নীলের উৎপত্তি কোথায় ?
এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে গেলে ফিরে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর। পাড়ি জমাতে হবে এক সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আরেক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে। ঘুরতে হবে ব্রোঞ্জ যুগের কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে চীনা রাজশাসনের প্রাথমিক ভাগে, কিংবা মধ্যযুগীয় ভেনিস থেকে আধুনিক মাগরিবে (ইসলামিক উত্তর আফ্রিকা)। পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় আগে নীল নদের অববাহিকায়। মিশরীয় রসায়নবিদদের হাত ধরে আকাশের নীল নেমে আসে মর্ত্যমান পৃথিবীতে। ২০১৫ সালে এক জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের পছন্দের রঙ ছিল নীল। এই প্রিয় নীলের মূল নেওয়া হয়েছে টম ভার্ডের কোয়েস্ট ফর ব্লু রচনা থেকে।
খুবই সহজ নীলকে প্রকৃতিজুড়ে ব্যাপ্ত একটি বর্ণ ভেবে নেয়া। মনে হতে পারে, আমাদের চারদিকে তো নীলের ছড়াছড়ি। কেননা চোখ মেলে তাকালেই আমরা পরিষ্কার আকাশ কিংবা জলের গায়ে নীলের দেখা পাই। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, অন্যান্য জায়গায় নীলের উপস্থিতি অনিয়মিত। গুটিকয়েক ধাতু এবং দশ শতাংশেরও কম ফুলেল উদ্ভিদে নীলের অস্তিত্ব রয়েছে। এমনকী নীলকণ্ঠ থেকে শুরু করে ব্লু-বার্ড, কোনো পাখির পালকই সত্যিকারের নীল নয়। আমরা যে সেগুলোকে নীল দেখি, তা কেবলই জৈবিক কারণে উদ্ভূত চোখের বিভ্রম। ইতিহাসের অধিকাংশ সময়েই প্রাকৃতিক জগতে ছিল নীলের ঘাটতি, ফলে নীলের পুনরুৎপাদনও খুবই দুরূহ একটি ব্যাপার।
"অন্যান্য বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক উপাদান হতে, যা হয়তো পরে প্রক্রিয়াজাত হয়েছে। কিন্তু একটি রঞ্জক পদার্থ হিসেবে নীলের অস্তিত্ব প্রাকৃতিকভাবে ছিল না, বরং এটিকে তৈরি করে নিতে হয়েছে," বলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্ক পোলার্ড।
আদিমযুগের মানুষ লাল বা হলুদ মাটি কিংবা সাদা খড়ি হাতে নিয়ে সেগুলোকে প্রায় ক্রেয়নের মতো ব্যবহার করতে পারত। তাছাড়া প্রায় সবধরনের পোড়া কাঠির শেষভাগেই মিলত কালো বর্ণ। কিন্তু পোলার্ডের ব্যাখ্যা মতে, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানকে নীলে রূপান্তর সহজসাধ্য বিষয় ছিল না। এর পেছনে ঢালতে হতো প্রভূত পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তি।
এই রূপান্তরের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গেলে ফিরে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর। পাড়ি জমাতে হবে এক সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আরেক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে। ঘুরতে হবে ব্রোঞ্জ যুগের কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে চীনা রাজশাসনের প্রাথমিক ভাগে, কিংবা মধ্যযুগীয় ভেনিস থেকে আধুনিক মাগরিবে (ইসলামিক উত্তর আফ্রিকা)।
এক্ষেত্রে প্রথম সফলতা আসে পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় পূর্বে, নীল নদের অববাহিকায়। মিশরীয় রসায়নবিদদের হাত ধরে আকাশের নীল নেমে আসে মর্ত্যমান পৃথিবীতে।
প্রাচীন মিশরে স্বর্গের রঙ নীল। রাশির বিভিন্ন চিন্হ সম্বলিত এই চিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে মিশরের হাথর মন্দিরে ।
প্রথম নীল
"মাঠকে দেয়া হয়েছে সৃষ্টির দায়িত্ব, মাঠকে বানানো হয়েছে নীল, পৃথিবীর সবকিছুরই কাজ হলো নতুন কিছুর সৃষ্টি," এদফুতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর হোরাস মন্দির থেকে প্রাপ্ত এক হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে পাওয়া গেছে এই কথাগুলো। এর মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে, কীভাবে নীল নদের দুকূল প্লাবিত বাৎসরিক বানের জলে পরিপুষ্ট হয়ে উঠত ফসলি জমি।
ইউনিভার্সিটি অভ মেম্ফিসের মিশরীয় শিল্প ও প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক এবং এদফু লিপির অনুবাদক, লরেলেই করকোরানের মতে, নীল একাধারে অনুপ্রেরণাদায়ক ও পূজনীয়, এছাড়াও সে মহাজগত, উর্বরতা, পুষ্টি ও পুনর্জন্মের রঙ। করকোরান আরো ব্যাখ্যা করেন, আকাশ ও সূর্যের মধ্যে যে ঝিকিমিকি আলোর খেলা চলে, তা থেকে জীবনের ঔজ্জ্বল্যই মূর্ত হয়ে ওঠে।
"নীল এমন কোনো রঙ নয় যেটির সাথে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে সূর্যের সম্পর্ক ভেবে বের করতে পারবে। এক্ষেত্রে আমরা সাধারণত হলুদ বা লালের কথা ভাবি," তিনি বলেন। "কিন্তু আপনি যদি প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের মাথার পাগড়ির কথা চিন্তা করেন, কিংবা উদাহরণস্বরূপ তাকান তুতানখামেনের মুখোশের দিকে, দেখতে পাবেন এটি নির্মিত হয়েছে নীল ও সোনালী স্ট্রাইপ থেকে, এবং ভাবা হয়ে থাকে যে এটি প্রতিনিধিত্ব করছে সূর্যের সেই রশ্মির, যা স্বর্গ ভেদ করে যায়।"
লিপিতে উচ্চারণ অনুযায়ী নীলের মিশরীয় যে নাম ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো 'hsbd iryt'. এর অর্থ 'কৃত্রিম ল্যাপিস লাজুলি বা রাজপট্ট' (গাঢ় নীল রঙের পাথর বিশেষ)। এমন নাম থেকেই বোঝা যায় আজকের আধামূল্যবান রত্নপাথরটিকে তখনকার দিনে কতটা উঁচুদরে মূল্যায়ন করা হতো। কোবাল্ট, অজুরিতে, টারকোয়েজ ও ইন্ডিগোর পাশাপাশি এই ল্যাপিস লাজুলিই ছিল নীল বর্ণের কাঁচামাল, যা তৎকালীন মিশরীয় কারিগররা রঞ্জক, মাদুলি, পুঁতি, গহনা, স্কারাব, ভাস্কর্য ও কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করত।
তবে, এসব কাঁচামালের কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধতাও ছিল।
ল্যাপিস লাজুলি ছিল দুর্লভ এবং যারপরনাই দামি। কেবল উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের একটি উপত্যকা থেকেই উত্তোলিত হতো এটি। মিশরে এসে পৌঁছাতে লেগে যেত পাক্কা তিন বছর। কোবাল্ট পাওয়া যেত মিশরের সবচেয়ে নিকটবর্তী পশ্চিমা মরুভূমিতে, তাই এটি খুবই কার্যকর ছিল কাঁচ তৈরিতে। আমারনা যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৬৫-১৩৪৫) অল্প কিছু সময়ের জন্য এটি কাজে লেগেছে মৃৎশিল্প সাজানোতেও। অজুরিতে পাওয়া যেত সিনাই উপদ্বীপ এবং মিশরের পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমিতে। কিন্তু এটি খোদাই করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, এবং এ থেকে যে রঞ্জক উৎপন্ন হতো তাতে নীলের চেয়ে সবুজের মাত্রাই থাকত বেশি। টারকোয়েজও পাওয়া যেত সিনাইয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে, কিন্তু এটিও ছিল দুর্লভ ও দামি। এদিকে ইন্ডিগো বা নীল গাছ নিয়ে আসতে হতো সেই সুদূর ভারতবর্ষ থেকে। (বোঝার সুবিধার্থে, লেখার পরবর্তী অংশে আমরা নীল গাছকে প্রধানত ইন্ডিগো হিসেবেই লিখব।)
লাপিস লাজুলি
তাই মিশরীয়দের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এমন কোনো নীল তৈরি করা, যেটি সস্তা ও সুলভ। এবং সেই চ্যালেঞ্জের প্রত্যুত্তর হিসেবেই তারা আবিষ্কার করে বসে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিম রঞ্জক : মিশরীয় নীল।
রাসায়নিকভাবে রেসিপিটির পরিচয় হলো ক্যালসিয়াল কপার সিলিকেট, যেখানে খড়ি বা চুনাপাথরের সাথে মিশ্রণ ঘটাতে হতো একটি কপার-সমৃদ্ধ খনিজ পদার্থ (হতে পারে সেটি মালাকাইট), এবং তার সঙ্গে আবার সিলিকা-সমৃদ্ধ বালু ও একটি ক্ষার ধাতু, সবকিছুকে একত্রে দ্রবীভূত করতে। উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ানোর ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি হতো একটি নীল, অস্বচ্ছ, কাঁচ-সদৃশ যৌগিক সিরামিক। যখন সেটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হতো, এবং সঙ্গে মেশানো হতো তেলের মতো কোনো একটি বন্ধনী, তখন এ থেকে জন্ম নিত স্থায়ী রঞ্জক; তীব্রতায় যেটিকে আলাদা করা যেত গভীর, দামি ল্যাপিস-সদৃশ শেড থেকে আরো হালকা, প্যাস্টেলের মতো রঙে। তবে এই সবকিছুই প্রধানত নির্ভর করত জিনিসটি কতটা ভালোভাবে গুঁড়ো করা হয়েছে তার উপর।
করকোরানের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, মিশরীয় নীলের অভিষেক ঘটেছে ফারাও আমলের সূচনাকালে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০ অব্দের দিকে। নিজেদের ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে মিশরীয়রা এই নীলের প্রয়োগ ঘটাতে পারত দেয়াল থেকে শুরু করে মন্দির ও সমাধিক্ষেত্রের ছাদ কিংবা শবযাত্রার মুখোশ তৈরিতে এবং রঙিন হায়ারোগ্লিফিক লিপি অঙ্কনে।
মিশরীয় সিরামিস্টরা আরো একটি ব্যাপার উদ্ঘাটন করেছিল যে একই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে স্ব-প্ললিপ্ত, অসাধারণ ঝকঝকে নীলও তৈরি করা সম্ভব ছিল। এক্ষেত্রে শুধু পোড়ানোর দরকার পড়ত সিলিকার (বালু বা চূর্ণকৃত কোয়ার্টজ) সাথে স্বল্প পরিমাণ সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পানির সংমিশ্রণ। (অনেক গবেষকই অবশ্য ধারণা করেন যে এই কৌশলটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দেই মেসোপটেমীয়রা আবিষ্কার করেছিল, এবং তাদের কাছ থেকেই মিশরীয়রা এ জ্ঞান লাভ করেছিল।)
মূল মণ্ডের নরম সংমিশ্রণের কারণে এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ভালোভাবে তৈরি করা যেত ফাইয়েন্স (এক ধরনের প্রাক-কাঁচ উপাদান)। এবং সেই ফাইয়েন্স দিয়ে তৈরি করা যেত ছোট ছোট গহনা ও আলঙ্কারিক বস্তু। এই বিষম কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া সত্ত্বেও যে নীল তৈরিতে মিশরীয়রা পিছপা হতো না, এ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে নীলের প্রতি তাদের আসক্তি ঠিক কতটা ছিল। একই সাথে নীল তৈরির জন্য কী কঠিন অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ত, তারও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ এটি।
অ্যামি ওয়ালার একজন মৃৎশিল্পী। প্রাচীন মিশরীয় কৌশল অনুকরণে তিনি বেকারসভিল, নর্থ ক্যারোলিনায় নিজের স্টুডিওতে বসে তৈরি করেন ফাইয়েন্সের বিভিন্ন আধুনিক সংস্করণ। তিনি বলেন, "মাত্র শত বছরের মতো হলো যে আমরা বুঝতে পেরেছি ফাইয়েন্স আসলে কীভাবে তৈরি হতো।"
খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে মিশরীয় নীলের রেসিপি ছড়িয়ে পড়ে মেসোপটেমিয়া থেকে এজিয়ান অঞ্চলে। গ্রিকরা এটির নাম দেয় 'কায়ানোস', যেখান থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ 'সায়ান' (নীল সবুজ)। এই রঞ্জকের অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেছে পার্থাননেও, যেটি গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে। রোমানদের কাছে এটির পরিচয় ছিল 'সেরুলিয়াস' (ইংরেজিতে 'সেরুলিয়ান', অর্থাৎ গাঢ় নীল)। এর মাধ্যমে তারা নির্দেশ করত আকাশি-নীল বর্ণকে, যেটি সামর্থ্যবানদের ভিলায় ব্যবহারের প্রিয় রঙ।
এক রোমান ব্যক্তিই কিন্তু মিশরীয় নীল তৈরির জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে গেছেন। সমর প্রকৌশলী ও স্থপতি ভিট্রুভিয়াস তার বিখ্যাত 'ডি আর্কিটেকচুরা' গ্রন্থে বিশদে লিখেছেন রঙটি প্রস্তুত করতে কী কী উপাদান প্রয়োজন, এবং কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
যদিও কেউ কেউ বলে যে রোমানদের সাথে সাথেই মিশরীয় নীলের বিলুপ্তি ঘটেছে, কিন্তু অনেক শিল্প বিষয়ক ইতিহাসবিদই এই রঞ্জকের অস্তিত্ব শনাক্ত করেছেন উত্তর ইতালি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যযুগীয় চার্চ ও অ্যাবের দেয়াল ও মূর্তিতে। ২০১১ সালে বেলজিয়ান ও ডেনিশ একটি গবেষক দল উচ্চ প্রযুক্তির অপটিক্যাল যন্ত্র ব্যবহার করে মিশরীয় নীলের ব্যবহার আবিষ্কার করেছে রেনেসাঁ যুগের শিল্পী জিওভান্নি বাত্তিস্তা বেনভেনুতোর ১৫২৪ সালে অঙ্কিত খ্রিস্টান সেইন্ট মার্গারেটের ছবিতে।
গবেষক দলটির বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে মার্গারেটের আলখাল্লায় মিশরীয় নীলের সাথে মিশে থাকা আরেকটি নীলের অস্তিত্ব। সেটি হলো আল্ট্রামেরিন, এক ধরনের গাঢ় নীল রঞ্জক যা তৈরি হয় ল্যাপিস লাজুলি থেকে। কেন বেনভেনুতো দুইটি ভিন্ন রঙকে একসাথে মিশিয়েছিলেন, তা নিশ্চিত নয়। তিনি কি নির্দিষ্ট কোনো শেড তৈরি করতে চাচ্ছিলেন? নাকি তিনি চাচ্ছিলেন তার কাছে মজুদ থাকা আল্ট্রামেরিনের জোগানকে যথাসম্ভব বর্ধিত করতে, কেননা এটিই ছিল তৎকালীন সবচেয়ে দামি, দুর্লভ ও বিখ্যাত রঞ্জক?
যে রঙ এসেছে সাগরের ওপার থেকে
বেনভেনুতো যদি আসলেই আল্ট্রামেরিনের ব্যাপারে অতিহিসেবি হয়ে থাকেন, তবে তার পেছনে যথোপযুক্ত কারণও রয়েছে। আল্ট্রামেরিনের দাম ছিল আকাশচুম্বি। সমসাময়িক শিল্পী আলব্রেখট ড্যুরার ১৫০৮ সালে বলেছিলেন, মাত্র এক পাউন্ডের জন্যই নাকি তখন গুনতে হতো ১০০ ফ্লোরিন (আজকের দিনে এক আউন্সের জন্য ২২৮ মার্কিন ডলারের সমান)। এর কয়েক বছর আগে মাইকেলেঞ্জেলোও একটি ছবির কাজ অসম্পূর্ণ রেখে দেন, যেটি আর কখনোই শেষ করা হয়নি; স্রেফ এ কারণে যে তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে আল্ট্রামেরিন ছিল না। ১৬৭৫ সালে ডাচ চিত্রশিল্পী ইউহান ফারমির কপর্দকশূন্য অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তার এমন দুরবস্থার অন্যতম কারণ, নিজের বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো যেমন 'গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়াররিং' এবং 'উওম্যান ইন ব্লু রিডিং এ লেটার' ইত্যাদিতে তিনি আল্ট্রামেরিনের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিলেন।
আলট্রামেরিন একসময়ের মূল্যবান রঙ। আলট্রামেরিন আর সোনার জলে লেখা পাতা
আল্ট্রামেরিনের উচ্চমূল্যের কারণ হলো, ফারাওদের আমলে মিশরে যেমন সহজেই ল্যাপিস লাজুলি পাওয়া যেত, বেনভেনুতো কিংবা ফারমিরদের আমলে তা যেত না। তখনো এটি আসত কেবল একটি উৎস থেকেই: আফগানিস্তানের সার-ই-সাং উপত্যকা। এবং সেখানে সেই খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দ তথা ব্রোঞ্জ যুগ থেকে তখন পর্যন্ত রত্নপাথরটি উত্তোলনের পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। পদ্ধতিটি হলো: আগুনের সাহায্যে খনির সুড়ঙ্গে তাপ প্রয়োগ করা, এবং তারপর বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি দিয়ে পুনরায় সেখানের তাপ কমিয়ে ফেলা, যাতে করে রত্নপাথরটি বের করে আনার মতো ফাঁক বা গহ্বর সৃষ্টি হয়। (বর্তমানে অবশ্য খনিতে ডায়নামাইট ব্যবহৃত হয়। তারপরও সুড়ঙ্গের দেয়ালে শত বছরের পুরনো আগুনের চিহ্ন আজো চোখে পড়ে। এদিকে ল্যাপিস এখন বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেলেও, গুণে-মানে কিংবা প্রাচুর্যে তারা আফগানিস্তানের ওই খনির তুলনায় নেহাতই নস্যি।)
রত্নপাথরটির নামের প্রথমাংশ এসেছে লাতিন 'ল্যাপিস' (পাথর) থেকে। আর 'লাজুলাম' এসেছে আরবি 'গিজর আল-লাজাওয়ার্দ' (আকাশি-নীলের শিকড়) থেকে। তবে আরবি শব্দটি নিজেও ধার করেছে ফারসি 'লাজভার্দ' নামক খনিজ থেকে। তবে এ থেকে উৎপন্ন রঞ্জকটি চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ইতালিয়ান এবং অন্যান্য চিত্রশিল্পী ও বণিকদের কাছে যে নামে পরিচিত হয়েছে, তা এসেছে এর সুদূরবর্তী উৎস থেকে : 'আল্ট্রামেরিনাস', অর্থাৎ 'সাগরের ওপার'।
ইতালিয়ান কারিগর চেন্নিনো চেন্নিনি তার 'ইল লিব্রো দেল্ল'আর্তে' (দ্য ক্র্যাফটম্যান'স হ্যান্ডবুক, ১৩৯০) বইয়ে লিখেছেন, "আল্ট্রামেরিন নীল হলো অত্যুজ্জ্বল, অনিন্দ্য সুন্দর, সবচেয়ে নিখুঁত একটি রঙ, যা আর সব রঙকে হার মানায়।" এ বইয়ে চেন্নিনি আল্ট্রামেরিন এত মূল্যবান হবার নেপথ্যের আরেকটি কারণও বিশদে ব্যাখ্যা করে গেছেন—এর উৎপাদন প্রক্রিয়া।
রত্নপাথরটিকে গুঁড়ো করার মাধ্যমে শুরু হতো লজুরিতে নামক নীলরঙা খনিজটিকে এর আশেপাশের উপাদান থেকে পৃথকীকরণের কাজ। এরপর সেই গুঁড়োকে রজনের সাথে মিশিয়ে একটি নরম মণ্ড তৈরি করা হতো। মণ্ডটিকে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নরম আঠালো বস্তুতে পরিণত করে, ক্ষারীয় দ্রবণে ভিজিয়ে রাখা হতো। ফলাফলস্বরূপ কয়েকদিন পর পাত্রের তলদেশে জমা হতো সামান্য পরিমাণে বেগুনি প্রান্ত বিশিষ্ট উজ্জ্বল নীল রঞ্জক পদার্থ।
পশ্চিমা ইউরোপে আগমনের পূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে একটি রঞ্জক হিসেবে ল্যাপিসের দৃষ্টান্ত দেখা যেত এখানে-সেখানে। যেমন খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকের এক মিশরীয় রানির মূর্তি কিংবা খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের মাইসেনিয়ান গ্রিসের একটি দেয়ালের পলেস্তারার খণ্ডিতাংশে। চতুর্থ থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দে এটিকে দেখা গেছে কেন্দ্রীয় এশিয়ায়, সিল্ক রোডের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গুহাচিত্রে, পশ্চিমা চীনের টার্কিস অংশে, এবং আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকার সদ্য ধ্বংসকৃত, ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের বুদ্ধমূর্তির পোশাক ও দেয়ালচিত্রে।
চেন্নিনি বর্ণিত রেসিপিটিই আল্ট্রামেরিনের সবচেয়ে পুরনো ইউরোপীয় রেসিপি বটে। তবে এরও কিছুকাল পূর্বে, খ্রিস্টাব্দ নবম শতকে, 'রসায়নের জনক' জাবির ইবনে হাইয়ান রচিত একটি আরবি গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ল্যাপিসকে বিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া যে মধ্য ও নিকট প্রাচ্যে অবিদিত ছিল না, তার আরো একটি লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় মধ্য-ত্রয়োদশ শতকের একটি ভূতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থে। বারবার পণ্ডিত আহমাদ আল-তিফাশি রচিত গ্রন্থটির নাম 'আজহার আল-আফকার ফি জওয়াহির আল-আদজার' (বেস্ট থটস অন দ্য বেস্ট অভ স্টোনস)। ল্যাপিস বিষয়ক অধ্যায়ে আল-তিফাশি পরামর্শ দেন ল্যাপিসের গুঁড়োকে রজনের সাথে ময়দার তালে মেশাতে, এবং শীতকালে সেটিকে ক্রমাগত নাড়িয়ে যেতে, "যতক্ষণ না সেটির সারাংশ বেরিয়ে আসে"।
ওই একই সময়ে, জর্জিয়ায় জন্মগ্রহণ করা হোবায়েস তেফলিসিও ল্যাপিস থেকে রঞ্জক উৎপন্নের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন তার 'বয়ান আল-শেনা'আত' গ্রন্থে, যেখানে রসায়ন, গহনা এবং স্ফটিক ও কাঁচে রঙ করার বিভিন্ন ব্যাবহারিক তথ্য সন্নিবেশিত ছিল।
আরব রসায়নবিদরা অবশ্য বেশি আগ্রহী ছিলেন মাটিতে প্রাপ্ত ল্যাপিসের ঔষধি গুণাগুণের ব্যাপারে। তারা এটি সেবনের পরামর্শ দিতেন বুক ধড়ফড়ানি এবং বিষাদময়তার ওষুধ হিসেবে। তাছাড়া লেখার কালি তৈরিতেও তারা এটি ব্যবহার করতেন। পারস্যসহ বিভিন্ন দেশের চিত্রকর ও গ্রন্থ আলঙ্কারিকরা আল্ট্রামেরিন ব্যবহার করতেন লিপিকে সাজিয়ে তুলতে। এমনকী রাজকোষ থেকে অনুমোদিত 'শাহনামা' গ্রন্থের কয়েকটি সংস্করণেও ব্যবহৃত হয়েছিল এটি।
এসব প্রমাণই শিল্প ইতিহাসবিদ, 'দ্যা ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড টেকনিকস অভ মেডিয়েভাল পেইন্টিং' (ডোভার, ১৯৫৬)-এর লেখক ড্যানিয়েল ভি টমসনকে উদ্বুদ্ধ করে এমন আন্দাজ করতে যে, ল্যাপিসকে রঞ্জকে রূপান্তরের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়তো ছিল মুরীয় উদ্ভাবনী শক্তির ফসল। সেই সঙ্গে তিনি আরো ভাবেন, ত্রয়োদশ শতকের আগেই হয়তো কোনো এক আরব উৎস থেকে ইউরোপ পেয়েছিল তাদের আল্ট্রামেরিন অজুরের সন্ধান।
তবে সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, উচ্চমূল্যের কারণে ইউরোপ এটি খুব বেশি পরিমাণে গ্রহণ করতে পারেনি। সন্ন্যাসীরা তাদের পবিত্র বাণী লিপিবদ্ধ করতে এটি ব্যবহার করতেন। আবার ইউরোপীয় রাজা ও যুবরাজরাও, পারস্যের রাজা ও যুবরাজদের মতো, প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতেন এই রঞ্জক ব্যবহার করে বইয়ের অলঙ্করণ করতে। পঞ্চদশ শতকের 'ট্রেস রিচেস হেউরেস দু ডুক দি বেরি' (দ্য ভেরি রিচ আওয়ার্স অভ দ্য ডিউক অভ বেরি) বইটি তেমনই এক নিদর্শন।
অত্যাধিক মূল্য এবং রাজ-রাজড়াদের মাত্রারিক্ত আসক্তির ফলে, আল্ট্রামেরিনের সম্মান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তাই খ্রিস্টান শিল্পীরা মধ্যযুগীয় ও রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে, যীশুখ্রিস্টের মা তথা মাতা মেরির পোশাকে এই রঙ ব্যবহার করতে থাকেন। কেননা এই রঙ ব্যবহারের ফলে মাতা মেরির মর্যাদাকেও বাড়িয়ে তোলা যেত। ওই সময়কার অনেক শিল্পীরই তাদের পৃষ্ঠপোষকের সাথে চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকত যে আল্ট্রামেরিন সংগ্রহের জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হবে। আবার কেউ কেউ তো বাড়তি ভ্রমণ খরচও চেয়ে বসতেন, যেন তারা সরাসরি ভেনিস গিয়ে আল্ট্রামেরিন সংগ্রহ করতে পারেন।
উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে, ইউরোপীয় রসায়নবিদরা চেষ্টা করেন তাদের ফারাও যুগের মিশরীয় পূর্বসূরীদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে। চীনামাটি, সোডা, কাঠকয়লা, কোয়ার্টজ ও সালফার মিশিয়ে তারা সুলভ মূল্যের, কৃত্রিম আল্ট্রামেরিন উৎপাদন করেন। অনেক নাকউঁচু শিল্পীই অভিযোগ করেন যে এই নকল রঙে সত্যিকারের আল্ট্রামেরিনের গভীরতা নেই। তবে তারা এ কথাও অস্বীকার করতে পারেন না যে এই কৃত্রিম রঙের মূল্য ল্যাপিস লাজুলি থেকে উৎপন্ন প্রকৃত আল্ট্রামেরিনের চেয়ে ২,৫০০ গুণ কম। এদিকে, নীলের ব্যবসা একটি বড় ভূমিকা পালন করে এর ব্যবহার, সংগ্রহ পদ্ধতি ও সম্মানের পেছনে। এবং ইতোমধ্যে, কোবাল্টের কল্যাণে, নীলের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসার একটিতে পরিণত হয় পোরসেলিন বা চীনামাটির বাসন।
নীলের দেখা সাদার সঙ্গে
পঞ্চদশ শতকের পোরসেলিন পাত্রের গুণাগুণ মিং সাম্রাজ্যের সিরামিক বিষয়ক ক্যাটালগে তালিকাভুক্ত করেন ষোড়শ শতকের শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার জিয়ান ইউয়ানপিয়ান। তিনি মন্তব্য করেন, "সমন্বিত স্বচ্ছ সাদার চকচকানি অনেকটাই যেন খাসির মাংসের চর্বি কিংবা সুদৃশ্য জেড পাথরের মতো। আর মুসলিম নীল দিয়ে অঙ্কিত রঙটি এতটাই বিশুদ্ধ ও অসাধারণ যে তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।"
পনের শতকের একটি চিত্রকর্ম। আফগানিস্তানের হেরাতে একজ তরুণ লাপিস লাজুলি পাথর সংগ্রহ করছে
তথাকথিত 'মুসলিম নীল' ছিল ফারসি কোবাল্ট থেকে তৈরি। যতদূর জানা যায়, ত্রয়োদশ শতকের প্রথম পাদে কিংবা তারও আগে এই খনিজটি চীনে আমদানি করা হয়। এটির চীনা নাম ছিল হুইহুই কিং, যা দ্বারা পরিষ্কারভাবেই রঞ্জকটিকে চিহ্নিত করা হতো 'বিদেশি ভূমির দ্রব্য' হিসেবে। তৎকালীন আমলারা বলতেন: হুইহুই ছিল ১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে, মিং সাম্রাজ্য থেকে কিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, মুসলিম নির্দেশক প্রচলিত চীনা পরিভাষা। এখনো চীনের অধিকাংশ চীনাভাষী মুসলিমকেই অভিহিত করা হয় হুই হিসেবে।
মিং সাম্রাজ্যের সময় থেকেই, চীনে একটি রঞ্জক হিসেবে কোবাল্টের ব্যবহার শুরু হয় দেয়াল চিত্র ও মূর্তি নির্মাণে। তাছাড়া আরো পশ্চিমে, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে, একটি চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের বাইজেন্টাইন চার্চ ম্যুরালে দেখা যায় কোবাল্ট ব্যবহারের নিদর্শন। তবে কঠিন কিন্তু স্বচ্ছ পোরসেলিনে এর ব্যবহারই—যে উদ্ভাবনের জন্ম হান সাম্রাজ্যের সময়ে (২২ খ্রিস্টাব্দ–২৫০ খ্রিস্টাব্দ)—কোবাল্ট ভিত্তিক নীলকে আন্তর্জাতিক পরিসরে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বস্তুতই, পোরসেলিনের সবচেয়ে পরিচিত রঙের নকশা হিসেবে নীল ও সাদা বিশিষ্টতা অর্জন করে চীন ও ইসলামি দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যিক বিনিময়ের সূত্র ধরে।
"তাদের মধ্যে এই বিনিময় চলছিল কাঁচামাল, প্রযুক্তি ও নকশাকে কেন্দ্র করে," বলেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী পোলার্ড।
যতদূর জানা যায়, চীনে নীল ও সাদা মাটির মৃৎশিল্প চলে আসছে সেই ট্যাং সাম্রাজ্য (৬১৮ খ্রিস্টাব্দ–৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) থেকে। তখন উৎপাদনের মূল কেন্দ্র ছিল কেন্দ্রীয় চীনের হেনান প্রদেশের গংগাই সিটি (বর্তমানে গংজিয়ান) অঞ্চল। রঙটি স্বল্পমেয়াদে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চীনে, কিন্তু পরবর্তী পাঁচ শতকের জন্য আবার উধাও হয়ে যায়। ট্যাং কোবাল্টের উৎস ওই অঞ্চলেরই কোনো স্থান ছিল নাকি বাইরে থেকে আমদানি করা হতো, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আজো পাওয়া যায়নি। তবে যে ব্যাপারটি নিশ্চিত তা হলো, ইরাকের বন্দর নগরী বাসরার (আব্বাসিদ সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল) কুমোররা সিল্ক রোডের বাণিজ্যের কল্যাণে চীনা সিরামিকের সাথে পরিচিত হয়ে গেছিল। যদিও তারা পোরসেলিন পুনরুৎপাদনের রহস্য জানতে সমর্থ হয়নি, কেননা সেটি ছিল খুবই গোপনীয়, তবে মুসলিম কুমোররা ঠিকই অনুমান করে ফেলেছিল গংজিয়ান বাসনের মসৃণ সাদা দীপ্তি সম্পর্কে। এবং সেই অনুমানের ভিত্তিতেই তারা সূক্ষ্ম, কোবাল্ট-নীল ফুলেল নকশা ও আরবি অক্ষরসমৃদ্ধ বাসন প্রস্তুতে সফল হয়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হিসেবে আব্বাসিদ যুগের কোবাল্টের উৎস কী, সে ব্যাপারেও কোনো নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। কিন্তু চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, নীল কালির কোবাল্টের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের যে জায়গাটির ব্যাপক পরিচিতি ছিল সেটি হলো কামসার। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ইরানের কারকাস পর্বতমালার, কাশান নামক পর্বতের পাশে অবস্থিত একটি গ্রাম।
"সেখানকার জনগণ দাবি করে, এটি নাকি নবী সুলাইমান আবিষ্কার করেছিলেন," ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে সিরামিকের উপর রচিত গ্রন্থে লিখেছেন ফারসি ইতিহাসবিদ আবু'ল-কাসিম কাশানি। আবিষ্কারের এই কিংবদন্তীর কারণেই, কামসার কোবাল্টকে কারিগররা 'সুলাইমানি' হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করে। মুসলিম নীলের আরেকটি চীনা পরিভাষাও এই নামটির কাছাকাছি : 'সু-মা-লি' বা 'সু-মা-নি'। পণ্ডিতরা আরো ধারণা করেন যে 'সু-মা-লি' সম্ভবত আরবি শব্দ 'সামাউয়ি' (আকাশি-রঙ)-এর চীনা অনুবাদ।
ল্যাপিসের চেয়ে কাঁচা কোবাল্ট প্রক্রিয়াজাতকরণ ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম শ্রমসাধ্য। ভেতরের সারবস্তুটুকু উদ্ধারের জন্য একে প্রথমে ধোয়া হতো, তারপর গুঁড়ো করা হতো। তারপর সেটিকে মেশানো হতো একটি জৈব বন্ধন শক্তির সাথে, এবং সেটিকে সহজেই রূপান্তর করা হতো পরিবহণযোগ্য নরম পিণ্ডে। এগুলো, পটাশ ও বোরাক্সের সাথে একত্রে গলে যাওয়ার পর, স্মল্ট নামের এক ধরনের শক্ত কাঁচে রূপান্তর করা হতো, এবং রঞ্জন বানাবার জন্য সেটিকে আবার পিষে চূর্ণ করা হতো। পিণ্ড আকারে কিংবা স্মল হিসেবে, সিল্ক রোডের মাধ্যমে কোবাল্ট পূর্বাঞ্চলে চলে যেত, এবং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পা রাখত ফুজিয়ান প্রদেশের কোয়ানঝৌ শহরে। এই কোয়ানঝৌ ছিল একাদশ থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত বিদেশি বাণিজ্যের জন্য চীনের প্রধান বন্দর। ওই বন্দরে কোবাল্টের জন্য প্রচুর দর হাঁকা হতো। রাজ ফরমান মোতাবেক, দুই ক্যাটির (আড়াই পাউন্ডের কিছু বেশি) দাম ছিল এক রোল চমৎকার রেশমের সমান। এই রঞ্জককে সংরক্ষণের জন্য, চীনের পোরসেলিন রাজধানী খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের নগরী জিংদেঝেনের কারিগররা পারস্যের স্মল্টের সাথে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কোবাল্ট মিশিয়ে তৈরি করত হুইহুই কিং। এটি দিয়ে তারা হরেক রকমের পোরসেলিন সামগ্রীকে সাজিয়ে তুলত। এগুলো বেশিরভাগই তৈরি হতো মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের কথা মাথায় রেখে, কেননা চীনারা নীল ও সাদা রঙের মিশ্র নকশার চেয়ে নিখাদ রঙকেই বেশি প্রাধান্য দিত।
পোলার্ডের মতে,"এটি আসলে কখনোই চীনা সামগ্রী ছিল না, কেবলই একটি ধার করা রুচি ছিল।"
এমন রুচি ধার করার পেছনে প্রধান প্রভাব ছিল কোয়ানঝৌতে বসবাসরত সেইসব ধনী মুসলিম বণিকদের, যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল চীনা নীল ও সাদা পোরসেলিনের অধিকাংশ রপ্তানি, বাজারজাত, এমনকী উৎপাদন ব্যবস্থা। এবং এই সবকিছুরই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্টভাবে শুধু ইসলামিক বাজারেই পণ্যগুলো ওঠানো। জিংদেঝেনের কুমোররাও মুসলিম বণিকদের মর্জি বুঝে ফেলেছিল, তাই তারা ইসলামি ঘরানার ফুলেল ও জ্যামিতিক নকশাসমৃদ্ধ নীল-সাদা থালা, বাটি, পাত্র এবং অন্যান্য পোরসেলিন সামগ্রি তৈরি করত। কেউ কেউ আবার আরবি অক্ষর খোদাইয়ের চেষ্টাও করত। তবে ভাষাটির ব্যাপারে খুব একটা দখল না থাকায়, মাঝেমধ্যেই হীতে বিপরীত ঘটত।
হংইয়ু সম্রাট (যিনি মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং চীন শাসন করেন ১৩৬৮ থেকে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) আকস্মিকভাবেই সবধরনের বিদেশি বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। কারণ তিনি মনে করতেন কৃষিই হলো দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু তারপরও, পোরসেলিনের বিদেশি চাহিদার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, সেটিকে তার পক্ষেও অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়নি। যেমন মিং রাজ দরবারের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ১৩৮৩ সালে চীন মুসলিম শাসকদের জন্য কূটনৈতিক উপহার হিসেবে ১৯,০০০ টুকরো পোরসেলিন সামগ্রী রপ্তানি করে। সিরামিকস ইতিহাসবিদ রবার্ট ফিনলে জানান, ১৪০৩ সালে হংইয়ুর পুত্র ইয়ংগুলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন বিদেশি বাণিজ্যের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তখন থেকে আবারো দেশটির রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হয়ে পড়ে সিরামিকসের উপর নির্ভরশীল।
'পিলগ্রিম আর্ট: কালচারস অভ পোরসেলিন ইন ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি' (ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ২০১০) গ্রন্থে ফিনলে লিখেছেন, "নীল-সাদা রঙের মিশ্রণটির জনপ্রিয়তা এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, এটি ফিলিপাইন থেকে পর্তুগাল যে সমাজেই পৌঁছেছে, সেই সমাজেরই মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যকে বদলে দিয়েছে (কখনো আবার ধ্বংসও করে দিয়েছে)।"
রঙের এই বিশেষ শৈলীটি মাতিয়েছে ইসলামিক স্পেনকেও, যেখানে নীল ও সাদা প্রভাবিত করেছে আল-আন্দালুসের 'আজুলেজো' নামক জটিল টালি শিল্পকর্মকেও। স্প্যানিশ ভাষায় 'আজুল' অর্থ নীল। রেনেসাঁ ইতালির রঙিন মাইওলিকা, ফরাসি ফাইয়েন্স, ডাচ ডেলফট, ডেনিশ রয়্যাল কোপেনহেগেন, ইংলিশ নীল ও সাদা মাটির পাত্র এবং, আটলান্টিকের ওপাশে, আমেরিকান কুরিয়ার অ্যান্ড আইভসের নকশাসহ আরো অনেক কিছুরই মূল উৎস হলো চীনের নীল ও সাদা কোবাল্ট পোরসেলিন।
পশ্চিমের পানে যাত্রাপথে, নীল ও সাদা পোরসেলিন বুড়ি ছুঁয়ে গেছে পশ্চিমা আনাতোলিয়ার ব্যস্ত বাণিজ্য নগরী ইজনিকেও। সেখানে, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে অটোমান কুমোরদের হাত ধরে এই শৈলীটি লাভ করে এক নবরূপ। অটোমানরা চীনা নীল ও সাদার সংমিশ্রণটিকে গ্রহণ করে ঠিকই, তবে তার সঙ্গে যোগ করে তাদের নিজস্ব নকশা। মেশায় সর্পিলাকৃতির ফুল কিংবা জ্যামিতিক নকশা, এবং টারকোয়েজ ('তুর্কি' এর ফরাসি পরিভাষা), সবুজ চুনি ও কাদা-সদৃশ লাল রঙ।
এই বহুবর্ণের কারুকার্যখচিত নকশা এক স্বকীয় চরিত্রের জন্ম দেয়, এবং শহরের নামের সাথেই সমার্থক হয়ে ওঠে ইজনিক মৃৎশিল্প। তারপরও, নীলই থেকে যায় প্রধান ও মৌলিক রঙ হিসেবে। অটোমান সুলতানদের, বিশেষত সুলতান সুলেমানের (১৪৯৪-১৫৬৬) পৃষ্ঠপোষকতায়, ইজনিক সিরামিকসের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদের লাবণ্যময় দেয়াল কিংবা নিকটবর্তী, সপ্তদশ শতকের শুরুর দিককার নীল মসজিদের আভ্যন্তরীন কারুকার্যে দেখা মেলে সেই উন্নতির নিদর্শন।
'কালার, লাইট অ্যান্ড ওয়ান্ডার ইন ইসলামি আর্ট' (সাকি বুকস, ২০২০)-এর রচয়িতা এবং সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড কালচারের কিউরেটর, ইদ্রিস ত্রেভাথানের মতে, যদিও নীল ইজনিক টালির বিশিষ্টতা মূলত জাগতিক সম্পদ ও ক্ষমতাকেই ইঙ্গিত করে, তবে এটি ধর্মনিরপেক্ষতাকেও অতিক্রম করেছে।
তিনি বলেন, "নীল টালি করা মসজিদটির প্রতিটি পৃষ্ঠকেই যেভাবে সাজানো হয়েছে বিপুলভাবে বিস্তৃত টালি দিয়ে, তা যেন উদ্দীপনা জোগায় গাঢ় নীল তৃণভূমিতে ছেয়ে যাওয়া কুঁড়ি ও ফুলকে, কিংবা গাঢ় নীল পশ্চাৎপট ও ভিতরের মাঠ ফুটিয়ে তোলে নক্ষত্রখচিত আকাশের গভীরতাকে। এভাবেই, নকশাটি একই সঙ্গে আহ্বান জানায় নন্দনকাননের পুষ্পরাজিকে, এবং স্বর্গের তারকারাজিকে।"
এই প্রতীকী রূপের মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটে আরবি ভাষায় নীল শব্দের ভিত্তিমূলের। 'আজরাখ', যেটির প্রকৃত অর্থ হলো একটি চকচকে বা ঝিকিমিকি বিন্দু, যেমন তা হতে পারে একটি তারা। ত্রেভাথানের মতে, এই কল্পনাটি বহন করে এমন এক ধারণা, যেখানে ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে ঐকতান ঘটেছে গতিময়তার।
কিংবা এর অর্থ হতে পারে ঝলকানি, যে চিন্তা ধরা দিয়েছে জিয়ান ইউয়ানপিয়ানের মনে।
প্রকৃতপক্ষে, নীলের তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতা সবসময়ই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, চাঙ্গা করেছে একটি বৈশ্বিক শিল্পকে, এবং প্রভাব ফেলেছে রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে জনসাধারণের পোশাক-পরিচ্ছদে।
আসল নীল
ইউরোপজুড়ে অনেকেই ওড নামের একটি কৃশকায় ফুলের গাছ চাষ করত নীল রঙ তৈরির জন্য। লাভের আশায় এক্ষেত্রে প্রচুর অর্থলগ্নি করে রেখেছিল তারা। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে তারা সবাই একাট্টা হয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে তাদের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে। সেই প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ইন্ডিগো। এশিয়ায় শত বছরের ঔপনিবেশের ফলে যে সামগ্রীগুলো সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছিল ইউরোপের বাজারে, ইন্ডিগোর অবস্থান ছিল তাদের মধ্যে একদম সামনের সারিতে।
১৬৫০ সালে ড্রেসডেনের কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাদের কাছে নাকি পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে যে ইন্ডিগো কেবল অল্প সময়ের মধ্যে বর্ণহীনই হয়ে পড়ে না, বরং এটি নষ্ট করে দেয় পোশাকসহ সবধরনের কাপড়কে। ১৬৫৪ সালে জার্মান সম্রাট তৃতীয় ফার্দিনান্দ ইন্ডিগোকে আখ্যায়িত করেন 'শয়তানের চোখ' হিসেবে। নুরেমবার্গের সব রঙ প্রস্তুতকারককে জোরপূর্বক শপথ করানো হয়, তারা কেউ যেন এই 'শয়তানের চোখ' ব্যবহার না করে। এদিকে ইংল্যান্ডে রানি প্রথম এলিজাবেথ ফরমান জারি করেন যে ইন্ডিগো হলো বিষাক্ত। তিনি কারাদণ্ডের হুমকি দেখিয়ে তার সমগ্র রাজত্ব জুড়ে এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ফরাসি সরকার বিষয়টিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। তারা বলে, কোনো রঙ প্রস্তুতকারক যদি ইন্ডিগো ব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তার সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড।
কিন্তু ইন্ডিগোর নামে এসব অভিযোগের কোনোটিই সত্য ছিল না।
বরং ভারতীয় উদ্ভিদ Indigofera tinctoria থেকে উদ্ভূত ইন্ডিগোই জন্ম দিত টেক্সটাইল ইতিহাসের সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে তীব্র নীল রঞ্জক।
ইউনিভার্সিটি অভ এক্সিটারের ইনস্টিটিউট অভ আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের অনারারি সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং 'ইন্ডিগো ইন দ্য আরব ওয়ার্ল্ড' (রওটলেজ, ১৯৯৬)-সহ ইন্ডিগোর উপর বেশ কিছু বইয়ের রচয়িতা জেনি বেলফোর-পল বলেন, "এটি (ইন্ডিগো) কখনোই এর নীলত্ব হারায় না। এটিই একমাত্র রঞ্জক, যার এমন গুণ রয়েছে।"
প্রকৃতপক্ষেই, ইন্ডিগোর নীল দিয়ে তৈরি পৃথিবীর বহু পুরনো কাপড়ই তাদের রঙ অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যেমন মিশরীয় মমিদের গায়ে রয়েছে লিনেনের নীল প্রান্তবিশিষ্ট কাপড়, যা তৈরি করা হয়েছে ৪,০০০ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে। কিন্তু সেগুলো তাদের রঙ হারায়নি।
গ্রিক ও রোমানরা ইন্ডিগোকে গণ্য করত আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তারা এটি রপ্তানি করত মিশর ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। 'ইন্ডিগো' শব্দটি এসেছে গ্রিক 'ইন্ডিকন' থেকে, যার লাতিন রূপ হলো 'ইন্ডিকাম'। এই নামকরণের মাধ্যমে মূলত জিনিসটির ভৌগোলিক উৎস নির্দেশিত হচ্ছে।
ইন্ডিগোর রঙের তীব্রতার কৃতিত্ব যে রাসায়নিক যৌগটির, সেটি হলো ইন্ডিকান, যা indigofera নামক বোটানিক্যাল জেনাসের সকল সদস্যের মাঝে বিদ্যমান। ওড গাছে নীল-উৎপাদক রাসায়নিক যৌগটির উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ভারতীয় ইন্ডিগোর তুলনায় এটি অনেক বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। উভয় জাতের উদ্ভিদ থেকেই রঙ নিষ্কাশনের রেসিপি হলো : গাছের পাতাগুলোকে ক্ষারীয় দ্রবণে গাঁজন, যেন অক্সিডাইজেশনের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ রাসায়নিক যৌগ নীল রঙে রূপান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে রঞ্জক পদার্থটিকে বারবার দ্রবীভূত করতে হয়। প্রতিবার দ্রবীভূত করার পর, যে পদার্থটির রঙ শুরুতে ছিল হলদেটে, বাতাসের সংস্পর্শে এসে সেটি ক্রমশ নীলে পরিণত হতে থাকে।
উমাইয়াদ যুগে, মধ্য-সপ্তম শতক থেকে মধ্য-অষ্টম শতকের মধ্যে, ইন্ডিগোর বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল আরব বণিকদের হাতে। ইসলামের বিস্তারের সমান্তরালে তারাই কাবুলের পশ্চিম থেকে শুরু করে লেভ্যান্ট কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে সাব-সাহারান আফ্রিকা পর্যন্ত ইন্ডিগোর জনপ্রিয়তা ও চাষাবাদ ছড়িয়ে দেয়।
চতুর্দশ শতকের মধ্যে, বাগদাদ হয়ে ওঠে ইন্ডিগো চাষের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সক্রিয় কেন্দ্র। বেলফোর-পলের মতে, এখানে ইন্ডিগোর আবির্ভাব ঘটেছে সম্ভবত কাবুল এবং দক্ষিণ-পূর্ব পারস্যের কিরমান থেকে। এটির দাম ছিল অন্যান্য উৎসের ইন্ডিগো থেকে তিন বা চার গুণ বেশি। তারপরও চতুর্দশ শতকের কাতালান বণিকরা বলত, 'এন্দেগো ফিনো দি বাগদাদ'-ই (ইতালিয়ান বণিকরা বাগদাদের ইন্ডিগোর এই নাম রেখেছিল) হলো সর্বোৎকৃষ্ট।
এতটা সম্মান সন্নিহিত থাকার দরুণ, ইন্ডিগোর নীল একসময় পরিণত হয় ইউরোপীয় রাজকীয়তার রঙে। বিশেষত ফ্রান্সে এটি সবচেয়ে বেশি মূল্যায়িত হয়। সেখানে রাজবংশের সকলের পোশাক ও আভিজাত্যের স্মারকে ব্যবহৃত হতে থাকে এই রঙ।
"এমনকী রাজা আর্থার, যিনি কিনা মধ্যযুগীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কিংবদন্তীতুল্য শাসক, তাকেও ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কেবল নীল পরিধান করতেই দেখানো হয়নি, আরো চিত্রিত হয়েছে যে তিনি বহন করছেন নীল খোলা ও তিনটি সোনার মুকুট বিশিষ্ট ঢাল। ফ্রান্সের রাজার বাহুতেও একই রঙ দেখা যেত," বলেন মিশেল পাস্তোরে, 'ব্লু : দ্য হিস্টোরি অভ এ কালার' (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১) গ্রন্থে।
আরব বিশ্বেও ইন্ডিগো নীলকে একই ধরনের উচ্চমর্যাদা দেয়া হতো, বিশেষত যখন সেটি প্রয়োগ করা হতো কারুকার্যময়, অত্যুজ্জ্বল কাপড়ে।
"যত উজ্জ্বলতা ছড়াবে, ততই মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে," বেলফোর-পল বলেন। এক্ষেত্রে তিনি মুসলিম বিশ্বে ইন্ডিগো নীলের বহুল বিস্তৃত ব্যবহারের একটি উদাহরণ হিসেবে বলেন উত্তর আফ্রিকার তুয়ারেগদের সেই বিশ্বখ্যাত বিদ্যুৎ-নীল পোশাকের কথা। বহু ঐতিহাসিক পশ্চিমা পর্যটকই আরব উপদ্বীপে গিয়ে এটির চাষাবাদ ও জনপ্রিয়তার সাক্ষী হয়েছেন।
১৮৩০ সালে তার 'নোটস অন দ্য বেদুইনস অ্যান্ড ওয়াহাবির' গ্রন্থে জোহান লুডউইগ বুর্কহার্ট বলেন, উত্তর মক্কার সকল উপজাতিদের কাছেই নীল ছিল 'বিশ্বজনীন' পছন্দের বেদুইন পোশাক। এদিকে অষ্টাদশ শতকের জার্মান অন্বেষক কার্স্টেন নিবুহর তার ১৭৯২ সালে প্রকাশিত 'ট্র্যাভেলস থ্রু অ্যারাবিয়া অ্যান্ড আদার কান্ট্রিজ ইন দ্য ইস্ট' গ্রন্থে বলেন, "ইন্ডিগো নামের উদ্ভিদ চাষ করা হয় সমগ্র আরব অঞ্চলজুড়ে, কেননা নীল হলো আরবদের প্রিয় রঙ।"
এই নীলাসক্তি নিছক ফ্যাশনকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। লাল যেখানে চিহ্নিত হতো উত্তাপের প্রতীক হিসেবে, সেখানে নীলের ব্যাপারে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। বেলফোর-পলের মতে, "জ্বরাক্রান্ত অবস্থাকে শীতল করতে নীলের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।" আরব উদ্ভিদবিদ ইবনে আল-বায়তার তার ত্রয়োদশ শতকের ঔষধ বিষয়ক গ্রন্থ 'কম্পেন্ডিয়াম অন সিম্পল মেডিক্যামেন্টস অ্যান্ড ফুডস' গ্রন্থে ইন্ডিগোর ঔষধি গুণাগুণের একটি লম্বা তালিকা প্রণয়ন করেন। এবং সেসব গুণাগুণের মূল ভিত্তি ছিল রঙটির শীতলীকরণ ক্ষমতা। এমনকী আধুনিক সময়েও, দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের উপজাতি জনগোষ্ঠীর কাছে ইন্ডিগো বিবেচিত হয় একটি ঐতিহ্যবাহী ওষুধ হিসেবে। তারা বিভিন্ন কারণে এটি ত্বকে লাগায়, যেমন কীটনাশক হিসেবে।
ইসলামি সংস্কৃতিতে নীলের মর্যাদা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে মধ্যযুগে এটি বিভিন্ন পবিত্র কাজেও ব্যবহৃত হতে থাকে। বর্তমানে এর সবচেয়ে নজরকাড়া নিদর্শন হলো বিখ্যাত নীল কুরআন, যেটি নবম শতকের শেষভাগ কিংবা দশম শতকের শুরুর দিকে কোনো একসময় স্পেন অথবা তিউনিশিয়ায় তৈরি হয়। এই কুরআনে ইন্ডিগো দিয়ে নীল করা চামড়ার কাগজের উপর সোনালি পাতার ক্যালিগ্রাফি খোদাই করা হয়েছিল। শিল্প ইতিহাসবিদ মারিয়া সারদির মতে, রঙের এমন নকশার পরিকল্পনা সম্ভবত তৎকালীন মুসলিম ও খ্রিস্টান শাসকদের দরবারি নথিপথের আদলে করা হয়েছিল।
সারদি সজ্জা শিল্প, পোশাক-পরিচ্ছদ ও রাজকীয় গহনার ক্ষেত্রে মামলুকদের নীল ও সোনালি প্রীতি নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। তিনি বলেন, "যখন বাইজেন্টাইন সম্রাট সুলতানের কাছে কূটনৈতিক দূত পাঠান, তিনি সোনালি কিংবা নীল চামড়ার কাগজের উপর লিখেছিলেন। এই বিষয়টি মুসলিমদের অনেক মুগ্ধ করেছিল।"
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ অনুসন্ধানকারী ভাস্কো দা গামা যখন আফ্রিকার কেপ অভ গুড হোপ (উত্তমাশা অন্তরীপ) প্রদক্ষিণ করেন এবং ইউরোপ থেকে পূর্বে আগমনের সরাসরি জলপথ আবিষ্কার করেন, এর মাধ্যমে আরবদের ইন্ডিগোর উপর একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটে। ঠিক যেভাবে অবসান ঘটে মসলা কিংবা সিল্ক রুট বাণিজ্যকালীন অন্যান্য অধিকাংশ পণ্যের উপর থেকেও একাধিপত্য। আরবদের আধিপত্য কমলে কী হয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বে কিন্তু ইন্ডিগো বাণিজ্যের ব্যাপারে আগ্রহ ক্রমশ তুঙ্গস্পর্শী হতে শুরু করে, এবং শেষমেশ এই বাণিজ্যকে দাবিয়ে রাখার সকল প্রচেষ্টাকেও তারা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
দুইটি বাজারে এর আগমন সামগ্রিক পরিস্থিতিকে খোলনলচে বদলে দেয়। সেই দুইটি বাজার হলো সামরিক ক্ষেত্র ও শিল্প ক্ষেত্র। ইন্ডিগোর দীর্ঘস্থায়িত্বের ফলে এটি হয়ে ওঠে উল ও তুলার তৈরি শক্ত কাপড়ে ব্যবহার্য প্রথম পছন্দ। সামরিক বাহিনীর সাধারণ সৈন্য থেকে শুরু করে সমুদ্রের নাবিক কিংবা ফসলের মাঠ ও কারখানার শ্রমিক, সবার পোশাকেই নীল রঙ উঁকি মারতে থাকে। (এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন 'নেভি ব্লু' ও 'ব্লু কলার' কথাগুলোর মাহাত্ম্য!)
শেষোক্ত দুই বাহিনী সুফল ভোগ করে আরব বিশ্বের ইন্ডিগো বাণিজ্যের সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদী ঐতিহ্যের। বেলফোর-পল ঘটনাক্রমকে সাজিয়েছেন এভাবে : ইসলামিক যুগের শুরুর দিকে বেশ শক্ত ও বলিষ্ঠ একটি মিশরীয় কাপড় ইতালিতে আমদানি করা হয়। কাপড়টির নাম ছিল ফুসতিয়ান (কথাটি এসেছে ফুসতাত থেকে, যেটি ছিল কায়রোর পূর্ববর্তী নগরী)। এই কাপড়ের অনুকরণে জেনোয়িজ তাঁতিরা তাদের নিজস্ব একটি সংস্করণ তৈরি করতে থাকে। সেটির নাম তারা দেয় জিন ফুসতিয়ান, যাতে ইন্ডিগো নীল রঙ ব্যবহার করত তারা। জিন ফুসতিয়ানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে, এটির জিন নামটুকুই লোকমুখে অধিক প্রচলিত হয়ে যায়। কিংবদন্তী রয়েছে, এই জিনই পরবর্তীতে পরিণত হয় 'ব্লু জিনস'-এ, যা কিনা আধুনিক ফ্যাশনের ইতিহাসে বিশ্বব্যাপী সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্ভাবন।
ইজেল টিবিএস
জান্নাতুল নাঈম পিয়াল
1 টি মন্তব্য:
Admission Tune is one of the famous educational platforms in BD. We generally provide circular, study, tips and tricks, health and blogging idea. We also offer online courses both premier and free. We publish useful content for our readers such as educational, technology, higher education and vice-versa. We started our journey in 2021.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন