ইন্ডিগো ব্লু সম্পর্কিত কিছু তথ্য | Indigo Blue | Denim Dyeing - Textile Lab | Textile Learning Blog
নীল দুনিয়া
নীল চুলের রঙ আর চোখের সাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরোপে, পশ্চিম আফ্রিকান নারীরা তাঁদের ত্বকে আর চুলে লাগাতেন এই রঙ, সারা শরীর রঙিন করে তুলতেন, শরীরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে ট্যাটু করাতেন এই রঙে৷ মন্দ আত্মাদের তাড়াতে নীল পুড়িয়ে ধূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জীবাণুনাশক, জন্মনিরোধক, গর্ভপাতের কার্যকর ঔষধ, সিফিলিসের আরোগ্যকারী প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নীলের শিকড় শক্তিশালী যৌন উদ্দীপক হিসেবে নিদান দিতেন প্রাচীন কবিরাজরা।

নীল বললেই আমাদের মনে পড়ে মাথার উপরের আকাশ। বিনয় মজুমদারকেও মনে পড়ে –'একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেলো।' বিনয় কবি হলেও বিজ্ঞানী, তিনি জানতেন আকাশের নীল প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিবিভ্রম। সুররসিক ও সুরারসিক উভয়েরই অভিজ্ঞতা আছে, মনের কিংবা বাহ্যিক বস্তুর কারণে আকাশের রঙ বদলে বদলে যেতে। ব্রিটিশ শিল্পী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা ডেরেক জার্মানের শেষ সিনেমা 'ব্লু'-এর কথা মনে পড়তে পারে কারো।

মৃত্যুর অল্প কয়েক মাস আগে তিনি নির্মাণ করেছিলেন তিরানব্বই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি। একটি স্থিত নীল পর্দা আর ভয়েস ওভার, আবহ – এই হলো পুরো নির্মাণ শৈলী। পরিচালক ডেরেক এইডসের কারণে আস্তে আস্তে আংশিক অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। কবিতা আর দিনপঞ্জীর ধরণে সংলাপ, স্মৃতিকাতরতা সব মিলিয়ে এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের অনবদ্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।

ব্রিটিশ শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেরেক জার্মানের শেষ সিনেমা ‘ব্লু’-এর কথা মনে পড়তে পারে কারো।
পর্দায় শুধু নীল আকাশের দৃশ্য কিংবা শুধুই নীল চৌকোন পর্দা। সেখানে কয়েকটা সংলাপ আমরা পড়ে নিতে পারি। 

'নীল হচ্ছে বিশ্বজনীন প্রেম যেখানে পুরুষ স্নান করে নেয়। 'নীল মানুষের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা বদলে দেয়।' 

'ভাইরাস সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমার মৃত কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী ছাড়া কোনো বন্ধু নেই।' 
'আমার রেটিনা এক অন্যতর গ্রহ।' 
'রক্তের সংবেদনের রঙ নীল।'

একই বছর, তিরানব্বই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি সিনেমার কথা মনে না পড়ে পারে না, সিনেমার তন্নিষ্ঠ ভক্তদের। পোলিশ পরিচালক ক্রিস্তফ কিসলোভস্কির থ্রি কালার্স ট্রিলজির প্রথমটি 'ব্লু' এই বছরেই মুক্তি পায়। ফরাসি বিপ্লবের প্রাণমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা – এই তিন শব্দকে নির্ভর করেই ত্রয়ী সিনেমা পর পর মুক্তি পায়। প্রথম সিনেমা ব্লু'তে নামী সুরকার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর জুলিয়েত বিনোশের চরিত্রটি নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। স্বাধীনতা এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্র বিষয়, প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের ইন্টেরিয়রে নীলের ছোঁয়া। নীল কত উষ্ণ হতে পারে আমরা জেনে যাই, সমপ্রেমের সিনেমা 'ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার' দেখবার পর।

নীল কত উষ্ণ হতে পারে আমরা জেনে যাই, সমপ্রেমের সিনেমা ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ দেখবার পর।

কিন্তু আমাদের আজকের আলাপ, ইন্ডিগো বা প্রাকৃতিক নীল চাষ ও তার ছড়িয়ে পড়ার প্রাসঙ্গিক ইতিহাস নিয়ে।   

প্রাচীন ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য - অষ্টম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত - উটবাহিত হয়ে আফ্রিকান বন্দী, সোনা, লবণ আর  আইভরি, উটপাখির পালক এসব বিলাসদ্রব্য মেডিটারেনিয়ান বাণিজ্য কেন্দ্রের দিকে যেত। সেখানে আফ্রিকান, আরব,  এশিয়ান এবং ইউরোপিয়ান বাজারের একত্র সমবায় ছিলো।

পুরো মধ্যযুগ ধরে,  ইতালিয়ানরা এভাবে উত্তর ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলো ব্যবসাটা- টেক্সটাইল উৎপাদনে নীলের মূল্য ছিলো সকল বিচারেই সেরা বলে। শিল্পকলা আর  শিল্পকুশল স্থাপত্যের জন্যে নীল দুষ্প্রাপ্য আর দুর্মূল্য বস্তু৷ আলজেরিয়ান শিল্পী রাচিড করাইচির ভাষায়, 'সুপ্রাটেরেস্ট্রিয়াল - অসীম যাত্রার পথ (supraterrestrial)। খ্রিস্টান, ইসলামী আর  ইহুদী সংস্কৃতিতে এই রঙ ছড়িয়ে পড়ে - প্রাচীন খলিফা, রাজকীয় সভা, গীর্জা আর মসজিদ, স্বর্গের চিহ্ন বোঝাতে। পবিত্র মানুষ বোঝাতে পোশাকের রং হয় নীল। 

প্রাচীন ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য - অষ্টম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত - উটবাহিত হয়ে আফ্রিকায় পৌঁছে নীল

নীল চুলের রঙ আর চোখের সাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরোপে, পশ্চিম আফ্রিকান নারীরা তাদের ত্বকে আর চুলে লাগাতেন এই রঙ, সারা শরীর রঙিন করে তুলতেন, শরীরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে ট্যাটু করাতেন এই রঙে৷ মন্দ আত্মাদের তাড়াতে নীল পুড়িয়ে ধূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জীবাণুনাশক, জন্মনিরোধক, গর্ভপাতের কার্যকর ঔষধ, সিফিলিসের আরোগ্যকারী প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নীলের শিকড় শক্তিশালী যৌন উদ্দীপক হিসেবে নিদান দিতেন প্রাচীন কবিরাজরা। শমিত করে এই রঙ, এই কারণে শরীরে নীল রঙের ট্যাটু করানো হতো - বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে - নানারকম বাতের ব্যথা থেকে বাঁচতে। নীলের মিশ্রণ চোখের জীবাণুসংক্রমণের ক্ষেত্রে চিকিৎসা উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ 

ক্ষতের উপশম হিসেবে নীলের কার্যকারিতা বিশ্ববিদিত। মধ্যযুগে ইউরোপিয়ানদের নীল সোনা ছিলো চকোলেট, কফি, সিল্কের মতোই মূল্যবান। সারা পৃথিবীতে গহন নীলের অনুসন্ধান পর্ব শুরু হয়ে গেলো। নীলের প্রকৃতি থেকে পাওয়া গুঁড়ো সংগ্রহের জন্য সবাই উঠে পড়ে চেষ্টা শুরু করলেন৷ উৎপাদনের জন্য আশ্চর্য আর জটিল পদ্ধতির রসায়ন নীলকে আরো কাম্য করে তুললো। নীলের সম্মোহনী ক্ষমতা, অভাবিত সৌন্দর্য, মূল্য আর চাহিদার কারণে নীল হয়ে উঠলো নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য এক অতি মূল্যবান পণ্য। বাণিজ্যযুদ্ধে উশকানি যোগালো, ইউরোপিয়ান আর উত্তর আমেরিকান আইন ও রাজনীতির তর্ক শুরু হয়ে গেলো। নীল পরিচিত হলো 'শয়তানের রঙ' বলে। 

আমেরিকায় নীলের লাভ কমে আসায় বাংলার  রাজশাহী অঞ্চলে গ্রামবাসীদের নীল চাষে বাধ্য করা হলো। বলা হয়ে থাকে, ইংল্যান্ডে যাওয়া প্রতিটি নীলের বাক্সে মানুষের রক্ত লেগে আছে। ১৮৫৯ সালে দু বছর ধরে নীল বিদ্রোহ শুরু হলো। অধিক মাত্রায় নীল চাষ বন্ধ হলো এই বিদ্রোহের ফলে। ইন্ডিগোফেরা পাতা নীলের মূল সূত্র। এর উৎপাদন প্রচেষ্টাই একটা সময় পৃথিবীর কলোনিবাজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। ঘানার লোকেরা বলে, 'ওমো আ ওয়া হয়ে ফে নো ইয়ে এনিয়া ওয়ো ওমো 'অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সুন্দর আজো জন্মায়নি। প্রতিটি সংস্কৃতির কাছে রঙের ধারণা আলাদা, সেই ধারণার স্তরবিন্যাস আলাদা। রঙ একটা স্থান হয়ে উঠতে পারে, সে স্থান প্রসারিত হোক বা সংকীর্ণ একটি নাম কিংবা অসংখ্য নাম ধারণ করতে পারে। কোন ধরণের পৃথিবীতে আমরা আছি তার উপরেই এই চিন্তাপ্রবাহ নির্ভর করে। 

আমেরিকায় নীল, লিভাইস জিনস
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজ সান্তা মারিয়ার পাল ছিলো ডেনিমনির্মিত। ঘানার মহিলাদের কাছে বাচ্চা হবার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এক বাক্স ভালো কাপড় থাকা। সেসব কাপড়ের একটা বড় অংশ হতে হবে নীল রঙের। কেন না ঘানায় নীল পোশাক মূল্যবান। প্রত্যেক বিবাহবাসর, প্রত্যেক জন্ম উৎসব, যারা প্রয়াত, চার্চের বিনত সমাবেশ, নতুন প্রেসিডেন্ট মহোদয়দের আগমন – নানা  রকমের উৎসব কিংবা বার্ষিকী, প্রত্যেক ঘটনাতেই বস্ত্র লাগে, বস্ত্রের মৃত্যু নেই। এক  টুকরা থেকে যাওয়া বস্ত্র জীবিতদের কাছে মৃতদের ইতিহাস বলে। নীল, আদি মানুষের দেশ আফ্রিকা থেকে আসা, বস্ত্রের ভাষা। 

ঘানার লোকঐতিহ্যের অংশ আনানসি মাকড়সা। আনানসির ডিজাইনে প্রস্তুত করা ছক সেখানে অনেক জনপ্রিয়। সেই নকশায় যদি নীলের প্রাধান্য বা সামান্য চিহ্ন থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। হারমাটান ( harmattan) হচ্ছে, 'ডাক্তার' - সাহারা থেকে ঠান্ডা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে আসে। সেই সাথে নিয়ে আসে অনন্ত বিস্ময়। প্রাচীন আফ্রিকার লোককথায় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো, হারমাটানের উপস্থিতিতে আকাশ আরো নীল হয়ে ওঠে। তুয়ারেগ মানুষেরা বড়ো এথনিক কনফেডারেশনের অধিবাসী। সাহারা মরুভূমির দক্ষিণপশ্চিম লিবিয়া থেকে দক্ষিণ আলজেরিয়া, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মালি, উত্তর নাইজেরিয়াতেও তুয়ারেগ ভ্রাম্যমাণ চারণদল পাওয়া যায়। তারা মাথার পাগড়ি আর মুখের আবরণে প্রাকৃতিক নীলে ছোপানো বস্ত্র পরিধান করেন৷ সেইজন্য প্রশস্ত মরুভূমির বালিরঙের মধ্যে তাদের রহস্যময় নীল মানুষদের মত দেখায়। উত্তর নাইজেরিয়ার নীল উৎপাদনের কিংবদন্তী কেন্দ্র কানো পঞ্চদশ শতাব্দীতে হাউসা আমিরের মুগ্ধা রমণীর দল প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলো। 

এখন পশ্চিম আফ্রিকার শেষ বড়ো আকারের নীলের কেন্দ্র। কানো নীল মুখের আড়াল বা মাথার পাগড়ির জন্য খুব মূল্যবান৷ পাঁচ মিটার লম্বা গভীর নীলে চোবানো তুলোট বস্ত্র। কাঠের বোর্ডে ছাগলের চর্বি আর নীলের গুঁড়োর মিশ্রণ দিয়ে মাড়ানো হয় যাতে আরো চকচকে হয়ে ওঠে। ট্যাগলমাস্টের (এক ধরণের বস্ত্র) উৎস কানো, সারা দুনিয়ার অল্প যে কয়টি কেন্দ্রে প্রাকৃতিক রঙ উৎপাদনের পুরনো পদ্ধতি টিকে আছে এটি তার একটি। 

ঘানায় নীল, বাদামী, মদরঙ, সবুজ, কালো - বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শোকের রঙ। নীলের গভীর প্রতিসাম্য আছে মৃত্যুর সাথে। নীল সবকিছু ধারণ করে। অনুপস্থিতির অন্ধকার, নীলের অনির্বচনীয় ক্ষমতা প্রতিটি তন্তুতে পৌঁছানোর, প্রতিটি চুলকে স্পর্শ করে, ত্বককে আঁকড়ে ধরে৷ নীলের ছাপা অমোচনীয় ও নিশ্চিত। নীলের দাগ সব সীমান্ত অতিক্রম করে যায়, দেশের বা অনুভূতির। দক্ষিণপশ্চিম নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা গোত্রের প্রধান দেবতা শ্যাংগোর উদ্দেশে একটি প্রশস্তি গীতি গাওয়া হয়: 'শ্যাংগোই হলো মৃত্যু যা বিন্দু বিন্দু ঝরে, যেন নীলের ফোঁটা কাপড় থেকে পড়ে।' নীল আসলে কোনো রঙ নয়। কোনো বস্ত্র নয়। নীল যাকে ধরা যায় না, যা সীমারহিত তাকে ধরা আর সীমিত করে তোলার একটা চেষ্টা মাত্র। সৌন্দর্যকে অধিগত করবার প্রাণান্ত চেষ্টা। অধরাকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা - দুয়ের ভেতরকার ত্বকের এক মসৃণ আবরণ।

প্রাচীন মিশর এবং গ্রেকো রোমান দুনিয়ায় খ্রিস্টের জন্মের দু হাজার বছর আগেই নীল পাওয়া যেতো। 'ইন্ডিগো' গ্রিক 'ইন্ডিকন' অথবা লাতিন 'ইন্ডিকাম' থেকে এসেছে। ইন্ডিকন বা ইন্ডিকনের অর্থ হচ্ছে, ভারতজাত, ভারত থেকে প্রাপ্ত। প্রাগৈতিহাসিক মহেঞ্জোদারোতে নীল পাওয়া যেতো প্রাচীন মিশর আর গ্রেকো রোমানে পাওয়ার সময়কালে। সংস্কৃত শব্দ 'নীলা' অর্থাৎ নীল, গভীর নীল ভারত থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আর প্রাচ্যের সব জায়গায় পাওয়া যেতো। পরবর্তীকালে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে মধ্য থেকে শেষ সপ্তদশ শতকে উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, পতুর্গালে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম ভারতীয় কলোনিগুলো, ইংরেজি আর ফরাসী, স্পেনীয়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নীল প্রধান যোগানদার ছিলো। সপ্তদশ শতকের শেষ দশকে দক্ষিণ ক্যারোলিনায় নীল চাষ শুরু হয়েছিলো কিন্তু তা ব্রিটেনের বাজার চাহিদা মেটাতে পারছিলো না, মানেও ভালো ছিলো না। স্প্যানিশ গুয়াতেমালা অথবা ফরাসি সেইন্ট ডমিনিকেও ভালো ফল পাওয়া গেলো না। সুরাট আর ক্যাম্বেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা মাদ্রাজ আর বোম্বাইতে নীল চাষ করতে চাইলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয় নীলকর সাহেবেরা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী সবার কাছেই বাংলা অঞ্চল সোনার খনি হয়ে উঠলো। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকে মুঘল রাজদরবারের দলিল লেখকেরা, দরবারের দর্শনপ্রার্থী পর্যটকের বিবরণীতে উচ্চ মানের নীলের প্রচুর উল্লেখ আছে। 

৪০ ধরনের নীলের স্যাম্পল। বাংলা, গুয়েতেমালা ও জাভা থেকে আনা,বার্লিন, ১৭৫৬
ইউরোপীয় ট্রেডিং কোম্পানির হিসেব অনুসারে প্রথমে ভারতীয় নীল বর্হিবিশ্বে নিয়ে যায় আর্মেনিয়রা। পরে পতুর্গিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকেরা। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই দক্ষিণ এশিয়া নীলের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিকারক ছিলো। ১৮৫৯ – ১৮৬২ সময়কালে বাংলা অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের কারণে নীল চাষ উত্তর বিহারে সরে গেলো। জার্মান প্রকৃতিবিজ্ঞানী জা ব্যাপটিজ লাবাথ সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রাকৃতিক নীল চাষের খুঁটিনাটি লিখে রাখছিলেন। তাঁর লেখা বিবরণ নীল চাষের জন্য বেপরোয়া সাহেবদের প্রচুর উপকার করেছিলো। ১৮৯৭ সালে জার্মান কোম্পানি বাদিশ্চে অ্যানিলিন আর সোডা ফ্যাব্রিক সিন্থেটিক বা কৃত্রিম নীল বাজারে আনে। এই উদ্ভাবন বিশ্ববাজারে আস্তে আস্তে প্রাকৃতিক নীলের উপযোগিতা কমিয়ে আনে। আরো শ দেড়েক বছর পরে রবিন লিকুইড ব্লু এর বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনে আমাদের কারো হয়তো এতো কথা মনেই থাকবে না।

কপিরাইট
ইজেল টিবিএস
সৈকত দে

ইন্ডিগো ব্লু সম্পর্কিত কিছু তথ্য | Indigo Blue | Denim Dyeing

নীল দুনিয়া
নীল চুলের রঙ আর চোখের সাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরোপে, পশ্চিম আফ্রিকান নারীরা তাঁদের ত্বকে আর চুলে লাগাতেন এই রঙ, সারা শরীর রঙিন করে তুলতেন, শরীরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে ট্যাটু করাতেন এই রঙে৷ মন্দ আত্মাদের তাড়াতে নীল পুড়িয়ে ধূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জীবাণুনাশক, জন্মনিরোধক, গর্ভপাতের কার্যকর ঔষধ, সিফিলিসের আরোগ্যকারী প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নীলের শিকড় শক্তিশালী যৌন উদ্দীপক হিসেবে নিদান দিতেন প্রাচীন কবিরাজরা।

নীল বললেই আমাদের মনে পড়ে মাথার উপরের আকাশ। বিনয় মজুমদারকেও মনে পড়ে –'একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেলো।' বিনয় কবি হলেও বিজ্ঞানী, তিনি জানতেন আকাশের নীল প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিবিভ্রম। সুররসিক ও সুরারসিক উভয়েরই অভিজ্ঞতা আছে, মনের কিংবা বাহ্যিক বস্তুর কারণে আকাশের রঙ বদলে বদলে যেতে। ব্রিটিশ শিল্পী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা ডেরেক জার্মানের শেষ সিনেমা 'ব্লু'-এর কথা মনে পড়তে পারে কারো।

মৃত্যুর অল্প কয়েক মাস আগে তিনি নির্মাণ করেছিলেন তিরানব্বই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি। একটি স্থিত নীল পর্দা আর ভয়েস ওভার, আবহ – এই হলো পুরো নির্মাণ শৈলী। পরিচালক ডেরেক এইডসের কারণে আস্তে আস্তে আংশিক অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। কবিতা আর দিনপঞ্জীর ধরণে সংলাপ, স্মৃতিকাতরতা সব মিলিয়ে এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের অনবদ্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।

ব্রিটিশ শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেরেক জার্মানের শেষ সিনেমা ‘ব্লু’-এর কথা মনে পড়তে পারে কারো।
পর্দায় শুধু নীল আকাশের দৃশ্য কিংবা শুধুই নীল চৌকোন পর্দা। সেখানে কয়েকটা সংলাপ আমরা পড়ে নিতে পারি। 

'নীল হচ্ছে বিশ্বজনীন প্রেম যেখানে পুরুষ স্নান করে নেয়। 'নীল মানুষের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা বদলে দেয়।' 

'ভাইরাস সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমার মৃত কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী ছাড়া কোনো বন্ধু নেই।' 
'আমার রেটিনা এক অন্যতর গ্রহ।' 
'রক্তের সংবেদনের রঙ নীল।'

একই বছর, তিরানব্বই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি সিনেমার কথা মনে না পড়ে পারে না, সিনেমার তন্নিষ্ঠ ভক্তদের। পোলিশ পরিচালক ক্রিস্তফ কিসলোভস্কির থ্রি কালার্স ট্রিলজির প্রথমটি 'ব্লু' এই বছরেই মুক্তি পায়। ফরাসি বিপ্লবের প্রাণমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা – এই তিন শব্দকে নির্ভর করেই ত্রয়ী সিনেমা পর পর মুক্তি পায়। প্রথম সিনেমা ব্লু'তে নামী সুরকার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর জুলিয়েত বিনোশের চরিত্রটি নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। স্বাধীনতা এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্র বিষয়, প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের ইন্টেরিয়রে নীলের ছোঁয়া। নীল কত উষ্ণ হতে পারে আমরা জেনে যাই, সমপ্রেমের সিনেমা 'ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার' দেখবার পর।

নীল কত উষ্ণ হতে পারে আমরা জেনে যাই, সমপ্রেমের সিনেমা ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ দেখবার পর।

কিন্তু আমাদের আজকের আলাপ, ইন্ডিগো বা প্রাকৃতিক নীল চাষ ও তার ছড়িয়ে পড়ার প্রাসঙ্গিক ইতিহাস নিয়ে।   

প্রাচীন ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য - অষ্টম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত - উটবাহিত হয়ে আফ্রিকান বন্দী, সোনা, লবণ আর  আইভরি, উটপাখির পালক এসব বিলাসদ্রব্য মেডিটারেনিয়ান বাণিজ্য কেন্দ্রের দিকে যেত। সেখানে আফ্রিকান, আরব,  এশিয়ান এবং ইউরোপিয়ান বাজারের একত্র সমবায় ছিলো।

পুরো মধ্যযুগ ধরে,  ইতালিয়ানরা এভাবে উত্তর ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলো ব্যবসাটা- টেক্সটাইল উৎপাদনে নীলের মূল্য ছিলো সকল বিচারেই সেরা বলে। শিল্পকলা আর  শিল্পকুশল স্থাপত্যের জন্যে নীল দুষ্প্রাপ্য আর দুর্মূল্য বস্তু৷ আলজেরিয়ান শিল্পী রাচিড করাইচির ভাষায়, 'সুপ্রাটেরেস্ট্রিয়াল - অসীম যাত্রার পথ (supraterrestrial)। খ্রিস্টান, ইসলামী আর  ইহুদী সংস্কৃতিতে এই রঙ ছড়িয়ে পড়ে - প্রাচীন খলিফা, রাজকীয় সভা, গীর্জা আর মসজিদ, স্বর্গের চিহ্ন বোঝাতে। পবিত্র মানুষ বোঝাতে পোশাকের রং হয় নীল। 

প্রাচীন ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য - অষ্টম থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত - উটবাহিত হয়ে আফ্রিকায় পৌঁছে নীল

নীল চুলের রঙ আর চোখের সাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরোপে, পশ্চিম আফ্রিকান নারীরা তাদের ত্বকে আর চুলে লাগাতেন এই রঙ, সারা শরীর রঙিন করে তুলতেন, শরীরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে ট্যাটু করাতেন এই রঙে৷ মন্দ আত্মাদের তাড়াতে নীল পুড়িয়ে ধূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জীবাণুনাশক, জন্মনিরোধক, গর্ভপাতের কার্যকর ঔষধ, সিফিলিসের আরোগ্যকারী প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নীলের শিকড় শক্তিশালী যৌন উদ্দীপক হিসেবে নিদান দিতেন প্রাচীন কবিরাজরা। শমিত করে এই রঙ, এই কারণে শরীরে নীল রঙের ট্যাটু করানো হতো - বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে - নানারকম বাতের ব্যথা থেকে বাঁচতে। নীলের মিশ্রণ চোখের জীবাণুসংক্রমণের ক্ষেত্রে চিকিৎসা উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ 

ক্ষতের উপশম হিসেবে নীলের কার্যকারিতা বিশ্ববিদিত। মধ্যযুগে ইউরোপিয়ানদের নীল সোনা ছিলো চকোলেট, কফি, সিল্কের মতোই মূল্যবান। সারা পৃথিবীতে গহন নীলের অনুসন্ধান পর্ব শুরু হয়ে গেলো। নীলের প্রকৃতি থেকে পাওয়া গুঁড়ো সংগ্রহের জন্য সবাই উঠে পড়ে চেষ্টা শুরু করলেন৷ উৎপাদনের জন্য আশ্চর্য আর জটিল পদ্ধতির রসায়ন নীলকে আরো কাম্য করে তুললো। নীলের সম্মোহনী ক্ষমতা, অভাবিত সৌন্দর্য, মূল্য আর চাহিদার কারণে নীল হয়ে উঠলো নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য এক অতি মূল্যবান পণ্য। বাণিজ্যযুদ্ধে উশকানি যোগালো, ইউরোপিয়ান আর উত্তর আমেরিকান আইন ও রাজনীতির তর্ক শুরু হয়ে গেলো। নীল পরিচিত হলো 'শয়তানের রঙ' বলে। 

আমেরিকায় নীলের লাভ কমে আসায় বাংলার  রাজশাহী অঞ্চলে গ্রামবাসীদের নীল চাষে বাধ্য করা হলো। বলা হয়ে থাকে, ইংল্যান্ডে যাওয়া প্রতিটি নীলের বাক্সে মানুষের রক্ত লেগে আছে। ১৮৫৯ সালে দু বছর ধরে নীল বিদ্রোহ শুরু হলো। অধিক মাত্রায় নীল চাষ বন্ধ হলো এই বিদ্রোহের ফলে। ইন্ডিগোফেরা পাতা নীলের মূল সূত্র। এর উৎপাদন প্রচেষ্টাই একটা সময় পৃথিবীর কলোনিবাজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। ঘানার লোকেরা বলে, 'ওমো আ ওয়া হয়ে ফে নো ইয়ে এনিয়া ওয়ো ওমো 'অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সুন্দর আজো জন্মায়নি। প্রতিটি সংস্কৃতির কাছে রঙের ধারণা আলাদা, সেই ধারণার স্তরবিন্যাস আলাদা। রঙ একটা স্থান হয়ে উঠতে পারে, সে স্থান প্রসারিত হোক বা সংকীর্ণ একটি নাম কিংবা অসংখ্য নাম ধারণ করতে পারে। কোন ধরণের পৃথিবীতে আমরা আছি তার উপরেই এই চিন্তাপ্রবাহ নির্ভর করে। 

আমেরিকায় নীল, লিভাইস জিনস
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজ সান্তা মারিয়ার পাল ছিলো ডেনিমনির্মিত। ঘানার মহিলাদের কাছে বাচ্চা হবার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এক বাক্স ভালো কাপড় থাকা। সেসব কাপড়ের একটা বড় অংশ হতে হবে নীল রঙের। কেন না ঘানায় নীল পোশাক মূল্যবান। প্রত্যেক বিবাহবাসর, প্রত্যেক জন্ম উৎসব, যারা প্রয়াত, চার্চের বিনত সমাবেশ, নতুন প্রেসিডেন্ট মহোদয়দের আগমন – নানা  রকমের উৎসব কিংবা বার্ষিকী, প্রত্যেক ঘটনাতেই বস্ত্র লাগে, বস্ত্রের মৃত্যু নেই। এক  টুকরা থেকে যাওয়া বস্ত্র জীবিতদের কাছে মৃতদের ইতিহাস বলে। নীল, আদি মানুষের দেশ আফ্রিকা থেকে আসা, বস্ত্রের ভাষা। 

ঘানার লোকঐতিহ্যের অংশ আনানসি মাকড়সা। আনানসির ডিজাইনে প্রস্তুত করা ছক সেখানে অনেক জনপ্রিয়। সেই নকশায় যদি নীলের প্রাধান্য বা সামান্য চিহ্ন থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। হারমাটান ( harmattan) হচ্ছে, 'ডাক্তার' - সাহারা থেকে ঠান্ডা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে আসে। সেই সাথে নিয়ে আসে অনন্ত বিস্ময়। প্রাচীন আফ্রিকার লোককথায় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো, হারমাটানের উপস্থিতিতে আকাশ আরো নীল হয়ে ওঠে। তুয়ারেগ মানুষেরা বড়ো এথনিক কনফেডারেশনের অধিবাসী। সাহারা মরুভূমির দক্ষিণপশ্চিম লিবিয়া থেকে দক্ষিণ আলজেরিয়া, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মালি, উত্তর নাইজেরিয়াতেও তুয়ারেগ ভ্রাম্যমাণ চারণদল পাওয়া যায়। তারা মাথার পাগড়ি আর মুখের আবরণে প্রাকৃতিক নীলে ছোপানো বস্ত্র পরিধান করেন৷ সেইজন্য প্রশস্ত মরুভূমির বালিরঙের মধ্যে তাদের রহস্যময় নীল মানুষদের মত দেখায়। উত্তর নাইজেরিয়ার নীল উৎপাদনের কিংবদন্তী কেন্দ্র কানো পঞ্চদশ শতাব্দীতে হাউসা আমিরের মুগ্ধা রমণীর দল প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলো। 

এখন পশ্চিম আফ্রিকার শেষ বড়ো আকারের নীলের কেন্দ্র। কানো নীল মুখের আড়াল বা মাথার পাগড়ির জন্য খুব মূল্যবান৷ পাঁচ মিটার লম্বা গভীর নীলে চোবানো তুলোট বস্ত্র। কাঠের বোর্ডে ছাগলের চর্বি আর নীলের গুঁড়োর মিশ্রণ দিয়ে মাড়ানো হয় যাতে আরো চকচকে হয়ে ওঠে। ট্যাগলমাস্টের (এক ধরণের বস্ত্র) উৎস কানো, সারা দুনিয়ার অল্প যে কয়টি কেন্দ্রে প্রাকৃতিক রঙ উৎপাদনের পুরনো পদ্ধতি টিকে আছে এটি তার একটি। 

ঘানায় নীল, বাদামী, মদরঙ, সবুজ, কালো - বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শোকের রঙ। নীলের গভীর প্রতিসাম্য আছে মৃত্যুর সাথে। নীল সবকিছু ধারণ করে। অনুপস্থিতির অন্ধকার, নীলের অনির্বচনীয় ক্ষমতা প্রতিটি তন্তুতে পৌঁছানোর, প্রতিটি চুলকে স্পর্শ করে, ত্বককে আঁকড়ে ধরে৷ নীলের ছাপা অমোচনীয় ও নিশ্চিত। নীলের দাগ সব সীমান্ত অতিক্রম করে যায়, দেশের বা অনুভূতির। দক্ষিণপশ্চিম নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা গোত্রের প্রধান দেবতা শ্যাংগোর উদ্দেশে একটি প্রশস্তি গীতি গাওয়া হয়: 'শ্যাংগোই হলো মৃত্যু যা বিন্দু বিন্দু ঝরে, যেন নীলের ফোঁটা কাপড় থেকে পড়ে।' নীল আসলে কোনো রঙ নয়। কোনো বস্ত্র নয়। নীল যাকে ধরা যায় না, যা সীমারহিত তাকে ধরা আর সীমিত করে তোলার একটা চেষ্টা মাত্র। সৌন্দর্যকে অধিগত করবার প্রাণান্ত চেষ্টা। অধরাকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা - দুয়ের ভেতরকার ত্বকের এক মসৃণ আবরণ।

প্রাচীন মিশর এবং গ্রেকো রোমান দুনিয়ায় খ্রিস্টের জন্মের দু হাজার বছর আগেই নীল পাওয়া যেতো। 'ইন্ডিগো' গ্রিক 'ইন্ডিকন' অথবা লাতিন 'ইন্ডিকাম' থেকে এসেছে। ইন্ডিকন বা ইন্ডিকনের অর্থ হচ্ছে, ভারতজাত, ভারত থেকে প্রাপ্ত। প্রাগৈতিহাসিক মহেঞ্জোদারোতে নীল পাওয়া যেতো প্রাচীন মিশর আর গ্রেকো রোমানে পাওয়ার সময়কালে। সংস্কৃত শব্দ 'নীলা' অর্থাৎ নীল, গভীর নীল ভারত থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আর প্রাচ্যের সব জায়গায় পাওয়া যেতো। পরবর্তীকালে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে মধ্য থেকে শেষ সপ্তদশ শতকে উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, পতুর্গালে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম ভারতীয় কলোনিগুলো, ইংরেজি আর ফরাসী, স্পেনীয়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নীল প্রধান যোগানদার ছিলো। সপ্তদশ শতকের শেষ দশকে দক্ষিণ ক্যারোলিনায় নীল চাষ শুরু হয়েছিলো কিন্তু তা ব্রিটেনের বাজার চাহিদা মেটাতে পারছিলো না, মানেও ভালো ছিলো না। স্প্যানিশ গুয়াতেমালা অথবা ফরাসি সেইন্ট ডমিনিকেও ভালো ফল পাওয়া গেলো না। সুরাট আর ক্যাম্বেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা মাদ্রাজ আর বোম্বাইতে নীল চাষ করতে চাইলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয় নীলকর সাহেবেরা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী সবার কাছেই বাংলা অঞ্চল সোনার খনি হয়ে উঠলো। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকে মুঘল রাজদরবারের দলিল লেখকেরা, দরবারের দর্শনপ্রার্থী পর্যটকের বিবরণীতে উচ্চ মানের নীলের প্রচুর উল্লেখ আছে। 

৪০ ধরনের নীলের স্যাম্পল। বাংলা, গুয়েতেমালা ও জাভা থেকে আনা,বার্লিন, ১৭৫৬
ইউরোপীয় ট্রেডিং কোম্পানির হিসেব অনুসারে প্রথমে ভারতীয় নীল বর্হিবিশ্বে নিয়ে যায় আর্মেনিয়রা। পরে পতুর্গিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকেরা। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই দক্ষিণ এশিয়া নীলের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিকারক ছিলো। ১৮৫৯ – ১৮৬২ সময়কালে বাংলা অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের কারণে নীল চাষ উত্তর বিহারে সরে গেলো। জার্মান প্রকৃতিবিজ্ঞানী জা ব্যাপটিজ লাবাথ সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রাকৃতিক নীল চাষের খুঁটিনাটি লিখে রাখছিলেন। তাঁর লেখা বিবরণ নীল চাষের জন্য বেপরোয়া সাহেবদের প্রচুর উপকার করেছিলো। ১৮৯৭ সালে জার্মান কোম্পানি বাদিশ্চে অ্যানিলিন আর সোডা ফ্যাব্রিক সিন্থেটিক বা কৃত্রিম নীল বাজারে আনে। এই উদ্ভাবন বিশ্ববাজারে আস্তে আস্তে প্রাকৃতিক নীলের উপযোগিতা কমিয়ে আনে। আরো শ দেড়েক বছর পরে রবিন লিকুইড ব্লু এর বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনে আমাদের কারো হয়তো এতো কথা মনেই থাকবে না।

কপিরাইট
ইজেল টিবিএস
সৈকত দে

কোন মন্তব্য নেই: