আনোয়ার গ্রুপ | আনোয়ার টেক্সটাইল I Anwar Group of Industries - Textile Lab | Textile Learning Blog
আনোয়ার গ্রুপ: চিরুনি প্রস্তুতকারক থেকে ২০টি কোম্পানির মালিক
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে ১৮৮ বছরের পুরনো পারিবারিক ব্যবসার ইতিহাস, শক্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন; তার প্রত্যাশা ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে তার প্রতিষ্ঠান।

দেশের পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম আনোয়ার গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৪ সালে। পুরান ঢাকার লাক্কু মিয়ার প্রতিষ্ঠিত 'হিডস অ্যান্ড স্কিনস' ব্যবসায়ের মূল প্রসার হয় নাতি আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে।

গত বছর আগস্টে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদা-বাবার চামড়ার ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনে ২০টিরও বেশি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন 'মালা শাড়ি' খ্যাত আনোয়ার হোসেন। 

বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপ বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বীমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

আনোয়ার হোসেনের প্রয়াণের পর বড় ছেলে মনোয়ার হোসেন দায়িত্ব নিয়েছেন এই ব্যবসা গ্রুপটির। আনোয়ার গ্রুপের বেড়ে ওঠা বর্তমান ব্যবসা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন মনোয়ার হোসেন।

১ টাকার ইজারায় শুরু

এই অঞ্চলের ব্যবসা যখন ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন থেকেই ব্যবসা করছে আনোয়ার গ্রুপ। ১৮৮ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে ১ টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)।

লাট মিয়ার মূল ব্যবসা ছিল শিং দিয়ে চিরুনি ও বোতাম তৈরি করে বিক্রি করা। আনোয়ার হোসেনের বাবা রহিম বখস তার বাবার ব্যবসাকে আরও বড় করেন। শিংয়ের চিরুনির পাশাপাশি কাপড়সহ আরও কিছু পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি।

বাবার মুখে শোনা দাদার ব্যবসার স্মৃতিচারণ করে মনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, এক টাকার ইজারার দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করলেও তার দাদা তৎকালীন বাংলার সর্বোচ্চ করদাতাদের একজন ছিলেন।  
 
"দাদা অনেক বড় মাপের ব্যবসায়ী ছিলেন। সে সময়েই তিনি কমিউনিটি বেজড ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ভারত থেকে ট্রেনে করে মহিষের শিং এনে এখানাকার মানুষদের দিতেন। তারা এই শিং দিয়ে চিরুনি বানাতো। পরে এসব আবার কলকাতা, মাদ্রাজ, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রপ্তানি করা হতো", বলেন মনোয়ার।

"দাদা যখন মারা যান তখন তার বয়স ৮৪ হলেও বাবার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। ওই সময় বড় চাচার বয়স ১৬ এবং মেঝো চাচার বয়স ছিল ১২ বছর। সব ছেলেরা ছোট থাকায় ওই সময় দাদার ব্যবসা ভেঙে পড়তে থাকে। তখন বাবা দোকানে গিয়ে বসা শুরু করেন। ৮ বছর বয়সে বাবা ব্যবসায় নামেন। এর আগে ৬ বছর বয়সে দোকানে বসা শুরু করেন", যোগ করেন মনোয়ার।

আনোয়ার হোসেন: ছোট থেকে শুরু, তারপর বড় হওয়া

আনোয়ার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৮ সালে। ১৯৫০'র দশকে নিজের ব্যবসা শুরু করার আগে তিনি কয়েক বছর পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করেন।

মানোয়ার হোসেন জানান, "আমার দাদা রহিম বখশ ১৯৪৫ সালে মারা যান। আমার বাবার বয়স তখন মাত্র ৬-৭ বছর। এর পরপরই পারিবারিক ব্যবসায় বিপর্যয় নেমে আসে। কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী টাকা আত্মসাৎ করতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে, বাবা মাত্র ৮ বছর বয়সে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।"

মানোয়ার আরও বলেন, "তিনি চকবাজারের ২২০ নম্বর দোকানে তার প্রথম ব্যবসা, আনোয়ার ক্লথ স্টোর চালু করেছিলেন মাত্র ৩৬০ টাকা নিয়ে। বাবার বয়স যখন ১১ বছর, তখন তার কাছে ছিল ১ লাখ টাকা।"

"বাবা নিজের কঠোর পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করেন এবং তার ব্যবসা বাড়তে থাকে। চকবাজারে নিজের দোকানের পাশে আরও ৬টি দোকান কিনে কাপড় ও শাড়ি বিক্রি শুরু করেন তিনি।" 

পরবর্তীতে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ঢেউটিন আমদানি শুরু করেন আনোয়ার হোসেন। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে তার ব্যবসার পরিধি ঢাকা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা বড় হওয়ার পর একটি কারখানা কিনেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে সেই কারখানার নাম রাখেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তার ব্র্যান্ড মালা শাড়ি তাত্ক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তার ব্যবসা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

মালা শাড়িকে বাংলাদেশে শাড়ির সর্বপ্রথম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৬০, ১৯৭০ এবং ১৯৮০'র দশকে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল দেশজুড়ে। 

১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক তার তৈরির কারখানাও কিনেছিলেন। এরপর তিনি 'দ্য ফার্স্ট স্টেইনলেস স্টিল কাটলারি ম্যানুফ্যাকচারার' নামে একটি স্টিল মিল চালু করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ব্যবসা বাধার সম্মুখীন হয়।

মানোয়ার হোসেন বলেন, "দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমার বাবার অবদান ছিল অন্যতম। ১৯৭৮ সালে তিনি খালেদ আয়রন অ্যান্ড স্টিলস লিমিটেড নামে একটি নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি তিনি ধীরে ধীরে আরও কিছু নতুন উদ্যোগ যেমন- আনোয়ার টেক্সটাইল, আনোয়ার স্টিল এবং আনোয়ার সিমেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।"

তিনি আরও বলেন, "সরকারি ব্যাংকগুলোতে ব্যবসায়ী ও নারীদের ঝামেলা কমাতে আনোয়ার হোসেন বহু প্রচেষ্টার পর ১৯৮৩ সালে সিটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি।"  

"আমার বাবা সাফল্য অর্জন করেছিলেন, কারণ তার মা, অর্থাৎ আমার দাদীর প্রতি তার ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ", যোগ করেন মনোয়ার। 

বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি

বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপের অধীনে ২০টিরও বেশি কোম্পানিতে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে ১৪ হাজার মানুষের।  

মনোয়ার হোসেন জানান, মহামারির মধ্যেও তাদের ব্যবসায় ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। এর মধ্যে টেক্সটাইল, সিমেন্ট শিট, পলিমার ও কনস্ট্রাকশন খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেশি। 

"আমরা ডিলারদের ভালো সুবিধা দিয়ে তাদের টিকিয়ে রেখেছি। তবে সিমেন্ট ও স্টিলে আমরা তেমন প্রবৃদ্ধি দেখাতে পাইনি। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেমন প্রবৃদ্ধি হয়নি", যোগ করেন মনোয়ার। 

তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির পর সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকট এবং দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট তাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলার সংকটের কারণে সব ধরনের ব্যবসা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এর ফলে সিমেন্ট এবং স্টিলের মতো ব্যবসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মনোয়ার।

পরিস্থিতির উন্নতি হতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

নতুন ৪ প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ

ডেনিম ও ইস্পাতসহ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে আনোয়ার গ্রুপ। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হবে এবং তাতে নতুন ৬ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানান মনোয়ার হোসেন। 

তিনি বলেন, "ইস্পাত খাতে আমাদের ৩ হাজার কোটি টাকার একটি বড় বিনিয়োগ আসছে। এটি ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হবে। ডেনিমে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি বিনিয়োগ নিয়ে আসছি। এটি ২০২৫ সালের আগেই উৎপাদনে আসবে।"
 
"এর আগে একটি কার্টন ইন্ডাস্ট্রি এবং একটি পেপার ইন্ডাস্ট্রি করতে চাই। কার্টন ও পেপার বিদেশে রপ্তানি হবে। কার্টন ইন্ডাস্ট্রির কাজ ২০২৩ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিক নাগাদ শেষ করতে চাই। এর পরের বছরই পেপার ইন্ডাস্ট্রি বাজারে আসবে", যোগ করেন তিনি। 

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের কোম্পানিতে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশা করছেন মনোয়ার হোসেন।

অল্প বয়সেই ব্যবসায় প্রবেশ মনোয়ার হোসেনের

বিদেশে পড়াশোনা করলেও বাবার মতোই অল্প বয়সে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন আনোয়ার গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, "আমি পড়াশোনা করেছি দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে আমি ব্যবসায় যোগ দেই। তবে আমি ক্লাস ফাইভ থেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তখনই বাবা আমাকে তার ব্যবসার ব্রিফকেইসটা দিয়েছিলেন। ক্লাস সেভেনে দোকানে বসেছি। ছুটিতে আসলেই ব্যবসার কাজ করেছি। কারখানায়ও যেতাম।"

"১৯৯৩ সালে আমাকে কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসায় নামিয়ে দেন বাবা। তখন আনোয়ার স্টিলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর তাতে আর কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমিও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসা হারাইনি বা নষ্ট করিনি", যোগ করেন মনোয়ার। 

'গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তভিত আমাদের বাঁচিয়ে দেবে'

করোনা পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে মন্দার মুখে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বাংলাদেশও তাই সাশ্রয়ের দিকে এগোচ্ছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেশে শুরু হয়েছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। এর পাশাপাশি সীমিত করা হয়েছে অনেক পণ্যের আমদানি। 

এরপরেও গ্রামীণ অর্থনীতির শক্ত ভিত আমাদের বাঁচিয়ে দেবে বলে মনে করেন মনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, "আমি অনেক আগেই বলছিলাম যে, কোভিড শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংকট কাটবে না। কোডিভ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলো। সংকটটা ইউরোপ-আমেরিকা থেকেই আসলো। তবে একটি দিক থেকে আমরা ব্যতিক্রম। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে।"

"কোভিডের শুরুতে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব যখন কল কারখানা বন্ধ করে দিল, তখনও দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি সচল ছিল। আমাদের কৃষি আমাদের রক্ষা করেছে। গ্রামীণ পোল্ট্রি, পশু পালন ও মৎসচাষ আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে", যোগ করেন মনোয়ার।

আনোয়ার গ্রুপ | আনোয়ার টেক্সটাইল I Anwar Group of Industries

আনোয়ার গ্রুপ: চিরুনি প্রস্তুতকারক থেকে ২০টি কোম্পানির মালিক
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে ১৮৮ বছরের পুরনো পারিবারিক ব্যবসার ইতিহাস, শক্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন; তার প্রত্যাশা ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে তার প্রতিষ্ঠান।

দেশের পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম আনোয়ার গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৪ সালে। পুরান ঢাকার লাক্কু মিয়ার প্রতিষ্ঠিত 'হিডস অ্যান্ড স্কিনস' ব্যবসায়ের মূল প্রসার হয় নাতি আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে।

গত বছর আগস্টে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদা-বাবার চামড়ার ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনে ২০টিরও বেশি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন 'মালা শাড়ি' খ্যাত আনোয়ার হোসেন। 

বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপ বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বীমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

আনোয়ার হোসেনের প্রয়াণের পর বড় ছেলে মনোয়ার হোসেন দায়িত্ব নিয়েছেন এই ব্যবসা গ্রুপটির। আনোয়ার গ্রুপের বেড়ে ওঠা বর্তমান ব্যবসা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন মনোয়ার হোসেন।

১ টাকার ইজারায় শুরু

এই অঞ্চলের ব্যবসা যখন ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন থেকেই ব্যবসা করছে আনোয়ার গ্রুপ। ১৮৮ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে ১ টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)।

লাট মিয়ার মূল ব্যবসা ছিল শিং দিয়ে চিরুনি ও বোতাম তৈরি করে বিক্রি করা। আনোয়ার হোসেনের বাবা রহিম বখস তার বাবার ব্যবসাকে আরও বড় করেন। শিংয়ের চিরুনির পাশাপাশি কাপড়সহ আরও কিছু পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি।

বাবার মুখে শোনা দাদার ব্যবসার স্মৃতিচারণ করে মনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, এক টাকার ইজারার দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করলেও তার দাদা তৎকালীন বাংলার সর্বোচ্চ করদাতাদের একজন ছিলেন।  
 
"দাদা অনেক বড় মাপের ব্যবসায়ী ছিলেন। সে সময়েই তিনি কমিউনিটি বেজড ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ভারত থেকে ট্রেনে করে মহিষের শিং এনে এখানাকার মানুষদের দিতেন। তারা এই শিং দিয়ে চিরুনি বানাতো। পরে এসব আবার কলকাতা, মাদ্রাজ, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রপ্তানি করা হতো", বলেন মনোয়ার।

"দাদা যখন মারা যান তখন তার বয়স ৮৪ হলেও বাবার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। ওই সময় বড় চাচার বয়স ১৬ এবং মেঝো চাচার বয়স ছিল ১২ বছর। সব ছেলেরা ছোট থাকায় ওই সময় দাদার ব্যবসা ভেঙে পড়তে থাকে। তখন বাবা দোকানে গিয়ে বসা শুরু করেন। ৮ বছর বয়সে বাবা ব্যবসায় নামেন। এর আগে ৬ বছর বয়সে দোকানে বসা শুরু করেন", যোগ করেন মনোয়ার।

আনোয়ার হোসেন: ছোট থেকে শুরু, তারপর বড় হওয়া

আনোয়ার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৮ সালে। ১৯৫০'র দশকে নিজের ব্যবসা শুরু করার আগে তিনি কয়েক বছর পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করেন।

মানোয়ার হোসেন জানান, "আমার দাদা রহিম বখশ ১৯৪৫ সালে মারা যান। আমার বাবার বয়স তখন মাত্র ৬-৭ বছর। এর পরপরই পারিবারিক ব্যবসায় বিপর্যয় নেমে আসে। কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী টাকা আত্মসাৎ করতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে, বাবা মাত্র ৮ বছর বয়সে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।"

মানোয়ার আরও বলেন, "তিনি চকবাজারের ২২০ নম্বর দোকানে তার প্রথম ব্যবসা, আনোয়ার ক্লথ স্টোর চালু করেছিলেন মাত্র ৩৬০ টাকা নিয়ে। বাবার বয়স যখন ১১ বছর, তখন তার কাছে ছিল ১ লাখ টাকা।"

"বাবা নিজের কঠোর পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করেন এবং তার ব্যবসা বাড়তে থাকে। চকবাজারে নিজের দোকানের পাশে আরও ৬টি দোকান কিনে কাপড় ও শাড়ি বিক্রি শুরু করেন তিনি।" 

পরবর্তীতে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ঢেউটিন আমদানি শুরু করেন আনোয়ার হোসেন। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে তার ব্যবসার পরিধি ঢাকা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা বড় হওয়ার পর একটি কারখানা কিনেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে সেই কারখানার নাম রাখেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তার ব্র্যান্ড মালা শাড়ি তাত্ক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তার ব্যবসা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

মালা শাড়িকে বাংলাদেশে শাড়ির সর্বপ্রথম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৬০, ১৯৭০ এবং ১৯৮০'র দশকে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল দেশজুড়ে। 

১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক তার তৈরির কারখানাও কিনেছিলেন। এরপর তিনি 'দ্য ফার্স্ট স্টেইনলেস স্টিল কাটলারি ম্যানুফ্যাকচারার' নামে একটি স্টিল মিল চালু করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ব্যবসা বাধার সম্মুখীন হয়।

মানোয়ার হোসেন বলেন, "দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমার বাবার অবদান ছিল অন্যতম। ১৯৭৮ সালে তিনি খালেদ আয়রন অ্যান্ড স্টিলস লিমিটেড নামে একটি নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি তিনি ধীরে ধীরে আরও কিছু নতুন উদ্যোগ যেমন- আনোয়ার টেক্সটাইল, আনোয়ার স্টিল এবং আনোয়ার সিমেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।"

তিনি আরও বলেন, "সরকারি ব্যাংকগুলোতে ব্যবসায়ী ও নারীদের ঝামেলা কমাতে আনোয়ার হোসেন বহু প্রচেষ্টার পর ১৯৮৩ সালে সিটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি।"  

"আমার বাবা সাফল্য অর্জন করেছিলেন, কারণ তার মা, অর্থাৎ আমার দাদীর প্রতি তার ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ", যোগ করেন মনোয়ার। 

বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি

বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপের অধীনে ২০টিরও বেশি কোম্পানিতে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে ১৪ হাজার মানুষের।  

মনোয়ার হোসেন জানান, মহামারির মধ্যেও তাদের ব্যবসায় ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। এর মধ্যে টেক্সটাইল, সিমেন্ট শিট, পলিমার ও কনস্ট্রাকশন খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেশি। 

"আমরা ডিলারদের ভালো সুবিধা দিয়ে তাদের টিকিয়ে রেখেছি। তবে সিমেন্ট ও স্টিলে আমরা তেমন প্রবৃদ্ধি দেখাতে পাইনি। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেমন প্রবৃদ্ধি হয়নি", যোগ করেন মনোয়ার। 

তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির পর সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকট এবং দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট তাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলার সংকটের কারণে সব ধরনের ব্যবসা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এর ফলে সিমেন্ট এবং স্টিলের মতো ব্যবসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মনোয়ার।

পরিস্থিতির উন্নতি হতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

নতুন ৪ প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ

ডেনিম ও ইস্পাতসহ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে আনোয়ার গ্রুপ। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হবে এবং তাতে নতুন ৬ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানান মনোয়ার হোসেন। 

তিনি বলেন, "ইস্পাত খাতে আমাদের ৩ হাজার কোটি টাকার একটি বড় বিনিয়োগ আসছে। এটি ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হবে। ডেনিমে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি বিনিয়োগ নিয়ে আসছি। এটি ২০২৫ সালের আগেই উৎপাদনে আসবে।"
 
"এর আগে একটি কার্টন ইন্ডাস্ট্রি এবং একটি পেপার ইন্ডাস্ট্রি করতে চাই। কার্টন ও পেপার বিদেশে রপ্তানি হবে। কার্টন ইন্ডাস্ট্রির কাজ ২০২৩ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিক নাগাদ শেষ করতে চাই। এর পরের বছরই পেপার ইন্ডাস্ট্রি বাজারে আসবে", যোগ করেন তিনি। 

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের কোম্পানিতে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশা করছেন মনোয়ার হোসেন।

অল্প বয়সেই ব্যবসায় প্রবেশ মনোয়ার হোসেনের

বিদেশে পড়াশোনা করলেও বাবার মতোই অল্প বয়সে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন আনোয়ার গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, "আমি পড়াশোনা করেছি দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে আমি ব্যবসায় যোগ দেই। তবে আমি ক্লাস ফাইভ থেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তখনই বাবা আমাকে তার ব্যবসার ব্রিফকেইসটা দিয়েছিলেন। ক্লাস সেভেনে দোকানে বসেছি। ছুটিতে আসলেই ব্যবসার কাজ করেছি। কারখানায়ও যেতাম।"

"১৯৯৩ সালে আমাকে কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসায় নামিয়ে দেন বাবা। তখন আনোয়ার স্টিলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর তাতে আর কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমিও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসা হারাইনি বা নষ্ট করিনি", যোগ করেন মনোয়ার। 

'গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তভিত আমাদের বাঁচিয়ে দেবে'

করোনা পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে মন্দার মুখে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বাংলাদেশও তাই সাশ্রয়ের দিকে এগোচ্ছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেশে শুরু হয়েছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। এর পাশাপাশি সীমিত করা হয়েছে অনেক পণ্যের আমদানি। 

এরপরেও গ্রামীণ অর্থনীতির শক্ত ভিত আমাদের বাঁচিয়ে দেবে বলে মনে করেন মনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, "আমি অনেক আগেই বলছিলাম যে, কোভিড শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংকট কাটবে না। কোডিভ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলো। সংকটটা ইউরোপ-আমেরিকা থেকেই আসলো। তবে একটি দিক থেকে আমরা ব্যতিক্রম। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে।"

"কোভিডের শুরুতে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব যখন কল কারখানা বন্ধ করে দিল, তখনও দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি সচল ছিল। আমাদের কৃষি আমাদের রক্ষা করেছে। গ্রামীণ পোল্ট্রি, পশু পালন ও মৎসচাষ আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে", যোগ করেন মনোয়ার।

কোন মন্তব্য নেই: