দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং | Aarong - Textile Lab | Textile Learning Blog
দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং
স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না, বড় হতেই থাকে
দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কাজ করে চলেছে দেশের প্রান্তিক কারুশিল্পীদের নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীবনযাপন, তৃণমূলের কারু ও হস্তশিল্পের উন্নয়নেও উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন এনেছে আড়ং। ১৯৭৮ সাল থেকে বর্তমান—আড়ংয়ের এগিয়ে চলার গল্প বলেছেন ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সহসম্পাদক রয়া মুনতাসীর।

ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ
ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদছবি: সুমন ইউসুফ
প্রথম আলো: কী লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে আড়ংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল?

তামারা হাসান আবেদ: স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না, বড় হতেই থাকে। ফজলে হাসান আবেদ যখন আড়ং শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং সেটার পাশাপাশি ব্র্যাক সেরিকালচারের কাজ এগিয়ে নেওয়া। ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জে ব্র্যাক সেরিকালচারের (রেশম গুটিপোকা চাষ) কাজ শুরু হয়। সেরিকালচারের মাধ্যমে তুঁতগাছ খেয়ে রেশমের পোকার কোকুন করা, সুতা বানানো—এই পুরো প্রক্রিয়াটি শ্রমনির্ভর কাজ। এই কাজগুলোর মাধ্যমে নারীদের আয়ের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেখেছিলেন কীভাবে চীন, থাইল্যান্ড ও জাপান তাদের সিল্কশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বা তার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে তিনি দেশের বাইরেও সেরিকালচারকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি এটাও চেয়েছিলেন যে আড়ং এমন একটি জায়গা হবে, যেখানে নারীরা তাঁদের তৈরি পণ্য সরবরাহ করার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পেয়ে যাবেন। বেশির ভাগ দোকানে পণ্য বিক্রির পর কারুশিল্পীদের টাকা পরিশোধ করা হতো। ফজলে হাসান আবেদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পণ্য বিক্রি করার দায়িত্ব আমাদের। এটাতে যেন কারুশিল্পীরা ভুক্তভোগী না হন। পাওনা টাকার জন্য যেন তাঁদের অপেক্ষা করতে না হয়। এই চিন্তা থেকেই পণ্য বিক্রির জন্য ব্র্যাক নিজস্ব বিক্রির শাখা বানায়। এর মাধ্যমে পণ্য বানানো থেকে শুরু করে বিক্রির পুরো প্রক্রিয়টি ব্র্যাক নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অন্য কারও ওপর ভরসা না করে। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আড়ং ৪৩ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ছিল আড়ং একদিন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হবে। সে স্বপ্ন পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, এই স্বপ্নও আমরা পূরণ করতে পারব।

✅ একনজরে আড়ং:

প্রতিষ্ঠা: ১৯৭৮

প্রতিষ্ঠাতা: স্যার ফজলে হাসান আবেদ

কর্মিসংখ্যা: ৩ হাজার

উৎপাদক ও কারুশিল্পী: ৬৫ হাজার

কত ধরনের পণ্য বিক্রি করে: ১২০ ধরনের বেশি

বিক্রয়কেন্দ্র: ২২

ঢাকায় ১২টি

চট্টগ্রামে ২টি

ঢাকার বাইরে শাখা: ৮টি (সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোর ও রংপুর)

নতুন শাখা (আসন্ন): ফেনী

বার্ষিক লেনদেন: ১ হাজার কোটি টাকা (২০১৯ সাল)

প্রথম আলো: আড়ংকে পরিবর্তনের ধারক বলা হয়। আড়ং কোন কোন ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে?

তামারা হাসান আবেদ: আমার মনে হয়, আড়ং কিছু নতুন বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একদম শুরু থেকে যদি বলি, এ ধরনের দোকানই বাংলাদেশে ছিল না তখন। মেয়েরা দোকানে পণ্য বিক্রির কাজ করছে, এটাও নতুন ভাবনা ছিল। নির্দিষ্ট দামের দোকানও ছিল না কোনো। কেনার পর পণ্য বদলানোর সুযোগও আমরা করে দিই। যেকোনো পণ্য কেনার পর পছন্দ না হলে সেটা ৩০ দিনের মধ্যে বদলানো যাবে। পণ্য বিক্রয়ের পাশাপাশি উপহার দেওয়ার জন্য আড়ং গিফট ভাউচার চালু করা হয়। আমি সত্তরের দশকের কথা বলছি। তখন এসব বিষয় নতুন ধারণা ছিল আমাদের দেশে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে আড়ং যেভাবে ঈদ, নববর্ষের আগে ফটোশুট, ফ্যাশন শো করত, সেগুলোও নতুন ছিল। নকশিকাঁথা, জামদানির মতো বাংলাদেশি কারুশিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বিকাশ, প্রচার ও সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি ফ্যাশনশিল্প প্রতিষ্ঠাতে অবদান রেখেছে আড়ং। ২০০৩ সালে আমরা ‘তাগা’ আনলাম আড়ংয়ের সাব-ব্র্যান্ড হিসেবে। এরপর দেখলাম অন্য অনেকেই নিজেদের দোকানে দেশীয় পোশাকের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাক আনছেন। ফ্ল্যাগশিপ স্টোর বাংলাদেশে আড়ংই প্রথম করেছে। পাশ্চাত্যে এগুলো আছে। তবে দেশের ক্রেতাদের এই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আড়ং।

প্রথম আলো: আড়ংয়ে আপনার যোগ দেওয়ার গল্পটা জানতে চাই।

তামারা হাসান আবেদ: আমি একা তো কিছু করি না। এটা একটা টিম ওয়ার্ক। ২০০২ সালে আমি আড়ংয়ে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দিই। তখন মনে হলো বাংলাদেশের অনেক নারী ফতুয়া পরার দিকে ঝুঁকছে। রোজ কাজে যেতে হচ্ছে। রিকশায়, বাসে ওঠার সুবিধার জন্য আরেকটু আরামদায়ক পোশাকের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। তখন আমরা তাগা আনলাম। প্রথম থেকেই বেশ সাড়া ফেলেছিল তাগা। কারণ, তখন দেশি ও পাশ্চাত্য ধাঁচের মিশেলে তৈরি পোশাকগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। এ রকম নানা নতুন নতুন প্রোডাক্ট লাইন এবং ক্যাটাগরি আড়ং বছরের পর বছর বাজারে এনেছে। আমরা ডিজাইন থেকে শুরু করে বিক্রয়, ব্যবস্থাপনা, ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া নেওয়া এবং তাদের আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা—সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ২০১৭ সালে নারীদের জন্য এক্সক্লুসিভ ডিজাইনার লাইন ‘হারস্টোরি বাই আড়ং’ চালু করেছি। ২০১৮ সালে আমরা আরেকটি সাব–ব্র্যান্ড ‘তাগা ম্যান’ চালু করেছি। ২০১৪ সালে আমরা আমাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মও চালু করেছি। ২০২১ সালে আমরা হারবাল স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড ‘আড়ং আর্থ’ চালু করি।

প্রথম আলো: আড়ংয়ের পণ্য তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাব কত মানুষ জড়িত?

তামারা হাসান আবেদ: আড়ংয়ের বিভিন্ন কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক মানুষ জড়িত। কর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। এর বাইরে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কারুশিল্পী, স্বাধীন উৎপাদক ও তাঁদের অধীনে কাজ করছেন, এমন কারুশিল্পীর সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা পণ্য বানিয়ে আনি। নরসিংদী থেকে সুতি কাপড় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে সিল্কের কাপড় তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইলে শাড়ি, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনায় শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি করা হয়। জামালপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও শেরপুরে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করানো হয়। চট্টগ্রাম, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামেও আমাদের উৎপাদনকেন্দ্র আছে।

আমরা আমাদের কারুশিল্পীদের কাজের মানোন্নয়নের জন্য ক্রমাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া তাঁদের হিসাবরক্ষণ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের নিজস্ব উৎপাদনকেন্দ্রে কর্মরত কারুশিল্পীদের জন্য আমরা স্বাস্থ্যনিরাপত্তা স্কিম গঠন করেছি। এতে কারুশিল্পীদের পাশাপাশি তাঁদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরা জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় সহায়তা পেয়ে থাকেন। কারুশিল্পীরা অবসরকালীন গ্র্যাচুইটির সুবিধাও পান। কর্মস্থলে চিকিৎসাসেবা, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা এবং শিশুদের জন্য ডে–কেয়ার সেবার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া কারুশিল্পীরা ব্র্যাকের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে যেমন ক্ষুদ্রঋণ, মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার সচেতনতা, আইনি সহায়তা, এমনকি বাড়িতে ল্যাট্রিন স্থাপনের জন্য সহায়তা পেয়ে থাকেন। কারুশিল্পীদের সন্তানরা যেন স্কুলে যায়, খেয়াল রাখা হয় সেদিকেও। সব উৎপাদকদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদকেরা জরুরি প্রয়োজনে সহায়তা পান। প্রয়োজনে উৎপাদকদের আমরা ঋণ দিই। আমাদের উৎপাদকদের উৎপাদনকেন্দ্রে কর্মরত কর্মীদের স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সঠিক মজুরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে আমরা পর্যায়ক্রমে উৎপাদনকেন্দ্রে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা করি।

প্রথম আলো: করোনা মহামারির সময়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

তামারা হাসান আবেদ: করোনার এই সময়টা আমাদের সবার জন্যই কঠিন ছিল। আমরা আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির চেয়ে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারুশিল্পী ও উৎপাদকদের ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাদের কারুশিল্পীদের ৩০ মাসের জন্য ‍ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা সাধারণত সর্বোচ্চ ১২ মাসের জন্য দেওয়া হয়। প্রথম ছয় মাস ঋণ প্রদানের কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। পরবর্তী দুই বছর কোনো সুদ নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের উৎপাদকদের কাছে যে পণ্যের অর্ডার ছিল, তার জন্য তাঁদের অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই পণ্য পর্যায়ক্রমে নিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কর্মীদের অগ্রিম বেতন দেওয়া হয়েছে, যা ধীরে ধীরে পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করা হবে। করোনাকালে এই কর্মীদের ব্র্যাকের তহবিল থেকে এককালীন দেড় হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। উৎপাদকদের পণ্যের বিক্রয় বাড়ানোর জন্য মহামারির সময়েও আমরা যশোর ও রংপুরে নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছি। বনানী ও গুলশান শাখা দুটি বৃহৎ পরিসরে নতুন স্থানে স্থানান্তর করেছি। এ ছাড়া কারুশিল্পী ও উৎপাদকদের নতুন কাজ নিশ্চিত করার জন্য গত বছর আমরা একটি বড় মূল্যছাড়ে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করি।

প্রথম আলো: বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশি পণ্য কেনাকাটার জন্য আড়ংয়ে যান। কোন ধরনের পণ্য তাঁরা বেশি কেনেন?

তামারা হাসান আবেদ: পর্যটকেরা মূলত নকশিকাঁথার নকশা আছে, এমন পণ্য বেশি কেনেন। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের স্যুভেনির, যেমন পিতলের নৌকা, রিকশা ও অন্যান্য পণ্য, দেশি পুতুল, টি-শার্ট, চাবির রিং ইত্যাদি কিনে থাকেন। চীনা পর্যটকেরা যেমন মুক্তার গয়না বেশি কেনেন।

প্রথম আলো: তিন-চার দশক আগেও বিদেশি পর্যটক আর উচ্চবিত্তেরাই ছিলেন আড়ংয়ের মূল ক্রেতা। এখন তো আড়ংয়ের পণ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কিনছেন। এটাকে কীভাবে দেখেন?

তামারা হাসান আবেদ: বিষয়টি খুব ইতিবাচক। এর মানে আড়ং মূলধারার ব্র্যান্ড হতে পেরেছে। আপনি আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে কী করতে চান, সেটার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাদের প্রথম থেকেই বড় পরিসরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কারণ, এতে কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা বাড়বে। ব্র্যান্ড যত বড় হবে, আমরাও তত বেশি মানুষকে কাজ দিতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি দেশীয় রুচি তৈরি করার ক্ষেত্রেও আড়ং অবদান রেখেছে। এটা না হলে আড়ং এ পর্যন্ত আসত না। কারুশিল্প নিয়ে পৃথিবীতে এত বড় পরিসরে আর কেউ কাজ করেনি।

প্রথম আলো: ঈদ, বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন উপলক্ষে আড়ং থিমভিত্তিক ডিজাইন নিয়ে আসে। এই সব ডিজাইন কি আন্তর্জাতিক ফ্যাশনধারা অনুসরণ করে করা হয়, নাকি দেশজ বিষয় ধরে করা হয়?

তামারা হাসান আবেদ: ইউরোপ অথবা আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলোর নতুন নকশা কমবেশি সব দেশই অনুসরণ করে। এই সব ব্র্যান্ড পাক্ষিক ফ্যাশন শো আয়োজনের মাধ্যমে নতুন ফ্যাশনধারা প্রবর্তন করে। এ ছাড়া ফ্যাশন ফোরকাস্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন রং, নকশা, কাট ইত্যাদি প্রবর্তন করে। বর্তমানে পোশাকের হাতায় ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, নিয়ে আসা হচ্ছে বৈচিত্র্য। এগুলো পাশ্চাত্যের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত। বাইরের দেশের নকশাগুলো থেকে আমরা চিন্তাশীল উপায়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই নকশাগুলো বাছাই করে চলতি ধারার কাটে ও ধাঁচে দেশি কাপড় এবং দেশজ ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট এবং অন্যান্য কাজ সংযোজন করে আমাদের কালেকশনগুলো সাজাই বছরজুড়ে।

প্রথম আলো: আড়ংয়ের কোন পণ্যগুলো বিক্রি হয় বেশি? এখন কয় ধরনের পণ্য বিক্রি করা হয়? পুরো দেশে আড়ংয়ের শাখা কয়টি?

তামারা হাসান আবেদ: আড়ংয়ে ২২টি ক্যাটাগরিতে প্রায় ১২০ ধরনের পণ্য বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ক্রেতারা পোশাক কেনেন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ২২টি শাখা রয়েছে আড়ংয়ের। কিছুদিনের মধ্যে ২৩ নম্বর শাখা ফেনীতে চালু হবে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ১২টি, চট্টগ্রামে ২টি, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, রংপুরে ১টি করে শাখা রয়েছে আমাদের। দেশের সব শাখাতেই একই রকম পণ্য বিক্রি হয়।

প্রথম আলো: কোভিড–পরবর্তী ‘নতুন স্বাভাবিক (নিও নরমাল)’ সময়ের জন্য আড়ংয়ের পরিকল্পনা কী?

তামারা হাসান আবেদ: করোনার সময় আমাদের জীবনে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে অনলাইনে বসে কেনাকাটা করা। মানুষও এখন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ধীরে ধীরে অনলাইনে কেনাকাটার সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়েছে। আগামী কয়েক বছর বিষয়টি নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এ ছাড়া আমাদের ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে মনোযোগ থাকবে। পরিবেশগত স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। এই লক্ষ্যে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি, যা আমাদের ক্রেতারা শিগগিরই উপলব্ধি করবেন।

প্রথম আলো: ১০ বছর পর আড়ংকে কোন জায়গায় দেখতে চান?

তামারা হাসান আবেদ: ১০ বছর পর আড়ংকে একটি সফল গ্লোবাল ক্রাফট ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই এবং সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তামারা হাসান আবেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং | Aarong

দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং
স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না, বড় হতেই থাকে
দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কাজ করে চলেছে দেশের প্রান্তিক কারুশিল্পীদের নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীবনযাপন, তৃণমূলের কারু ও হস্তশিল্পের উন্নয়নেও উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন এনেছে আড়ং। ১৯৭৮ সাল থেকে বর্তমান—আড়ংয়ের এগিয়ে চলার গল্প বলেছেন ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সহসম্পাদক রয়া মুনতাসীর।

ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ
ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদছবি: সুমন ইউসুফ
প্রথম আলো: কী লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে আড়ংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল?

তামারা হাসান আবেদ: স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না, বড় হতেই থাকে। ফজলে হাসান আবেদ যখন আড়ং শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং সেটার পাশাপাশি ব্র্যাক সেরিকালচারের কাজ এগিয়ে নেওয়া। ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জে ব্র্যাক সেরিকালচারের (রেশম গুটিপোকা চাষ) কাজ শুরু হয়। সেরিকালচারের মাধ্যমে তুঁতগাছ খেয়ে রেশমের পোকার কোকুন করা, সুতা বানানো—এই পুরো প্রক্রিয়াটি শ্রমনির্ভর কাজ। এই কাজগুলোর মাধ্যমে নারীদের আয়ের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেখেছিলেন কীভাবে চীন, থাইল্যান্ড ও জাপান তাদের সিল্কশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বা তার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে তিনি দেশের বাইরেও সেরিকালচারকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি এটাও চেয়েছিলেন যে আড়ং এমন একটি জায়গা হবে, যেখানে নারীরা তাঁদের তৈরি পণ্য সরবরাহ করার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পেয়ে যাবেন। বেশির ভাগ দোকানে পণ্য বিক্রির পর কারুশিল্পীদের টাকা পরিশোধ করা হতো। ফজলে হাসান আবেদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পণ্য বিক্রি করার দায়িত্ব আমাদের। এটাতে যেন কারুশিল্পীরা ভুক্তভোগী না হন। পাওনা টাকার জন্য যেন তাঁদের অপেক্ষা করতে না হয়। এই চিন্তা থেকেই পণ্য বিক্রির জন্য ব্র্যাক নিজস্ব বিক্রির শাখা বানায়। এর মাধ্যমে পণ্য বানানো থেকে শুরু করে বিক্রির পুরো প্রক্রিয়টি ব্র্যাক নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অন্য কারও ওপর ভরসা না করে। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আড়ং ৪৩ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ছিল আড়ং একদিন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হবে। সে স্বপ্ন পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, এই স্বপ্নও আমরা পূরণ করতে পারব।

✅ একনজরে আড়ং:

প্রতিষ্ঠা: ১৯৭৮

প্রতিষ্ঠাতা: স্যার ফজলে হাসান আবেদ

কর্মিসংখ্যা: ৩ হাজার

উৎপাদক ও কারুশিল্পী: ৬৫ হাজার

কত ধরনের পণ্য বিক্রি করে: ১২০ ধরনের বেশি

বিক্রয়কেন্দ্র: ২২

ঢাকায় ১২টি

চট্টগ্রামে ২টি

ঢাকার বাইরে শাখা: ৮টি (সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোর ও রংপুর)

নতুন শাখা (আসন্ন): ফেনী

বার্ষিক লেনদেন: ১ হাজার কোটি টাকা (২০১৯ সাল)

প্রথম আলো: আড়ংকে পরিবর্তনের ধারক বলা হয়। আড়ং কোন কোন ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে?

তামারা হাসান আবেদ: আমার মনে হয়, আড়ং কিছু নতুন বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একদম শুরু থেকে যদি বলি, এ ধরনের দোকানই বাংলাদেশে ছিল না তখন। মেয়েরা দোকানে পণ্য বিক্রির কাজ করছে, এটাও নতুন ভাবনা ছিল। নির্দিষ্ট দামের দোকানও ছিল না কোনো। কেনার পর পণ্য বদলানোর সুযোগও আমরা করে দিই। যেকোনো পণ্য কেনার পর পছন্দ না হলে সেটা ৩০ দিনের মধ্যে বদলানো যাবে। পণ্য বিক্রয়ের পাশাপাশি উপহার দেওয়ার জন্য আড়ং গিফট ভাউচার চালু করা হয়। আমি সত্তরের দশকের কথা বলছি। তখন এসব বিষয় নতুন ধারণা ছিল আমাদের দেশে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে আড়ং যেভাবে ঈদ, নববর্ষের আগে ফটোশুট, ফ্যাশন শো করত, সেগুলোও নতুন ছিল। নকশিকাঁথা, জামদানির মতো বাংলাদেশি কারুশিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বিকাশ, প্রচার ও সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি ফ্যাশনশিল্প প্রতিষ্ঠাতে অবদান রেখেছে আড়ং। ২০০৩ সালে আমরা ‘তাগা’ আনলাম আড়ংয়ের সাব-ব্র্যান্ড হিসেবে। এরপর দেখলাম অন্য অনেকেই নিজেদের দোকানে দেশীয় পোশাকের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাক আনছেন। ফ্ল্যাগশিপ স্টোর বাংলাদেশে আড়ংই প্রথম করেছে। পাশ্চাত্যে এগুলো আছে। তবে দেশের ক্রেতাদের এই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আড়ং।

প্রথম আলো: আড়ংয়ে আপনার যোগ দেওয়ার গল্পটা জানতে চাই।

তামারা হাসান আবেদ: আমি একা তো কিছু করি না। এটা একটা টিম ওয়ার্ক। ২০০২ সালে আমি আড়ংয়ে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দিই। তখন মনে হলো বাংলাদেশের অনেক নারী ফতুয়া পরার দিকে ঝুঁকছে। রোজ কাজে যেতে হচ্ছে। রিকশায়, বাসে ওঠার সুবিধার জন্য আরেকটু আরামদায়ক পোশাকের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। তখন আমরা তাগা আনলাম। প্রথম থেকেই বেশ সাড়া ফেলেছিল তাগা। কারণ, তখন দেশি ও পাশ্চাত্য ধাঁচের মিশেলে তৈরি পোশাকগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। এ রকম নানা নতুন নতুন প্রোডাক্ট লাইন এবং ক্যাটাগরি আড়ং বছরের পর বছর বাজারে এনেছে। আমরা ডিজাইন থেকে শুরু করে বিক্রয়, ব্যবস্থাপনা, ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া নেওয়া এবং তাদের আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা—সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ২০১৭ সালে নারীদের জন্য এক্সক্লুসিভ ডিজাইনার লাইন ‘হারস্টোরি বাই আড়ং’ চালু করেছি। ২০১৮ সালে আমরা আরেকটি সাব–ব্র্যান্ড ‘তাগা ম্যান’ চালু করেছি। ২০১৪ সালে আমরা আমাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মও চালু করেছি। ২০২১ সালে আমরা হারবাল স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড ‘আড়ং আর্থ’ চালু করি।

প্রথম আলো: আড়ংয়ের পণ্য তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাব কত মানুষ জড়িত?

তামারা হাসান আবেদ: আড়ংয়ের বিভিন্ন কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক মানুষ জড়িত। কর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। এর বাইরে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কারুশিল্পী, স্বাধীন উৎপাদক ও তাঁদের অধীনে কাজ করছেন, এমন কারুশিল্পীর সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা পণ্য বানিয়ে আনি। নরসিংদী থেকে সুতি কাপড় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে সিল্কের কাপড় তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইলে শাড়ি, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনায় শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি করা হয়। জামালপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও শেরপুরে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করানো হয়। চট্টগ্রাম, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামেও আমাদের উৎপাদনকেন্দ্র আছে।

আমরা আমাদের কারুশিল্পীদের কাজের মানোন্নয়নের জন্য ক্রমাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া তাঁদের হিসাবরক্ষণ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের নিজস্ব উৎপাদনকেন্দ্রে কর্মরত কারুশিল্পীদের জন্য আমরা স্বাস্থ্যনিরাপত্তা স্কিম গঠন করেছি। এতে কারুশিল্পীদের পাশাপাশি তাঁদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরা জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় সহায়তা পেয়ে থাকেন। কারুশিল্পীরা অবসরকালীন গ্র্যাচুইটির সুবিধাও পান। কর্মস্থলে চিকিৎসাসেবা, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা এবং শিশুদের জন্য ডে–কেয়ার সেবার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া কারুশিল্পীরা ব্র্যাকের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে যেমন ক্ষুদ্রঋণ, মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার সচেতনতা, আইনি সহায়তা, এমনকি বাড়িতে ল্যাট্রিন স্থাপনের জন্য সহায়তা পেয়ে থাকেন। কারুশিল্পীদের সন্তানরা যেন স্কুলে যায়, খেয়াল রাখা হয় সেদিকেও। সব উৎপাদকদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদকেরা জরুরি প্রয়োজনে সহায়তা পান। প্রয়োজনে উৎপাদকদের আমরা ঋণ দিই। আমাদের উৎপাদকদের উৎপাদনকেন্দ্রে কর্মরত কর্মীদের স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সঠিক মজুরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে আমরা পর্যায়ক্রমে উৎপাদনকেন্দ্রে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা করি।

প্রথম আলো: করোনা মহামারির সময়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

তামারা হাসান আবেদ: করোনার এই সময়টা আমাদের সবার জন্যই কঠিন ছিল। আমরা আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির চেয়ে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারুশিল্পী ও উৎপাদকদের ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাদের কারুশিল্পীদের ৩০ মাসের জন্য ‍ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা সাধারণত সর্বোচ্চ ১২ মাসের জন্য দেওয়া হয়। প্রথম ছয় মাস ঋণ প্রদানের কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। পরবর্তী দুই বছর কোনো সুদ নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের উৎপাদকদের কাছে যে পণ্যের অর্ডার ছিল, তার জন্য তাঁদের অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই পণ্য পর্যায়ক্রমে নিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কর্মীদের অগ্রিম বেতন দেওয়া হয়েছে, যা ধীরে ধীরে পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করা হবে। করোনাকালে এই কর্মীদের ব্র্যাকের তহবিল থেকে এককালীন দেড় হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। উৎপাদকদের পণ্যের বিক্রয় বাড়ানোর জন্য মহামারির সময়েও আমরা যশোর ও রংপুরে নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছি। বনানী ও গুলশান শাখা দুটি বৃহৎ পরিসরে নতুন স্থানে স্থানান্তর করেছি। এ ছাড়া কারুশিল্পী ও উৎপাদকদের নতুন কাজ নিশ্চিত করার জন্য গত বছর আমরা একটি বড় মূল্যছাড়ে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করি।

প্রথম আলো: বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশি পণ্য কেনাকাটার জন্য আড়ংয়ে যান। কোন ধরনের পণ্য তাঁরা বেশি কেনেন?

তামারা হাসান আবেদ: পর্যটকেরা মূলত নকশিকাঁথার নকশা আছে, এমন পণ্য বেশি কেনেন। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের স্যুভেনির, যেমন পিতলের নৌকা, রিকশা ও অন্যান্য পণ্য, দেশি পুতুল, টি-শার্ট, চাবির রিং ইত্যাদি কিনে থাকেন। চীনা পর্যটকেরা যেমন মুক্তার গয়না বেশি কেনেন।

প্রথম আলো: তিন-চার দশক আগেও বিদেশি পর্যটক আর উচ্চবিত্তেরাই ছিলেন আড়ংয়ের মূল ক্রেতা। এখন তো আড়ংয়ের পণ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কিনছেন। এটাকে কীভাবে দেখেন?

তামারা হাসান আবেদ: বিষয়টি খুব ইতিবাচক। এর মানে আড়ং মূলধারার ব্র্যান্ড হতে পেরেছে। আপনি আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে কী করতে চান, সেটার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাদের প্রথম থেকেই বড় পরিসরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কারণ, এতে কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা বাড়বে। ব্র্যান্ড যত বড় হবে, আমরাও তত বেশি মানুষকে কাজ দিতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি দেশীয় রুচি তৈরি করার ক্ষেত্রেও আড়ং অবদান রেখেছে। এটা না হলে আড়ং এ পর্যন্ত আসত না। কারুশিল্প নিয়ে পৃথিবীতে এত বড় পরিসরে আর কেউ কাজ করেনি।

প্রথম আলো: ঈদ, বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন উপলক্ষে আড়ং থিমভিত্তিক ডিজাইন নিয়ে আসে। এই সব ডিজাইন কি আন্তর্জাতিক ফ্যাশনধারা অনুসরণ করে করা হয়, নাকি দেশজ বিষয় ধরে করা হয়?

তামারা হাসান আবেদ: ইউরোপ অথবা আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলোর নতুন নকশা কমবেশি সব দেশই অনুসরণ করে। এই সব ব্র্যান্ড পাক্ষিক ফ্যাশন শো আয়োজনের মাধ্যমে নতুন ফ্যাশনধারা প্রবর্তন করে। এ ছাড়া ফ্যাশন ফোরকাস্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন রং, নকশা, কাট ইত্যাদি প্রবর্তন করে। বর্তমানে পোশাকের হাতায় ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, নিয়ে আসা হচ্ছে বৈচিত্র্য। এগুলো পাশ্চাত্যের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত। বাইরের দেশের নকশাগুলো থেকে আমরা চিন্তাশীল উপায়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই নকশাগুলো বাছাই করে চলতি ধারার কাটে ও ধাঁচে দেশি কাপড় এবং দেশজ ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট এবং অন্যান্য কাজ সংযোজন করে আমাদের কালেকশনগুলো সাজাই বছরজুড়ে।

প্রথম আলো: আড়ংয়ের কোন পণ্যগুলো বিক্রি হয় বেশি? এখন কয় ধরনের পণ্য বিক্রি করা হয়? পুরো দেশে আড়ংয়ের শাখা কয়টি?

তামারা হাসান আবেদ: আড়ংয়ে ২২টি ক্যাটাগরিতে প্রায় ১২০ ধরনের পণ্য বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ক্রেতারা পোশাক কেনেন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ২২টি শাখা রয়েছে আড়ংয়ের। কিছুদিনের মধ্যে ২৩ নম্বর শাখা ফেনীতে চালু হবে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ১২টি, চট্টগ্রামে ২টি, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, রংপুরে ১টি করে শাখা রয়েছে আমাদের। দেশের সব শাখাতেই একই রকম পণ্য বিক্রি হয়।

প্রথম আলো: কোভিড–পরবর্তী ‘নতুন স্বাভাবিক (নিও নরমাল)’ সময়ের জন্য আড়ংয়ের পরিকল্পনা কী?

তামারা হাসান আবেদ: করোনার সময় আমাদের জীবনে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে অনলাইনে বসে কেনাকাটা করা। মানুষও এখন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ধীরে ধীরে অনলাইনে কেনাকাটার সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়েছে। আগামী কয়েক বছর বিষয়টি নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এ ছাড়া আমাদের ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে মনোযোগ থাকবে। পরিবেশগত স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। এই লক্ষ্যে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি, যা আমাদের ক্রেতারা শিগগিরই উপলব্ধি করবেন।

প্রথম আলো: ১০ বছর পর আড়ংকে কোন জায়গায় দেখতে চান?

তামারা হাসান আবেদ: ১০ বছর পর আড়ংকে একটি সফল গ্লোবাল ক্রাফট ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই এবং সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তামারা হাসান আবেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই: