কেনাফ ফাইবার কি এবং এর ব্যাবহার | Kenaf Fibre - Textile Lab | Textile Learning Blog
কেনাফ ফাইবার | Kenaf Fibre 
কেনাফ পাটের ন্যায় পরিবেশবান্ধব আঁশ জাতীয় ফসল। উষ্ণমন্ডলীয় ও অবউষ্ণ দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান প্রধান জেলা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে কেনাফ ও মেস্তা চাষ হয়েছে এবং ৩ লাখ ৩৭ হাজার বেল আঁশ উৎপাদিত হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের অনেক এলাকাতেই কেনাফ আঞ্চলিক ভাষায় মেস্তা হিসেবে পরিচিত।

চলতি ২০১৮-১৯ পাট উৎপাদন মৌসুমে ৮ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট ও কেনাফ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যায়িত মানের ১০৫৩ টন কেনাফ বীজ আমদানি করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত কেনাফ বীজ সঠিক সময়ে আবাদ করা সম্ভব হলে এ বছর কর্তিত জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে।

মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘পস্নাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। কেনাফ আঁশ থেকে কাগজের পাল্প বা মন্ড তৈরি করে নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, কেনাফ খড়ি হার্ডবোর্ড বা পার্টেক্স মিলের কাঁচামাল ও চারকোল তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। তা ছাড়া কেনাফ খড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং বীজ থেকে ঔষধি গুণ সম্পন্ন তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের মন্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূলবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়।

কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে কাগজের মন্ড, বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, পেস্নন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড় চোপড় জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনসু্যলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাস্তব প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে উর্বর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং পাট স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রান্তিক ও অপ্রচলিত (লবণাক্ত, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল) জমিতে। তা ছাড়া নগরায়ন, শিল্পায়ান ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতি বছর প্রায় ০.৭% হারে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। কিন্তু দেশের দক্ষিণের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ততা ও খরা প্রবণ এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে পাট উৎপাদন মৌসুমে (মার্চ-জুলাই) কোনো ফসল থাকে না বললেই চলে। খুলনার কিছু কিছু এলাকায় তিল চাষ হলেও বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি রয়েছে।

উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরা ও এক ফসলি আমন পরবর্তী পতিত জমিতে অথবা চর এলাকায় কেনাফ চাষের সম্ভাবনা ও উৎপাদিত বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপিস্নন বিভাগের গবেষক দল। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাট চাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএস/মি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।

গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং আঁশ থেকে কাগজের মন্ড ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন গবেষক দল। অনুরূপভাবে বিজেআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।

কেনাফ এর চাষ প্রনলী:

জমিঃ পললভূমির উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি, চালা ও পাহাড়ি ঢালু জমি কেনাফ চাষের উপযোগী। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় কেনাফের আবাদ করা যেতে পারে। তবে, মাঝারি থেকে গভীরভাবে প্লাবিত জমি এবং অধিক কর্দম কনা সমৃদ্ধ এটেল মাটি কেনাফ চাষের জন্য উপযোগী নয়। যে সকল অনুর্বর ভূমিতে পাট কিংবা আউশ ফসলের আবাদ করা যায় না, সেখানে স্বল্প  যতে কেনাফ আবাদ করে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

জাতঃ 
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এইচসি-২, এইচসি-৯৫ ও বিজেআরআই কেনাফ-৩ নামক তিনটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে এইচসি-২ জাতের কেনাফের চাষ প্রণালী নিম্নে তুলে ধরা হল-

এইচসি-২ জাতটি ‘জলি কেনাফ’ নামেও পরিচিত। গাছের উচ্চতা কম-বেশি ৬ মিটার। ফুল হলদে রংয়ের। ফল ডিম্বাকৃতি, যা পাকার পরে ফেটে যায়। বীজ ত্রিকোণাকৃতির, কালচে খয়েরী বর্ণের।  ১৪০-১৫০ দিনে আঁশ ফসল ফসল কাটা যায়। বীজ থেকে শতকরা ২০ ভাগ ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। এ জাতটি আলোক সংবেদনশীল অর্থাৎ ফুল আসা ও পরিপক্কতা বপন সময়ের উপর নির্ভরশীল।

বপনকালঃ 
আঁশ উৎপাদনের জন্য চৈত্র মাসের শুরু থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি নাগাদ বীজ বপন করা যায়। বীজ উৎপাদনের জন্য শ্রাবন-ভাদ্র মাসে বীজ বপন করা হয়। তবে বীজের জন্য ভাদ্র মাসে বপন করা হলে আশ্বিন বা কার্তিকের বৃষ্টি থেকে  বীজ ফসল রা পায় এবং উৎকৃষ্ট মানের বীজ পাওয়া যায়।



জমি প্রস্তুতঃ 
কেনাফ বীজের আকার বড় হওয়ায় চাষ দিয়ে মাটি তত মিহি না করলেও চলে। এর শিকড় মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে। তাই গভীর চাষ দিলে ভালো। মাটির প্রকৃতিভেদে ২-৩ বার চাষ ও মই দিতে হয়। পাহাড়ী ঢালু জমি কর্ষণের আবশ্যকতা নেই। উত্তমরূপে আগাছা বাছাই করতে হবে। বীজ সারিতে কিংবা ছিটিয়ে বপন করা হয়। ৩০ সেমি পর পর সারি করে বীজ বুনতে হয়। সারিতে বপন করলে ১১-১২ কেজি এবং ছিটিয়ে বপন করলে ১২-১৪ কেজি বীজ প্রয়োজন। রোগ জীবাণুমুক্ত ভালো মানের বীজ ব্যবহার করা আবশ্যক। প্রয়োজনে বীজ শোধন করে নেওয়া যেতে পারে।



সার প্রয়োগঃ 
মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে কিংবা উপজেলা নির্দেশিকা থেকে মাটির উর্বরতামান জেনে পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হবে। একান্ত সম্ভব না হলে হেক্টরপ্রতি ১৩২ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি ও ৪০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। জৈব সার প্রয়োগ করা উত্তম। হেক্টর প্রতি ৩-৫ টন গোবর করা যেতে পারে। প্রতি টন গোবরের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ৮ কেজি টিএসপি ও ৬ কেজি এমওপি কম প্রয়োগ করতে হবে। গোবর কিংবা অন্যান্য জৈব সার, অর্ধেক ইউরিয়া, সমুদয় টিএসপি ও এমওপি জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করে অবশিষ্ট ইউরিয়া বীজ বপনের ৪৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরপর মাটি আলোড়িত করে দেয়া আবশ্যক ।



পরিচর্যাঃ 
পাটের চেয়ে কেনাফ চাষে  অনেক কম পরিচর্যা দরকার হয়। চারা গজানোর পর সময়মত নিড়ানী ও গাছ পাতলা করে দিতে হয়। চারা গাছের বৃদ্ধির প্রথম দিকে জমি অবশ্যই  আগাছামুক্ত রাখতে হবে।



আঁশ সংগ্রহঃ 
চার মাস পর থেকে সুবিধাজনক সময়ে ফসল কাটা যায়। তবে, কেনাফ গাছে ফুল আসলেও গাছের বৃদ্ধি থেমে যায় না। তাই আঁশ উৎপাদনের জন্য সম্ভব হলে পাঁচ মাস বয়সে ফসল কাটা হলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। আঁশ ফসলের জন্য পাটের ন্যায় সরু ও মোটা গাছ পৃথক করে আঁটি বেঁধে পাতা ঝরিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। জাঁক কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ভালো। পরিষ্কার পানিতে আঁশ ধুয়ে বাঁশের আড়ায় শুকাতে হবে। এইচসি-২ জাতটি হেক্টরপ্রতি ৬.৮ টন পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে। আঁশের জন্য এই জাতের কেনাফ ১৪০-১৫০ দিনে কর্তন করা যায়।



কাগজ শিল্পের পাল্প তৈরিঃ 
পাল্প তৈরির জন্য কিংবা কেনাফ কান্ড খুটি হিসাবে ব্যবহার করতে হলে ফুল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম। কাগজের পাল্প তৈরির ক্ষেত্রে কর্তিত কেনাফ হালকা আঁটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়।

বীজ সংগ্রহঃ 
কেনাফ ফল কিছুটা কাঁটাযুক্ত। বীজের জন্য ফসল কেটে ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নিলে ফলগুলো ফেটে যায়। অতঃপর লাঠি দিয়ে মারিয়ে সহজেই বীজ সংগ্রহ করা যায়।

বীজ শুকানোঃ 
কেনাফ বীজ সরাসরি পাকা মেঝে কিংবা ভিজা মাটিতে রেখে শুকানো অনুচিৎ। তাতে বীজের সজীবতা নষ্ট হয়। পাকা মেঝের উপর পলিথিন বা পাটের বস্তা বিছিয়ে বীজ শুকাতে হবে। পাকা মেঝে না থাকলে গোবর দিয়ে লেপে মাটিতে বীজ শুকানো যেতে পারে। শুকানো কয়েকটি বীজ দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে কট করে শব্দ করে ভেঙে গেলে বুঝা যাবে বীজ কাংখিত পর্যায়ে শুকিয়েছে।

বীজ সংরক্ষণঃ 
কেনাফের বীজ পাটের তুলনায় আদ্রতাকাতর। তাই শুকানো বীজ ঠান্ডা করে পলিথিন মুড়িয়ে প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে মুখ ভলোভাবে বন্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

বাংলাদেশে কেনাফ চাষের ক্ষেত্র ও সম্ভাবনাঃ

কেনাফ একটি পরিবেশ বান্ধব অর্থকরী ফসল। বায়ুমন্ডল থেকে অধিক পরিমাণে ঈঙ২ শোষণ ক্ষমতা এবং এর বহুমুখী ব্যবহারের কারণে কেনাফের পরিচিতি ও সমাদর বিশ্বজুড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে পাটের আবাদ হয়ে আসছে। এদেশে কেনাফ কে পাটের বিকল্প হিসাবে নয় বরং পরিবেশ বান্ধব এই অর্থকরী ফসলটিকে পাটের পরিপূরক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেনাফ মোটামুটি বিরূপ পরিবেশে স্বল্প যতেœ জন্মানো ফসল। যে সকল প্রান্তিক ভূমি পাট কিংবা আউশ ফসল আবাদের উপযোগী নয়  তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ কেনাফ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এর ফলে দেশের ভূমি ব্যবহার বা ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। ফলে অধিক আঁশ উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। পাহাড়ী অঞ্চলের কম উর্বর পতিত জমিতে অর্থকরী ফসল কেনাফের চাষ প্রবর্তন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে হলেও ংঁনংরং:বহপব কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষির ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের যে সব জমিতে আউশ ধানের আবাদ সম্ভব হয় না, সেখানে কেনাফ আবাদের সম্ভাব্যতা যাচাই করা আবশ্যক। পাটের চেয়ে কম খরচে কেনাফ উৎপাদন করা যায়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সফলতা আসছে না। এমন বাস্তবতায় কেনাফজাত আঁশ থেকে স্বল্প মূল্যের ব্যাগ তৈরি করে তা ব্যবহারে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা গেলে পরিবেশের বিপর্যয় রোধে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। কেনাফ থেকে উৎপাদিত নানা ধরণের পণ্য ও কাঁচামাল উন্নত দেশে রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

কেনাফ চাষ সম্প্রসারণে করণীয়ঃ

কেনাফের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়ে বহির্বিশ্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেনাফ থেকে লাভজনকভাবে নানা রকমের পণ্য উৎপাদনে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পন্য মেলা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির আয়োজন করে  কেনাফ শিল্পের লাভজনক দিক তুলে ধরে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে হবে।

অনাবাদী যে সকল জমি কেনাফ চাষের উপযোগী তা কেনাফ চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহন  এবং নিকটবর্তী এলাকায় কেনাফ প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করা।



বিচ্ছিন্নভাবে কেনাফ আবাদের পরিবর্তে চিনিকল কিংবা পাটকল এলাকার ন্যায় জোন বা অঞ্চল ভিত্তিক আবাদ করে ঐ এলাকায় মিলিং সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে এ শিল্পের ফরোয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তোলা। নিকটবর্তী স্থান থেকে কাঁচামাল সরবরাহের ফলে পরিবহন খরচ হ্রাস পাবে। ফলে একদিকে কৃষক লাভবান হবে অপরদিকে কেনাফজাত শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে।

দেশে বিদ্যমান যে সব কাগজের মিল কাঁচামালের অভাবে বন্ধ রয়েছে কিংবা যে সকল মিলে পর্যাপ্ত কাঁচামালের সরবরাহ নেই সেক্ষেত্রে বিকল্প কাঁচামাল হিসাবে  কেনাফ  ব্যবহার করা।

কেনাফ চাষী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা।

কেনাফ চাষীদের আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্বল্প মূল্যে মানসম্মত বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করা।

বিদেশে কেনাফজাত পণ্যের বাজার অনুসন্ধানসহ অনুকূল রপ্তানী বাণিজ্যের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব রকমের সরকারি  সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত রাখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উঁচু, মধ্যম, নিচু, হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চল ফসলে উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয় এমন অনুর্বর জমিতেও অল্প পরিচর্যায় কেনাফ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশে যে সব এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই সেখানে ধানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ চাষ কৃষকের প্রথম পছন্দ। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ হেক্টর জমি আছে যেখানে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পাট ও কেনাফ ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষ সম্ভব নয়। পাটের চেয়ে কেনাফের নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।

দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় গত ১ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৭ দ্রম্নত বর্ধনশীল, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে চাষাবাদ উপযোগী বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) জাতটি সারাদেশে চাষাবাদের নিমিত্তে ছাড়করণের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জাতটি পাটের মতোই আঁশ উৎপাদনকারী এবং মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উন্নত জাত। জাতটির কান্ড লাল রঙের এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতসমূহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

অধিক ফলনশীল ও বায়োমাস সম্পন্ন এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে অনাবাদি ও অনুর্বর জমিও চাষাবাদের আওতায় আসবে এবং পাট চাষিরা অধিক লাভবান হবেন। ভারতীয় জাতের কেনাফ ফসলে পাতার মোজাইক রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হওয়ায় বর্তমানে বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২, এইচসি-৯৫ ও বিজেআরআই কেনাফ-৩ (বট কেনাফ) সারাদেশে উন্নত জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অধিক সমাদৃত।
কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রংপুরের অঞ্চলের অগ্রগামী কৃষকরা কেনাফ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বপন শুরু করেন- যাতে পরবর্তী সময়ে এ ফসল কেটে অনায়াসেই আমন ধান রোপন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু গাছে আগাম ফুল চলে এলেও কেনাফ ফসলের ক্ষেত্রে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলন ও আঁশের মান অপরিবর্তিত থাকে।

অন্যদিকে টাঙ্গাইলসহ কিছু কিছু এলাকার কৃষকরা বোরো ধান কেটে বৈশাখ মাসের শেষের দিকে কেনাফ চাষ করে থাকেন। কাজেই কেনাফ ফসলের বপনকালীন সময় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং কৃষকরা সুবিধাজনক সময়ে কেনাফকে শস্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। শতকরা আশি ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ বীজ ১১ থেকে ১২ কেজি হেক্টরপ্রতি বপন করে ৪ মাসে ৩ থেকে ৩.৫ টন কেনাফ আঁশ পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বাজারে পাট ও কেনাফ আঁশের দাম একই হওয়ায় কৃষকদের নিকট কম পরিচর্যায় অধিক ফলন প্রাপ্তিতে কেনাফের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে উন্নতমানের দেশীয় জাতের কেনাফ বীজ। চলতি উৎপাদন মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার গচিহাটা অ্যাকোয়াকালচার ফার্মস লিমিটেড তাদের কৃষি খামারে উৎপাদিত এইচসি-৯৫ জাতের ৬০০০ কেজি কেনাফ বীজ স্থানীয় কৃষকদের কাছে প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা হিসাবে বিক্রি করায় ৩৯ লাখ টাকা আয় করেছে। যদিও স্থানীয় বাজারে ভারতীয় কেনাফ বীজ ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়, তার পরও ভালো ফলনের জন্য অধিক মূল্য দিয়ে দেশীয় জাতের বীজ সংগ্রহ করছে কৃষকরা। দেশীয় জাতের কেনাফের ফলন ও মান দুটোই ভালো এবং বীজের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে লাভজনক বীজ ফসল হিসেবে কেনাফকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বীজের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।

উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর অনেকটাই পতিত পড়ে থাকছে। অথচ এসব জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল কেনাফ চাষ করে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বিদেশে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ইনটেরিয়র কাজের ইনসু্যলেটর হিসেবে কেনাফ আঁশের বিপুল চাহিদা রয়েছে।

এ ছাড়াও জুটেক্স ও জিওটেক্সটাইল তৈরি এবং কেনাফ কাঠির ছাই থেকে চারকোল তৈরির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় কেনাফ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে বিপুল সম্ভাবনাময় এ আঁশ ফসল পতিত জমিতে আবাদ করতে পারলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শ্রমশক্তি ব্যবহার এবং বনজসম্পদের ওপর চাপ কমবে। পতিত ও প্রান্তিক জমিতে কেনাফ চাষাবাদের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে কেনাফঃ

কেনাফ একটি বৃক্ষের তুলনায় ৩-৮ গুন বেশি ঈঙ২ শোষণ করে। সাধারণভাবে ১ একর জমিতে জন্মানো কেনাফ স্বাভাবিক অবস্থায়  প্রতি মৌসুমে বায়ুমন্ডল থেকে ১০ টন ঈঙ২ শোষণ করে যা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ২০ টন পর্যন্ত হয়ে  থাকে।

কেনাফের ১ টন শুষ্ক পদার্থ উৎপাদনের জন্য প্রায় ১.৫ টন ঈঙ২ প্রয়োজন হয়।

সারা বছরে ২০ টি জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত গাড়ি থেকে কম-বেশি ৩০-৪০ টন ঈঙ২ নির্গত হয়, যা ১ হেক্টর জমিতে এক মৌসুমে জন্মানো কেনাফ শোষণ করে থাকে।

কেনাফ জন্মাতে তেমন কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। তাই কেনাফ পরিবেশ বান্ধব ফসল, যা ইকো-সিস্টেমের জন্য উপকারী।

হাইড্রোকার্বন জনিত মাটি দূষণ প্রতিকারের জন্য কেনাফ কোর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কেনাফ মাটি থেকে হেভী মেটাল শোষণ করে বলে ধারণা করা হয়।

কেনাফে লিগনিন কম থাকায় বহুল ব্যবহৃত উড পাল্পের তুলনায় কেনাফ পাল্প তৈরিতে ২০% কম শক্তি খরচ হয়। অপরদিকে কাগজ শিল্পে উড পাল্পের বিকল্প হিসেবে কেনাফ পাল্প ব্যবহারের ফলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়।

কেনাফ ফাইবার থেকে উৎপাদিত সিনথেটিক পণ্য রিসাইকেল করা যায়।

কেনাফ থেকে প্রি বোর্ড তৈরি হয় যা গাড়ির ইন্টেরিয়র তৈরির বেইজ ম্যাটেরিয়াল বা কাঁচামাল। কেনাফ থেকে তৈরি প্রি বোর্ড পরিবেশ বান্ধব।

শেষ কথাঃ 
সীমিত ভূমি সম্পদ থেকে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে হয় বলে পরিকল্পিতভাবে ফসল বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এদেশে বিদ্যমান ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন আনা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। যদিও মাটির উর্বরতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে  কৃষির স্থিতিশীল উন্নয়নের  লক্ষ্যে এর তেমন  কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বিস্তৃত পরিসরে কেনাফ চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে শস্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাবনার  সরু পথটি আগামীতে যথেষ্ট প্রসারিত হতে পারে। এর ফলে প্রান্তিক পতিত জমিসহ অন্যান্য অনাবাদী ভূমি চাষের আওতায় আসবে। ফলে, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে, কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে, বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমান হ্রাসসহ কেনাফের আঁশজাত স্বল্প মূল্যের পরিবেশ বান্ধব ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন সাধন হবে। কেনাফ উৎপাদনের পাশাপাশি  প্রক্রিজাতকরণ শিল্প স্থাপন করে বহুবিধ পণ্য তৈরির ব্যবস্থা করা গেলে এ শিল্পের অগ্র-পশ্চাৎ সংযোগ (ভড়ৎধিৎফ ধহফ নধপশধিৎফ ষরহশধমব) প্রতিষ্ঠিত হবে, সম্প্রসারিত হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কৃষি ক্ষেত্রে রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে প্রবৃদ্ধি। সর্বোপরি বলা যায়, কাঁচামাল, পণ্য কিংবা অর্থ-কড়ির যোগান ছাড়াও কেনাফ আবাদের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হবে ধরিত্রী, আর  উপকৃত হবে এ গৃহে বসবাসকারী প্রায় ৭০০ কোটি মানুষসহ অন্যান্য সকল প্রাণি।

লেখকঃ  কৃষিবিদ মো. আল-মামুন 
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সূত্র: চাষ পদ্ধতি বিজেআরআই-এর ফোল্ডার অবলম্বনে।

কেনাফ ফাইবার কি এবং এর ব্যাবহার | Kenaf Fibre

কেনাফ ফাইবার | Kenaf Fibre 
কেনাফ পাটের ন্যায় পরিবেশবান্ধব আঁশ জাতীয় ফসল। উষ্ণমন্ডলীয় ও অবউষ্ণ দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান প্রধান জেলা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে কেনাফ ও মেস্তা চাষ হয়েছে এবং ৩ লাখ ৩৭ হাজার বেল আঁশ উৎপাদিত হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের অনেক এলাকাতেই কেনাফ আঞ্চলিক ভাষায় মেস্তা হিসেবে পরিচিত।

চলতি ২০১৮-১৯ পাট উৎপাদন মৌসুমে ৮ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট ও কেনাফ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যায়িত মানের ১০৫৩ টন কেনাফ বীজ আমদানি করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত কেনাফ বীজ সঠিক সময়ে আবাদ করা সম্ভব হলে এ বছর কর্তিত জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে।

মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘পস্নাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। কেনাফ আঁশ থেকে কাগজের পাল্প বা মন্ড তৈরি করে নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, কেনাফ খড়ি হার্ডবোর্ড বা পার্টেক্স মিলের কাঁচামাল ও চারকোল তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। তা ছাড়া কেনাফ খড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং বীজ থেকে ঔষধি গুণ সম্পন্ন তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের মন্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূলবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়।

কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে কাগজের মন্ড, বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, পেস্নন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড় চোপড় জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনসু্যলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাস্তব প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে উর্বর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং পাট স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রান্তিক ও অপ্রচলিত (লবণাক্ত, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল) জমিতে। তা ছাড়া নগরায়ন, শিল্পায়ান ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতি বছর প্রায় ০.৭% হারে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। কিন্তু দেশের দক্ষিণের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ততা ও খরা প্রবণ এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে পাট উৎপাদন মৌসুমে (মার্চ-জুলাই) কোনো ফসল থাকে না বললেই চলে। খুলনার কিছু কিছু এলাকায় তিল চাষ হলেও বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি রয়েছে।

উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরা ও এক ফসলি আমন পরবর্তী পতিত জমিতে অথবা চর এলাকায় কেনাফ চাষের সম্ভাবনা ও উৎপাদিত বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপিস্নন বিভাগের গবেষক দল। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাট চাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএস/মি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।

গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং আঁশ থেকে কাগজের মন্ড ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন গবেষক দল। অনুরূপভাবে বিজেআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।

কেনাফ এর চাষ প্রনলী:

জমিঃ পললভূমির উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি, চালা ও পাহাড়ি ঢালু জমি কেনাফ চাষের উপযোগী। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় কেনাফের আবাদ করা যেতে পারে। তবে, মাঝারি থেকে গভীরভাবে প্লাবিত জমি এবং অধিক কর্দম কনা সমৃদ্ধ এটেল মাটি কেনাফ চাষের জন্য উপযোগী নয়। যে সকল অনুর্বর ভূমিতে পাট কিংবা আউশ ফসলের আবাদ করা যায় না, সেখানে স্বল্প  যতে কেনাফ আবাদ করে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

জাতঃ 
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এইচসি-২, এইচসি-৯৫ ও বিজেআরআই কেনাফ-৩ নামক তিনটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে এইচসি-২ জাতের কেনাফের চাষ প্রণালী নিম্নে তুলে ধরা হল-

এইচসি-২ জাতটি ‘জলি কেনাফ’ নামেও পরিচিত। গাছের উচ্চতা কম-বেশি ৬ মিটার। ফুল হলদে রংয়ের। ফল ডিম্বাকৃতি, যা পাকার পরে ফেটে যায়। বীজ ত্রিকোণাকৃতির, কালচে খয়েরী বর্ণের।  ১৪০-১৫০ দিনে আঁশ ফসল ফসল কাটা যায়। বীজ থেকে শতকরা ২০ ভাগ ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। এ জাতটি আলোক সংবেদনশীল অর্থাৎ ফুল আসা ও পরিপক্কতা বপন সময়ের উপর নির্ভরশীল।

বপনকালঃ 
আঁশ উৎপাদনের জন্য চৈত্র মাসের শুরু থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি নাগাদ বীজ বপন করা যায়। বীজ উৎপাদনের জন্য শ্রাবন-ভাদ্র মাসে বীজ বপন করা হয়। তবে বীজের জন্য ভাদ্র মাসে বপন করা হলে আশ্বিন বা কার্তিকের বৃষ্টি থেকে  বীজ ফসল রা পায় এবং উৎকৃষ্ট মানের বীজ পাওয়া যায়।



জমি প্রস্তুতঃ 
কেনাফ বীজের আকার বড় হওয়ায় চাষ দিয়ে মাটি তত মিহি না করলেও চলে। এর শিকড় মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে। তাই গভীর চাষ দিলে ভালো। মাটির প্রকৃতিভেদে ২-৩ বার চাষ ও মই দিতে হয়। পাহাড়ী ঢালু জমি কর্ষণের আবশ্যকতা নেই। উত্তমরূপে আগাছা বাছাই করতে হবে। বীজ সারিতে কিংবা ছিটিয়ে বপন করা হয়। ৩০ সেমি পর পর সারি করে বীজ বুনতে হয়। সারিতে বপন করলে ১১-১২ কেজি এবং ছিটিয়ে বপন করলে ১২-১৪ কেজি বীজ প্রয়োজন। রোগ জীবাণুমুক্ত ভালো মানের বীজ ব্যবহার করা আবশ্যক। প্রয়োজনে বীজ শোধন করে নেওয়া যেতে পারে।



সার প্রয়োগঃ 
মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে কিংবা উপজেলা নির্দেশিকা থেকে মাটির উর্বরতামান জেনে পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হবে। একান্ত সম্ভব না হলে হেক্টরপ্রতি ১৩২ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি ও ৪০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। জৈব সার প্রয়োগ করা উত্তম। হেক্টর প্রতি ৩-৫ টন গোবর করা যেতে পারে। প্রতি টন গোবরের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ৮ কেজি টিএসপি ও ৬ কেজি এমওপি কম প্রয়োগ করতে হবে। গোবর কিংবা অন্যান্য জৈব সার, অর্ধেক ইউরিয়া, সমুদয় টিএসপি ও এমওপি জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করে অবশিষ্ট ইউরিয়া বীজ বপনের ৪৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরপর মাটি আলোড়িত করে দেয়া আবশ্যক ।



পরিচর্যাঃ 
পাটের চেয়ে কেনাফ চাষে  অনেক কম পরিচর্যা দরকার হয়। চারা গজানোর পর সময়মত নিড়ানী ও গাছ পাতলা করে দিতে হয়। চারা গাছের বৃদ্ধির প্রথম দিকে জমি অবশ্যই  আগাছামুক্ত রাখতে হবে।



আঁশ সংগ্রহঃ 
চার মাস পর থেকে সুবিধাজনক সময়ে ফসল কাটা যায়। তবে, কেনাফ গাছে ফুল আসলেও গাছের বৃদ্ধি থেমে যায় না। তাই আঁশ উৎপাদনের জন্য সম্ভব হলে পাঁচ মাস বয়সে ফসল কাটা হলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। আঁশ ফসলের জন্য পাটের ন্যায় সরু ও মোটা গাছ পৃথক করে আঁটি বেঁধে পাতা ঝরিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। জাঁক কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ভালো। পরিষ্কার পানিতে আঁশ ধুয়ে বাঁশের আড়ায় শুকাতে হবে। এইচসি-২ জাতটি হেক্টরপ্রতি ৬.৮ টন পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে। আঁশের জন্য এই জাতের কেনাফ ১৪০-১৫০ দিনে কর্তন করা যায়।



কাগজ শিল্পের পাল্প তৈরিঃ 
পাল্প তৈরির জন্য কিংবা কেনাফ কান্ড খুটি হিসাবে ব্যবহার করতে হলে ফুল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম। কাগজের পাল্প তৈরির ক্ষেত্রে কর্তিত কেনাফ হালকা আঁটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়।

বীজ সংগ্রহঃ 
কেনাফ ফল কিছুটা কাঁটাযুক্ত। বীজের জন্য ফসল কেটে ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নিলে ফলগুলো ফেটে যায়। অতঃপর লাঠি দিয়ে মারিয়ে সহজেই বীজ সংগ্রহ করা যায়।

বীজ শুকানোঃ 
কেনাফ বীজ সরাসরি পাকা মেঝে কিংবা ভিজা মাটিতে রেখে শুকানো অনুচিৎ। তাতে বীজের সজীবতা নষ্ট হয়। পাকা মেঝের উপর পলিথিন বা পাটের বস্তা বিছিয়ে বীজ শুকাতে হবে। পাকা মেঝে না থাকলে গোবর দিয়ে লেপে মাটিতে বীজ শুকানো যেতে পারে। শুকানো কয়েকটি বীজ দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে কট করে শব্দ করে ভেঙে গেলে বুঝা যাবে বীজ কাংখিত পর্যায়ে শুকিয়েছে।

বীজ সংরক্ষণঃ 
কেনাফের বীজ পাটের তুলনায় আদ্রতাকাতর। তাই শুকানো বীজ ঠান্ডা করে পলিথিন মুড়িয়ে প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে মুখ ভলোভাবে বন্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

বাংলাদেশে কেনাফ চাষের ক্ষেত্র ও সম্ভাবনাঃ

কেনাফ একটি পরিবেশ বান্ধব অর্থকরী ফসল। বায়ুমন্ডল থেকে অধিক পরিমাণে ঈঙ২ শোষণ ক্ষমতা এবং এর বহুমুখী ব্যবহারের কারণে কেনাফের পরিচিতি ও সমাদর বিশ্বজুড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে পাটের আবাদ হয়ে আসছে। এদেশে কেনাফ কে পাটের বিকল্প হিসাবে নয় বরং পরিবেশ বান্ধব এই অর্থকরী ফসলটিকে পাটের পরিপূরক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেনাফ মোটামুটি বিরূপ পরিবেশে স্বল্প যতেœ জন্মানো ফসল। যে সকল প্রান্তিক ভূমি পাট কিংবা আউশ ফসল আবাদের উপযোগী নয়  তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ কেনাফ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এর ফলে দেশের ভূমি ব্যবহার বা ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। ফলে অধিক আঁশ উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। পাহাড়ী অঞ্চলের কম উর্বর পতিত জমিতে অর্থকরী ফসল কেনাফের চাষ প্রবর্তন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে হলেও ংঁনংরং:বহপব কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষির ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের যে সব জমিতে আউশ ধানের আবাদ সম্ভব হয় না, সেখানে কেনাফ আবাদের সম্ভাব্যতা যাচাই করা আবশ্যক। পাটের চেয়ে কম খরচে কেনাফ উৎপাদন করা যায়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সফলতা আসছে না। এমন বাস্তবতায় কেনাফজাত আঁশ থেকে স্বল্প মূল্যের ব্যাগ তৈরি করে তা ব্যবহারে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা গেলে পরিবেশের বিপর্যয় রোধে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। কেনাফ থেকে উৎপাদিত নানা ধরণের পণ্য ও কাঁচামাল উন্নত দেশে রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

কেনাফ চাষ সম্প্রসারণে করণীয়ঃ

কেনাফের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়ে বহির্বিশ্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেনাফ থেকে লাভজনকভাবে নানা রকমের পণ্য উৎপাদনে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পন্য মেলা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির আয়োজন করে  কেনাফ শিল্পের লাভজনক দিক তুলে ধরে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে হবে।

অনাবাদী যে সকল জমি কেনাফ চাষের উপযোগী তা কেনাফ চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহন  এবং নিকটবর্তী এলাকায় কেনাফ প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করা।



বিচ্ছিন্নভাবে কেনাফ আবাদের পরিবর্তে চিনিকল কিংবা পাটকল এলাকার ন্যায় জোন বা অঞ্চল ভিত্তিক আবাদ করে ঐ এলাকায় মিলিং সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে এ শিল্পের ফরোয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তোলা। নিকটবর্তী স্থান থেকে কাঁচামাল সরবরাহের ফলে পরিবহন খরচ হ্রাস পাবে। ফলে একদিকে কৃষক লাভবান হবে অপরদিকে কেনাফজাত শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে।

দেশে বিদ্যমান যে সব কাগজের মিল কাঁচামালের অভাবে বন্ধ রয়েছে কিংবা যে সকল মিলে পর্যাপ্ত কাঁচামালের সরবরাহ নেই সেক্ষেত্রে বিকল্প কাঁচামাল হিসাবে  কেনাফ  ব্যবহার করা।

কেনাফ চাষী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা।

কেনাফ চাষীদের আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্বল্প মূল্যে মানসম্মত বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করা।

বিদেশে কেনাফজাত পণ্যের বাজার অনুসন্ধানসহ অনুকূল রপ্তানী বাণিজ্যের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব রকমের সরকারি  সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত রাখা।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উঁচু, মধ্যম, নিচু, হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চল ফসলে উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয় এমন অনুর্বর জমিতেও অল্প পরিচর্যায় কেনাফ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশে যে সব এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই সেখানে ধানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ চাষ কৃষকের প্রথম পছন্দ। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ হেক্টর জমি আছে যেখানে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পাট ও কেনাফ ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষ সম্ভব নয়। পাটের চেয়ে কেনাফের নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।

দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় গত ১ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৭ দ্রম্নত বর্ধনশীল, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে চাষাবাদ উপযোগী বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) জাতটি সারাদেশে চাষাবাদের নিমিত্তে ছাড়করণের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জাতটি পাটের মতোই আঁশ উৎপাদনকারী এবং মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উন্নত জাত। জাতটির কান্ড লাল রঙের এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতসমূহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

অধিক ফলনশীল ও বায়োমাস সম্পন্ন এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে অনাবাদি ও অনুর্বর জমিও চাষাবাদের আওতায় আসবে এবং পাট চাষিরা অধিক লাভবান হবেন। ভারতীয় জাতের কেনাফ ফসলে পাতার মোজাইক রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হওয়ায় বর্তমানে বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২, এইচসি-৯৫ ও বিজেআরআই কেনাফ-৩ (বট কেনাফ) সারাদেশে উন্নত জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অধিক সমাদৃত।
কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রংপুরের অঞ্চলের অগ্রগামী কৃষকরা কেনাফ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বপন শুরু করেন- যাতে পরবর্তী সময়ে এ ফসল কেটে অনায়াসেই আমন ধান রোপন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু গাছে আগাম ফুল চলে এলেও কেনাফ ফসলের ক্ষেত্রে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলন ও আঁশের মান অপরিবর্তিত থাকে।

অন্যদিকে টাঙ্গাইলসহ কিছু কিছু এলাকার কৃষকরা বোরো ধান কেটে বৈশাখ মাসের শেষের দিকে কেনাফ চাষ করে থাকেন। কাজেই কেনাফ ফসলের বপনকালীন সময় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং কৃষকরা সুবিধাজনক সময়ে কেনাফকে শস্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। শতকরা আশি ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ বীজ ১১ থেকে ১২ কেজি হেক্টরপ্রতি বপন করে ৪ মাসে ৩ থেকে ৩.৫ টন কেনাফ আঁশ পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বাজারে পাট ও কেনাফ আঁশের দাম একই হওয়ায় কৃষকদের নিকট কম পরিচর্যায় অধিক ফলন প্রাপ্তিতে কেনাফের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে উন্নতমানের দেশীয় জাতের কেনাফ বীজ। চলতি উৎপাদন মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার গচিহাটা অ্যাকোয়াকালচার ফার্মস লিমিটেড তাদের কৃষি খামারে উৎপাদিত এইচসি-৯৫ জাতের ৬০০০ কেজি কেনাফ বীজ স্থানীয় কৃষকদের কাছে প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা হিসাবে বিক্রি করায় ৩৯ লাখ টাকা আয় করেছে। যদিও স্থানীয় বাজারে ভারতীয় কেনাফ বীজ ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়, তার পরও ভালো ফলনের জন্য অধিক মূল্য দিয়ে দেশীয় জাতের বীজ সংগ্রহ করছে কৃষকরা। দেশীয় জাতের কেনাফের ফলন ও মান দুটোই ভালো এবং বীজের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে লাভজনক বীজ ফসল হিসেবে কেনাফকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বীজের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।

উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর অনেকটাই পতিত পড়ে থাকছে। অথচ এসব জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল কেনাফ চাষ করে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বিদেশে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ইনটেরিয়র কাজের ইনসু্যলেটর হিসেবে কেনাফ আঁশের বিপুল চাহিদা রয়েছে।

এ ছাড়াও জুটেক্স ও জিওটেক্সটাইল তৈরি এবং কেনাফ কাঠির ছাই থেকে চারকোল তৈরির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় কেনাফ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে বিপুল সম্ভাবনাময় এ আঁশ ফসল পতিত জমিতে আবাদ করতে পারলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শ্রমশক্তি ব্যবহার এবং বনজসম্পদের ওপর চাপ কমবে। পতিত ও প্রান্তিক জমিতে কেনাফ চাষাবাদের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে কেনাফঃ

কেনাফ একটি বৃক্ষের তুলনায় ৩-৮ গুন বেশি ঈঙ২ শোষণ করে। সাধারণভাবে ১ একর জমিতে জন্মানো কেনাফ স্বাভাবিক অবস্থায়  প্রতি মৌসুমে বায়ুমন্ডল থেকে ১০ টন ঈঙ২ শোষণ করে যা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ২০ টন পর্যন্ত হয়ে  থাকে।

কেনাফের ১ টন শুষ্ক পদার্থ উৎপাদনের জন্য প্রায় ১.৫ টন ঈঙ২ প্রয়োজন হয়।

সারা বছরে ২০ টি জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত গাড়ি থেকে কম-বেশি ৩০-৪০ টন ঈঙ২ নির্গত হয়, যা ১ হেক্টর জমিতে এক মৌসুমে জন্মানো কেনাফ শোষণ করে থাকে।

কেনাফ জন্মাতে তেমন কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। তাই কেনাফ পরিবেশ বান্ধব ফসল, যা ইকো-সিস্টেমের জন্য উপকারী।

হাইড্রোকার্বন জনিত মাটি দূষণ প্রতিকারের জন্য কেনাফ কোর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কেনাফ মাটি থেকে হেভী মেটাল শোষণ করে বলে ধারণা করা হয়।

কেনাফে লিগনিন কম থাকায় বহুল ব্যবহৃত উড পাল্পের তুলনায় কেনাফ পাল্প তৈরিতে ২০% কম শক্তি খরচ হয়। অপরদিকে কাগজ শিল্পে উড পাল্পের বিকল্প হিসেবে কেনাফ পাল্প ব্যবহারের ফলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়।

কেনাফ ফাইবার থেকে উৎপাদিত সিনথেটিক পণ্য রিসাইকেল করা যায়।

কেনাফ থেকে প্রি বোর্ড তৈরি হয় যা গাড়ির ইন্টেরিয়র তৈরির বেইজ ম্যাটেরিয়াল বা কাঁচামাল। কেনাফ থেকে তৈরি প্রি বোর্ড পরিবেশ বান্ধব।

শেষ কথাঃ 
সীমিত ভূমি সম্পদ থেকে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে হয় বলে পরিকল্পিতভাবে ফসল বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এদেশে বিদ্যমান ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন আনা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। যদিও মাটির উর্বরতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে  কৃষির স্থিতিশীল উন্নয়নের  লক্ষ্যে এর তেমন  কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বিস্তৃত পরিসরে কেনাফ চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে শস্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাবনার  সরু পথটি আগামীতে যথেষ্ট প্রসারিত হতে পারে। এর ফলে প্রান্তিক পতিত জমিসহ অন্যান্য অনাবাদী ভূমি চাষের আওতায় আসবে। ফলে, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে, কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে, বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমান হ্রাসসহ কেনাফের আঁশজাত স্বল্প মূল্যের পরিবেশ বান্ধব ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন সাধন হবে। কেনাফ উৎপাদনের পাশাপাশি  প্রক্রিজাতকরণ শিল্প স্থাপন করে বহুবিধ পণ্য তৈরির ব্যবস্থা করা গেলে এ শিল্পের অগ্র-পশ্চাৎ সংযোগ (ভড়ৎধিৎফ ধহফ নধপশধিৎফ ষরহশধমব) প্রতিষ্ঠিত হবে, সম্প্রসারিত হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কৃষি ক্ষেত্রে রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে প্রবৃদ্ধি। সর্বোপরি বলা যায়, কাঁচামাল, পণ্য কিংবা অর্থ-কড়ির যোগান ছাড়াও কেনাফ আবাদের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হবে ধরিত্রী, আর  উপকৃত হবে এ গৃহে বসবাসকারী প্রায় ৭০০ কোটি মানুষসহ অন্যান্য সকল প্রাণি।

লেখকঃ  কৃষিবিদ মো. আল-মামুন 
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সূত্র: চাষ পদ্ধতি বিজেআরআই-এর ফোল্ডার অবলম্বনে।

কোন মন্তব্য নেই: