গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট : প্রকারভেদ ও নির্ভুল ডকুমেন্টেশন গাইডলাইন
রপ্তানি বাণিজ্য বেশ লাভজনক একটি কাজ। তবে যথাযথভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই কাজটি করতে গেলে একজন রপ্তানিকারককে যে কয়েকটি ব্যাপার নিশ্চিত করতে হয় সেগুলো একটি হলো এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশন। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো রপ্তানি বাণিজ্যেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বাণিজ্যকালীন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা তৈরি হতেই পারে। তবে যথাযথ ডকুমেন্টেশন থাকলে রপ্তানি বাণিজ্য সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা খুব সহজেই এড়িয়ে চলা সম্ভব। চলুন, আজ এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট কী, এর প্রকারভেদ এবং তৈরির সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট কী?
এক কথায় এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশনকে পণ্যের মালিকানা এবং পণ্য বিক্রয়ের নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতির প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশন সাথে থাকলে পণ্য আকাশপথে বা জলপথে, যেভাবেই রপ্তানি হোক না কেন, পণ্যের এক্সপোর্টিং কাস্টম এবং ইমপোর্টিং কাস্টমসে কোনরকম সমস্যা তৈরি হয় না।
এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট কত প্রকার?
সাধারণত, রপ্তানি বাণিজ্যে দুই রকমের ডকুমেন্টেশন ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হলো- এক্সপোর্ট সেলস ডকুমেন্টস এবং এক্সপোর্ট শিপমেন্ট ডকুমেন্টস। এক্সপোর্ট সেলস ডকুমেন্টস ক্রেতা এবং বিক্রেতার পরিচয় প্রদান করে। একইসাথে ক্রেতা ও বিক্রেতার দ্বারা স্বাক্ষরকৃত সেলস নেগোসিয়েশনও এর অন্তর্ভূক্ত থাকে। আর এক্সপোর্ট শিপমেন্ট ডকুমেন্টস মূলত এক্সপোর্ট ও ইমপোর্ট কাস্টমসে যেন কোনরূপ ঝামেলা না তৈরি হয় তা নিশ্চিত করে।
এই দুইটি এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট রপ্তানিকারক তৈরি করেন। আর তাই, ডকুমেন্টস তৈরির ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। অন্যথায়, ডকুমেন্টসে থাকা সামান্য একটি ভুলের কারণেও রপ্তানিকারকের বড় রকমের আর্থিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
এক্সপোর্ট সেলস ডকুমেন্টস
এই এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট ‘সেলস/পারচেজ কন্ট্রাক্ট’ এবং ‘প্রো ফর্মা ইনভয়েজ’ নামক মোট দুইটি ডকুমেন্টেশন থাকে। এই দুইটি ডকুমেন্টেশনই এক্সপোর্ট সেলসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এই দুইটি ডকুমেন্টসেই (প্রায় একইরকমভাবে) ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম, পণ্যের বিবরণ, মূল্য, পেমেন্টের শর্তগুলো, শিপমেন্টের টার্মস ইত্যাদি উল্লেখ করা থাকে।
এক্সপোর্ট শিপমেন্ট ডকুমেন্টস
সহজভাবে বলতে গেলে, কাস্টম পার করার জন্য একজন রপ্তানিকারককে বেশ কিছু কাস্টমের নিয়ম ও নীতিমালা ম্যান, সেই অনুযায়ী চলতে হয়। সাধারণত, কাস্টম রপ্তানিকারকের কাছে পণ্যের সাথে জড়িত কয়েকরকমের ডলুমেন্টস দেখতে চায়। অন্যদিকে, কাস্টমে থাকা পণ্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে একজন আমদানীকারককেও যথাযথ কাগজ প্রদান করতে হয়। তাই, এই প্রক্রিয়াটির মোট দুটো দিক আছে বলা যায়।
১। কাস্টমে রপ্তানিকারকের ডকুমেন্ট
বাংলাদেশের কাস্টম থেকে চালান ছাড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়। ২০০১ সালে এনবিআর-এর ইস্যু করা প্রেসক্রাইবড বিল অব এন্ট্রি এবং বিল অফ এক্সপোর্ট ফর্ম অর্ডার অনুসারে, কাস্টম ক্লিয়ারেন্সের জন্য (সব ধরণের রপ্তানি চালানের ক্ষেত্রে) বিল অব এক্সপোর্টের সাথে নিম্নোক্ত ডকুমেন্টেশন থাকতে হবেঃ
১. এক্সপোর্ট এল/সি; যদি এক্সপোর্ট এল/সি না থেকে থাকে সেক্ষেত্রে, এক্সপোর্ট কন্ট্রাক্ট, পারচেজ অর্ডার, কিংবা চুক্তিবদ্ধ ব্যাংকের দ্বারা অনুমোদিত এক্সপোর্ট গ্যারান্টি
২. রপ্তানিকারক দ্বারা স্বাক্ষরিত পণ্যের পূর্নাঙ্গ বিবরণসহ কমার্শিয়াল ইনভয়েজ
৩. পণ্যের পরিমাণ, ওজন এবং প্যাকিং-এর তথ্যাদিসহ একটি প্যাকিং লিস্ট
৪. রপ্তানি আদায় নিশ্চিত করতে অথোরাইজড ডিলার দ্বারা সার্টিফাইড ইএক্সপি ফর্ম
৫. রপ্তানি পণ্যের উৎস সংক্রাত সার্টিফিকেট (ইপিবি বা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি দ্বারা ইস্যুকৃত)
৬. ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট
৭. ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট দ্বারা ইস্যু করা ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইন)
২। কাস্টমে আমদানীকারকের ডকুমেন্টেশন
ইমপোর্ট ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন আইন ও নীতিমালা থাকে। এছাড়াও, পণ্যের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় কাগজাদিতে ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণত, আমদানিকারকেরা এলসি-তে ৪৬এ ফিল্ডে এই ডকুমেন্টসগুলোকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস হিসেবে উল্লেখ করেন। যদি সেলস টিটি টার্মসে হয়ে থাকে, তাহলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলো এক্সপোর্ট কন্ট্রাক্ট বা পারফর্মা ইনভয়েজে লেখা হয়। এই ডকুমেন্টের পরিমাণ এবং অবস্থা পণ্য ও দেশভেদে ভিন্ন হলেও, সাধারণত নিম্নোক্ত ডকুমেন্টসগুলো সবসময়ই চাওয়া হয়ঃ
১. বিল অব ল্যাডিং/ এয়ার অয়ে বিল/ ট্রাক রিসিপ্ট
২. কমার্শিয়াল ইনভয়েজ
৩. প্যাকিং লিস্ট
৪. সার্টিফিকেট অব অরিজিন
৫. এছাড়াও, কোন একটি নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সার্টিফিকেট , এই যেমন- ইন্সপেকশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি বায়ারের কাছে চাওয়া হতে পারে।
কম সময়ে দ্রুত এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশন তৈরির ৫ টি টিপস
১। তথ্য সংগঠিত করুন
কোন একটি কাজের জন্য, বিশেষ করে সেটি যদি রপ্তানি করার মতো একটি বিষয় হয়, সেক্ষেত্রে নানারকম কাগজ ও তথ্যের প্রয়োজন পড়ে। আপনার হাতের কাছে যদি সবগুলো তথ্য থাকে, তাহলে কাজ শেষ করাটাও সহজ হয়। তাই, রপ্তানির পূর্বে এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্যাদি জড়ো করুন। এরপর গুছিয়ে ফেলার কাজে হাত দিন।
২। ডকুমেন্টেশনের প্রক্রিয়ার চেকলিস্ট তৈরি করুন
রপ্তানির ক্ষেত্রে আপনার কোন কোন ডকুমেন্টস লাগবে তা কোন একটি সাথে লিখে রাখুন। তারপর একটি একটি করে কাগজ সম্পূর্ণ করুন। এতে করে আপনার কাজ সহজ হবে, ভুলে কোন ডকুমেন্টস বাদ পড়ে যাবে। সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে কখনো অডিটের দরকার পড়লেও এই চেকলিস্ট আপনাকে সাহায্য করবে।
৩। ডকুমেন্ট টেমপ্লেটস ব্যবহার করুন
ওয়ার্ড কিংবা এক্সেলের চাইতে ডকুমেন্টস মডেল তৈরি করে কাজ করাটা অনেক বেশি কার্যকর। এটি আপনার কোম্পানির নিজস্ব পরিচয় ফুটিয়ে তুলতেও সাহায্য করবে। তবে সেক্ষেত্রে বারবার তথ্যগুলো ঠিক আছে কিনা, পুরনো কোন তথ্য ফর্মে রয়ে গিয়েছে কিনা তা যাচাই করুন।
৪। ডকুমেন্টেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করুন
এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট তৈরির অন্যতম সহজ উপায় হচ্ছে ‘ডকুমেন্টর’এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার
করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, টেমপ্লেট বা পেপার ডকুমেন্টের চাইতে সফটওয়্যার এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট তৈরিতে পাঁচগুণ বেশি দ্রুত কাজ করে।
৫। এক্সপোর্ট শিপমেন্টের সম্পূর্ণ রেকর্ড রাখুন
শিপমেন্টের পরবর্তী সময়ে একজন রপ্তানিকারক হিসেবে নির্দিষ্ট এক্সপোর্টের সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখুন। রপ্তানি বাণিজ্যে কাজ শুরু করার আগে তাই ভালোভাবে উপরোক্ত এক্সপোর্ট ডকুমেন্টগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে নিন। এতে করে আপনার পক্ষে গুছিয়ে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে এবং সফলতাও আসবে খুব দ্রুত!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন