন ফ্লোরেন্সে পড়াশোনা করতেন, তখন তিনি পাওলো গুচির নজরে পড়েন। জেনি ছিলেন যুবতী ও সুন্দরী। তার প্রতিভারও কমতি ছিল না। তার ছিল অপেরা গানের সুললিত কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে পাওলো ছিল শৈল্পিক মনের মানুষ ও সৃজনশীল। তারা ১৯৭৭ সালে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোকে জেনি ‘সম্মোহনী মৃদু অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এক দশকের মতো সংসার করার পরে জেনির কাছে পাওলোর ব্যক্তিত্বের অজানা দিকটি ক্রমেই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তখন জেনির প্রতি পাওলো আরো নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। জেনি স্বামীর কাছ থেকে হুমকি পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিচ্ছেদের পথে অগ্রসর হন।

জেনি গুচির লেখা বই ‘গুচি ওয়ারস: হাউ আই সার্ভাইভড মার্ডার অ্যান্ড ইন্ট্রিগ অ্যাট দ্য হার্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট ফ্যাশন হাউজ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে। গুচি পরিবারের সদস্যা হিসেবে তিনি কেবল গুচির বিশাল ব্যবসার দিকটিই তুলে ধরেননি, বরং স্বামী পাওলোর সঙ্গে তার রোমান্স, দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, বিশ্বভ্রমণ, অবশেষে বিবাহবিচ্ছেদ এবং গুচি পরিবারের বিভিন্ন অজানা ও অবিশ্বাস্য কাহিনী—যেমন সহিংসতা, খুন, অপরাধ এবং জেলের সময়, দেউলিয়া ও মনস্তাত্ত্বিক নিষ্ঠুরতার মতো বিষয়গুলো বাইরের মানুষের সম্মুখে নিঃসংকোচে তুলে ধরেছেন।

এ কথা সত্যি যে গুচি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা গুচিও গুচির হাত ধরেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। তার ঔরসে পাঁচ ছেলে (একজন শৈশবে মারা যায়) ও এক মেয়ে ছিল। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন দায়িত্বে ছেলেদের নিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু মেয়েকে কোনো দায়িত্ব দেননি। তখন থেকে কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ভাইদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়েছিল এবং গত শতকের আশির দশকে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুরো পরিবারের মধ্যে গুরুতর বিষয় হয়ে ওঠে।

তবে গুচি পরিবারের ক্লাইম্যাক্স ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পরিবারের সদস্যরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। যেমন ১৯৯৪ সালে বিশ্বের সংবাদমাধ্যম পাওলো গুচির নিউইয়র্ক এস্টেটের সংবাদ প্রকাশ করে যে এস্টেটের মালিক তার কর্মীদের বেতন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এবং তার আরব ঘোড়াগুলোকে ক্ষুধার্ত রেখেছিলেন এবং তার পরিণতিতে ছয়টি ঘোড়া মারা যায়। ঘোড়াগুলোকে ক্ষুধার্ত রেখে পাওলো প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে জেনির সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদের নিষ্পত্তি করার মতো অর্থকড়ি তার কাছে নেই।

অন্য ভাইদের মৃত্যু হলে আলডো তার সবচেয়ে ছোট ভাই রোডলফোর সঙ্গে ব্যবসা সমান দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু আলডো ও তার তিন ছেলে রোডলফোর মালিকানা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। কেননা তারা মনে করেছিলেন যে প্রাক্তন মুক চলচ্চিত্র অভিনেতা রোডলফো কোম্পানির অগ্রগতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছেন না। তাই ভারসাম্যহীনতা প্রতিকারের জন্য আলডো একটি সুগন্ধিসহায়ক সংস্থা স্থাপন করেন এবং মুনাফা সঞ্চয় করার প্রচেষ্টায় নিজের এবং তার তিন ছেলের জন্য ৮০ শতাংশ মালিকানা রাখেন। তখন থেকে পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভের জন্য বোর্ড রুমের সীমানা ছাড়িয়ে ঘটনা আইনি লড়াইয়ের জন্য আদালতে গিয়ে পৌঁছে। উদাহরণস্বরূপ, আলডোর ছেলে পাওলো তার নিজস্ব গুচি ব্র্যান্ড শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আলডো তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং পাওলোর সঙ্গে স্বাক্ষরকারী যেকোনো গুচি সরবরাহকারীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছিল। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাওলো তার পিতা আলডোর কয়েক দশকের কর ফাঁকির জন্য মামলা করেন। তখন আলডোর বয়স ৮০ বছরের বেশি এবং সে বয়সে তাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। অবশেষে মরিজিও গুচি (রোডলফো গুচির একমাত্র ছেলে) ব্যবসাকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও বিশাল ব্যবসা চালানোর মতো প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক জ্ঞানের অভাব ছিল তার।

গুচি পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক (হত্যাকাণ্ডের) ঘটনা ঘটে ২৭ মার্চ, ১৯৯৫ সালে। সেদিন সকালে তুমুল আলোচিত ও সমালোচিত মরিজিও তার মিলান অফিসের সিঁড়িতে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। উল্লেখ্য, পৈতৃক সূত্রে গুচির মালিকানা পায় গুচিও গুচির নাতি মরিজিও গুচি। যদিও নির্মম ব্যবসায়িক কৌশল তার আত্মীয়দের শত্রু করে তুলেছিল এবং পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী গুচি ব্র্যান্ডের বর্তমান খ্যাতি ও অত্যন্ত লাভজনক বিলাসবহুল পণ্য ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দুর্ভাগ্য যে তার ক্রমবর্ধমান ঋণ তাকে তার অংশীদারিত্ব বিক্রি করে অর্থ আয় করতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি বাহরাইনভিত্তিক বিকল্প বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টকর্পের কাছে তার অংশ বিক্রি করেছিলেন।

যাহোক, মরিজিও গুচির হত্যার পরিকল্পনার দায়ে আদালত ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে নিহতের প্রাক্তন স্ত্রী প্যাট্রিজিয়া রেজানিকে— সাংবাদিকরা যার ডাকনাম দিয়েছিল ‘দ্য ব্ল্যাক উইডো’—দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেয়া হয় (যদিও তিনি দাবি করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে দোষী বানিয়ে কারাবাসের শাস্তি দেয়া হয়েছে)। তিনি ২০১৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। তবে সেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে এখনো মানুষের মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। মরিজিওর ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল বলে কি তার প্রাক্তন স্ত্রী প্যাট্রিজিয়া তাকে হত্যা করেছিল? প্যাট্রিজিয়া কি হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, কারণ তার গ্ল্যামারাস প্রাক্তন স্বামী তার উপপত্নী পাওলা ফ্রাঞ্চিকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ?

তবে জানা যায়, প্যাট্রিজিয়া অনুভব করেছিলেন স্বামী মরিজিও গুচি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতেন, তিনিই মরিজিওকে সফল করেছেন। তার ভাষায়: ‘আমি তাকে প্রচণ্ড উৎসাহ দিয়েছি ও সহযোগিতা করেছি। তাই একসময় সে গুচির প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।’ তিনি আরো মনে করতেন, নিজের ও তাদের দুই মেয়ের জন্য সম্পদের একটি বৃহত্তর অংশ তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে ফাঁক ছিল। প্যাট্রিজিয়ার ভাষায়, ‘আমি সামাজিক ছিলাম, সে মেলামেশা করতে পছন্দ করত না। আমি সবসময় বাইরে থাকতাম, সে সবসময় ঘরে থাকত।’ প্যাট্রিজিয়া উল্লেখ করেছেন, একবার তিনি মস্তিষ্কের টিউমার থেকে বেঁচে যান, কিন্তু সে (স্বামী মরিজিও) তাকে দেখতে যাননি। এ ঘটনায় তিনি ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, মরিজিও তার কাছ থেকে যা অর্জন করেছিল, তা সবই নিয়েছে।’ তাদের মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা এবং অবজ্ঞার পরিমাণ ছিল বেশি। ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

মরিজিও গুচির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক এবং নারী লেখক সারা গে ফোরডেন রচনা করেন ‘দ্য হাউজ অব গুচি: আ সেনসেশন্যাল স্টোরি অব মার্ডার, ম্যাডনেস, গ্ল্যামার, অ্যান্ড গ্রিড’ গ্রন্থ এবং গ্রন্থটি ২০০০ সালে প্রকাশ হয়। এ গ্রন্থের কাহিনী অবলম্বনে সম্প্রতি হলিউডে নির্মিত হয়েছে রিডলি স্কট পরিচালিত ‘হাউজ অব গুচি’ সিনেমা, যা সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেয়েছে। প্যাট্রিজিয়া রেজানির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মার্কিন পপ তারকা লেডি গাগা। অন্যদিকে মরিজিও গুচির ভূমিকায় আছেন অ্যাডাম ড্রাইভার এবং অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জারেড লেটো ও সালমা হায়েক।

যাহোক, জেনি গুচি তার গ্রন্থে গুচি পরিবারের এমন অনেক ঘরোয়া পরিবেশে সংঘটিত ঘটনা প্রকাশ করেছেন যে তা জানার পরে হয়তো গুচি সম্পর্কে অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এখানে মাত্র দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো, যা জেনিকে নিয়ে ঘটেছিল। একবার জেনি একটি নৈশভোজ পার্টিতে দেরি করে পৌঁছেছিলেন এবং শ্বশুর আলডো কঠোরভাবে বলেছিলেন: ‘তুমি নিজেকে কী মনে করো, যে টেবিলে দেরিতে এসেছ? তুমি কেউ নও, কিছুই না।’ জেনি উত্তর দিয়েছিল: ‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না। আমি দেরি করার জন্য দুঃখিত এবং পুনরায় ক্ষমা চাইছি।’ দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল এ রকম: আলডো ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য বাইরে কোথাও গেলে নোংরা কাপড়চোপড় বাড়িতে নিয়ে আসত এবং পরিষ্কার করার জন্য জেনিকে হুকুম করত। জেনির ভাষায়: ‘তিনি (আলডো) বলতেন, আমি চাই তুমি সব কাজ করো। আমি বলতাম, আমি আপনার ছেলের বৌ। আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারীদের একজন নই।’ উল্লেখ্য, বিয়ের পর থেকেই গুচি পরিবারের সঙ্গে জেনির কিছুটা মতবিরোধে ছিল। হয়তো সতর্ক করার জন্য আলডো তার ছেলে পাওলোকে বলেছিলেন, জেনি ‘ভালো মেয়ে, তবে অশান্তির বোঝা।’

বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে যেকোনো গল্পের মতো জেনির গ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাবলি পাঠকের মনে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। যেমন কেউ কেউ মনে করেন, গুচি পরিবারের অফিস ও বাসভবনে যা ঘটেছিল, তা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে অনেকে মন্তব্য করেছেন, জেনি গুচির গ্রন্থের উল্লেখিত ঘটনার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। যদি তা না হয়, তাহলে কেন গুচি পরিবার ব্র্যান্ডের অধিকার হারাবে এবং বাইরের একটা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা কিনে নেবে।

কথায় আছে, চকচক করলেই সোনা হয় না এবং গোলাপেরও কাঁটা আছে। বিশ্বজুড়ে গুচির পণ্যসামগ্রীর চাহিদা, সুনাম এবং ধনকুবের ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের ওয়ারড্রোবে পাওয়া গেলেও একসময় গুচি পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, এমনকি পুরো পরিবার ক্রমাগত ও আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মামলায় লিপ্ত ছিল ছেলের বিরুদ্ধে বাবা, চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে চাচাতো ভাই। গ্ল্যামার এবং ঐশ্বর্যের পেছনে বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা ও হত্যার ইতিহাসের এক অনন্য উজ্জ্বল উদাহরণ গুচি পরিবার। তাই বলা যেতে পারে, গুচি পরিবার যেন ‘আলোকিত প্রদীপের নিচে গাঢ় অন্ধকার’।

 
ফজল হাসান: লেখক ও অনুবাদক

ইটালিয়ান ফ্যাশন ব্রেন্ড গুচির ইতিহাস | GUCCI History- Guccio Gucci S.p.A Italy

ফ্যাশন আইকন এবং সেনসেশন্যাল ব্র্যান্ড হিসেবে গুচির পণ্যসামগ্রী বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের কাছে জনপ্রিয় ও সমাদৃত। বিশ্বের অভিজাত শ্রেণীর অনেকের কাছে প্রধান পছন্দের তালিকায় রয়েছে গুচি ব্র্যান্ডের হাতব্যাগ, তৈরি পোশাক, জুতা, ঘড়ি, মেকআপ পণ্য ও সুগন্ধি। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচি।

 ১০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ও ব্যবসায়ী গুচিও গুচি ইতালির ধনী এবং ফ্যাশনেবল উচ্চবিত্তদের জন্য বিলাসবহুল লাগেজ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। এই ১০০ বছরে (২০২০ সাল শেষে) গুচি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য, গুচিও গুচির নামের শেষাংশ থেকে গুচি ব্র্যান্ডের নামকরণ করা হয়।
গুচি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা গুচিও গুচির প্রাথমিক জীবনের পরিস্থিতি এবং কিশোর বয়সে লন্ডনের সেভয় হোটেলে কাজ করা কীভাবে তাকে ব্যবসায় প্রভাবিত করেছিল, সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন, মার্জিত উচ্চশ্রেণীর হোটেলে অতিথিদের আনাগোনা এবং এইচ জে কেভ অ্যান্ড সন্সের মতো লাগেজ কোম্পানি তাকে ভ্রমণ ব্যাগ এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রী তৈরি করার কাজে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি লন্ডন থেকে ফ্লোরেন্সে ফিরে যান এবং সেখানে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি ছিল পরিবারের একক মালিকানাধীন চামড়ার দোকান এবং পণ্যের মধ্যে ছিল ঘোড়সওয়ারদের জন্য স্যাডল, চামড়ার ব্যাগ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। 

গুচিও গুচি তার ছেলে আলডোর জেদের কারণে ১৯৩৮ সালে রোম শহরে দ্বিতীয় দোকান খোলেন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে গুচিও গুচি মিলান শহরে তাদের তৃতীয় দোকান খোলেন। তিনি ব্যবসা ছোট রাখতে চেয়েছিলেন এবং যখন তিনি বেঁচেছিলেন, কোম্পানিটি কেবল ইতালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে আলডো গুচি ব্র্যান্ডটিকে একটি আন্তর্জাতিক পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছিলেন। গুচিও গুচির মৃত্যুর (১৯৫৩ সালে) দুই সপ্তাহ আগে তার ছেলে আলডো নিউইয়র্ক শহরে গুচি বুটিক দোকানটি খোলেন। পরে তিনি ব্যবসাকে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোয় প্রসারিত করেছিলেন।


গুচিও গুচির মৃত্যুর পর ব্যবসার দায়িত্ব ছেলেরা নিজেদের হাতে তুলে নেন। নেতৃত্বের পরিবর্তনের পর পরই গুচি ব্র্যান্ডটি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে প্রসারিত হয়েছিল এবং পণ্যসামগ্রীতে বৈচিত্র্যের দিকে নজর দেয়া হয়েছিল। অবশেষে একসময় একক ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যবসা পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়।

বিশ্বে গুচি ব্র্যান্ডের সামগ্রীর সুনাম অবিসংবাদিত। অন্তত নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গুচির বিলাসবহুল পণ্যসামগ্রী এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুটি ভিন্নধর্মী গল্প দেখা যায়, যা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত ছিল। গুচি পরিবারের গ্ল্যামার ও ঐশ্বর্যের পেছনে সদস্যদের মধ্যে ছিল কোন্দল, ক্ষমতার লড়াই, লোভ-লালসা, হত্যা, প্রতারণা, যৌনতা, বিশ্বাসঘাতকতা, কারাগার এবং পশু নির্যাতনের মতো অসংখ্য বিষয় এবং এসব নিয়ে নানা ধরনের চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটেছে। তাই গুচি পরিবারের কাহিনী শোনার পর কিংবা পড়ার পরে, প্রায় সবারই মনে হবে গুচি পরিবার যেন আলোকিত প্রদীপের নিচে জমে থাকা গাঢ় অন্ধকার। বর্তমান নিবন্ধে সেসব অন্ধকার জগতের কাহিনী থেকে বাছাই করা কয়েকটি ঘটনা তুলে করা হলো।

তবে মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে গুচির তত্কালীন চিফ ডিজাইনার ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পাওলো গুচি (গুচিও গুচির নাতি ও আলডো গুচির ছেলে) এবং তার স্ত্রী জেনি গুচি সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। জেনি যখন ফ্লোরেন্সে পড়াশোনা করতেন, তখন তিনি পাওলো গুচির নজরে পড়েন। জেনি ছিলেন যুবতী ও সুন্দরী। তার প্রতিভারও কমতি ছিল না। তার ছিল অপেরা গানের সুললিত কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে পাওলো ছিল শৈল্পিক মনের মানুষ ও সৃজনশীল। তারা ১৯৭৭ সালে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোকে জেনি ‘সম্মোহনী মৃদু অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এক দশকের মতো সংসার করার পরে জেনির কাছে পাওলোর ব্যক্তিত্বের অজানা দিকটি ক্রমেই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তখন জেনির প্রতি পাওলো আরো নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। জেনি স্বামীর কাছ থেকে হুমকি পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিচ্ছেদের পথে অগ্রসর হন।

জেনি গুচির লেখা বই ‘গুচি ওয়ারস: হাউ আই সার্ভাইভড মার্ডার অ্যান্ড ইন্ট্রিগ অ্যাট দ্য হার্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট ফ্যাশন হাউজ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে। গুচি পরিবারের সদস্যা হিসেবে তিনি কেবল গুচির বিশাল ব্যবসার দিকটিই তুলে ধরেননি, বরং স্বামী পাওলোর সঙ্গে তার রোমান্স, দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, বিশ্বভ্রমণ, অবশেষে বিবাহবিচ্ছেদ এবং গুচি পরিবারের বিভিন্ন অজানা ও অবিশ্বাস্য কাহিনী—যেমন সহিংসতা, খুন, অপরাধ এবং জেলের সময়, দেউলিয়া ও মনস্তাত্ত্বিক নিষ্ঠুরতার মতো বিষয়গুলো বাইরের মানুষের সম্মুখে নিঃসংকোচে তুলে ধরেছেন।

এ কথা সত্যি যে গুচি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা গুচিও গুচির হাত ধরেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। তার ঔরসে পাঁচ ছেলে (একজন শৈশবে মারা যায়) ও এক মেয়ে ছিল। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন দায়িত্বে ছেলেদের নিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু মেয়েকে কোনো দায়িত্ব দেননি। তখন থেকে কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ভাইদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়েছিল এবং গত শতকের আশির দশকে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুরো পরিবারের মধ্যে গুরুতর বিষয় হয়ে ওঠে।

তবে গুচি পরিবারের ক্লাইম্যাক্স ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পরিবারের সদস্যরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। যেমন ১৯৯৪ সালে বিশ্বের সংবাদমাধ্যম পাওলো গুচির নিউইয়র্ক এস্টেটের সংবাদ প্রকাশ করে যে এস্টেটের মালিক তার কর্মীদের বেতন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এবং তার আরব ঘোড়াগুলোকে ক্ষুধার্ত রেখেছিলেন এবং তার পরিণতিতে ছয়টি ঘোড়া মারা যায়। ঘোড়াগুলোকে ক্ষুধার্ত রেখে পাওলো প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে জেনির সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদের নিষ্পত্তি করার মতো অর্থকড়ি তার কাছে নেই।

অন্য ভাইদের মৃত্যু হলে আলডো তার সবচেয়ে ছোট ভাই রোডলফোর সঙ্গে ব্যবসা সমান দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু আলডো ও তার তিন ছেলে রোডলফোর মালিকানা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। কেননা তারা মনে করেছিলেন যে প্রাক্তন মুক চলচ্চিত্র অভিনেতা রোডলফো কোম্পানির অগ্রগতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছেন না। তাই ভারসাম্যহীনতা প্রতিকারের জন্য আলডো একটি সুগন্ধিসহায়ক সংস্থা স্থাপন করেন এবং মুনাফা সঞ্চয় করার প্রচেষ্টায় নিজের এবং তার তিন ছেলের জন্য ৮০ শতাংশ মালিকানা রাখেন। তখন থেকে পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভের জন্য বোর্ড রুমের সীমানা ছাড়িয়ে ঘটনা আইনি লড়াইয়ের জন্য আদালতে গিয়ে পৌঁছে। উদাহরণস্বরূপ, আলডোর ছেলে পাওলো তার নিজস্ব গুচি ব্র্যান্ড শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আলডো তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং পাওলোর সঙ্গে স্বাক্ষরকারী যেকোনো গুচি সরবরাহকারীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছিল। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাওলো তার পিতা আলডোর কয়েক দশকের কর ফাঁকির জন্য মামলা করেন। তখন আলডোর বয়স ৮০ বছরের বেশি এবং সে বয়সে তাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। অবশেষে মরিজিও গুচি (রোডলফো গুচির একমাত্র ছেলে) ব্যবসাকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও বিশাল ব্যবসা চালানোর মতো প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক জ্ঞানের অভাব ছিল তার।

গুচি পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক (হত্যাকাণ্ডের) ঘটনা ঘটে ২৭ মার্চ, ১৯৯৫ সালে। সেদিন সকালে তুমুল আলোচিত ও সমালোচিত মরিজিও তার মিলান অফিসের সিঁড়িতে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। উল্লেখ্য, পৈতৃক সূত্রে গুচির মালিকানা পায় গুচিও গুচির নাতি মরিজিও গুচি। যদিও নির্মম ব্যবসায়িক কৌশল তার আত্মীয়দের শত্রু করে তুলেছিল এবং পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী গুচি ব্র্যান্ডের বর্তমান খ্যাতি ও অত্যন্ত লাভজনক বিলাসবহুল পণ্য ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দুর্ভাগ্য যে তার ক্রমবর্ধমান ঋণ তাকে তার অংশীদারিত্ব বিক্রি করে অর্থ আয় করতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি বাহরাইনভিত্তিক বিকল্প বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টকর্পের কাছে তার অংশ বিক্রি করেছিলেন।

যাহোক, মরিজিও গুচির হত্যার পরিকল্পনার দায়ে আদালত ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে নিহতের প্রাক্তন স্ত্রী প্যাট্রিজিয়া রেজানিকে— সাংবাদিকরা যার ডাকনাম দিয়েছিল ‘দ্য ব্ল্যাক উইডো’—দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেয়া হয় (যদিও তিনি দাবি করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে দোষী বানিয়ে কারাবাসের শাস্তি দেয়া হয়েছে)। তিনি ২০১৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। তবে সেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে এখনো মানুষের মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। মরিজিওর ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল বলে কি তার প্রাক্তন স্ত্রী প্যাট্রিজিয়া তাকে হত্যা করেছিল? প্যাট্রিজিয়া কি হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, কারণ তার গ্ল্যামারাস প্রাক্তন স্বামী তার উপপত্নী পাওলা ফ্রাঞ্চিকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ?

তবে জানা যায়, প্যাট্রিজিয়া অনুভব করেছিলেন স্বামী মরিজিও গুচি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতেন, তিনিই মরিজিওকে সফল করেছেন। তার ভাষায়: ‘আমি তাকে প্রচণ্ড উৎসাহ দিয়েছি ও সহযোগিতা করেছি। তাই একসময় সে গুচির প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।’ তিনি আরো মনে করতেন, নিজের ও তাদের দুই মেয়ের জন্য সম্পদের একটি বৃহত্তর অংশ তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে ফাঁক ছিল। প্যাট্রিজিয়ার ভাষায়, ‘আমি সামাজিক ছিলাম, সে মেলামেশা করতে পছন্দ করত না। আমি সবসময় বাইরে থাকতাম, সে সবসময় ঘরে থাকত।’ প্যাট্রিজিয়া উল্লেখ করেছেন, একবার তিনি মস্তিষ্কের টিউমার থেকে বেঁচে যান, কিন্তু সে (স্বামী মরিজিও) তাকে দেখতে যাননি। এ ঘটনায় তিনি ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, মরিজিও তার কাছ থেকে যা অর্জন করেছিল, তা সবই নিয়েছে।’ তাদের মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা এবং অবজ্ঞার পরিমাণ ছিল বেশি। ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

মরিজিও গুচির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক এবং নারী লেখক সারা গে ফোরডেন রচনা করেন ‘দ্য হাউজ অব গুচি: আ সেনসেশন্যাল স্টোরি অব মার্ডার, ম্যাডনেস, গ্ল্যামার, অ্যান্ড গ্রিড’ গ্রন্থ এবং গ্রন্থটি ২০০০ সালে প্রকাশ হয়। এ গ্রন্থের কাহিনী অবলম্বনে সম্প্রতি হলিউডে নির্মিত হয়েছে রিডলি স্কট পরিচালিত ‘হাউজ অব গুচি’ সিনেমা, যা সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেয়েছে। প্যাট্রিজিয়া রেজানির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মার্কিন পপ তারকা লেডি গাগা। অন্যদিকে মরিজিও গুচির ভূমিকায় আছেন অ্যাডাম ড্রাইভার এবং অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জারেড লেটো ও সালমা হায়েক।

যাহোক, জেনি গুচি তার গ্রন্থে গুচি পরিবারের এমন অনেক ঘরোয়া পরিবেশে সংঘটিত ঘটনা প্রকাশ করেছেন যে তা জানার পরে হয়তো গুচি সম্পর্কে অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এখানে মাত্র দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো, যা জেনিকে নিয়ে ঘটেছিল। একবার জেনি একটি নৈশভোজ পার্টিতে দেরি করে পৌঁছেছিলেন এবং শ্বশুর আলডো কঠোরভাবে বলেছিলেন: ‘তুমি নিজেকে কী মনে করো, যে টেবিলে দেরিতে এসেছ? তুমি কেউ নও, কিছুই না।’ জেনি উত্তর দিয়েছিল: ‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না। আমি দেরি করার জন্য দুঃখিত এবং পুনরায় ক্ষমা চাইছি।’ দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল এ রকম: আলডো ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য বাইরে কোথাও গেলে নোংরা কাপড়চোপড় বাড়িতে নিয়ে আসত এবং পরিষ্কার করার জন্য জেনিকে হুকুম করত। জেনির ভাষায়: ‘তিনি (আলডো) বলতেন, আমি চাই তুমি সব কাজ করো। আমি বলতাম, আমি আপনার ছেলের বৌ। আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারীদের একজন নই।’ উল্লেখ্য, বিয়ের পর থেকেই গুচি পরিবারের সঙ্গে জেনির কিছুটা মতবিরোধে ছিল। হয়তো সতর্ক করার জন্য আলডো তার ছেলে পাওলোকে বলেছিলেন, জেনি ‘ভালো মেয়ে, তবে অশান্তির বোঝা।’

বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে যেকোনো গল্পের মতো জেনির গ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাবলি পাঠকের মনে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। যেমন কেউ কেউ মনে করেন, গুচি পরিবারের অফিস ও বাসভবনে যা ঘটেছিল, তা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে অনেকে মন্তব্য করেছেন, জেনি গুচির গ্রন্থের উল্লেখিত ঘটনার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। যদি তা না হয়, তাহলে কেন গুচি পরিবার ব্র্যান্ডের অধিকার হারাবে এবং বাইরের একটা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা কিনে নেবে।

কথায় আছে, চকচক করলেই সোনা হয় না এবং গোলাপেরও কাঁটা আছে। বিশ্বজুড়ে গুচির পণ্যসামগ্রীর চাহিদা, সুনাম এবং ধনকুবের ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের ওয়ারড্রোবে পাওয়া গেলেও একসময় গুচি পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, এমনকি পুরো পরিবার ক্রমাগত ও আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মামলায় লিপ্ত ছিল ছেলের বিরুদ্ধে বাবা, চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে চাচাতো ভাই। গ্ল্যামার এবং ঐশ্বর্যের পেছনে বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা ও হত্যার ইতিহাসের এক অনন্য উজ্জ্বল উদাহরণ গুচি পরিবার। তাই বলা যেতে পারে, গুচি পরিবার যেন ‘আলোকিত প্রদীপের নিচে গাঢ় অন্ধকার’।

 
ফজল হাসান: লেখক ও অনুবাদক

কোন মন্তব্য নেই: