ব্যতিক্রম পোশাক খাত
রপ্তানি খাতের উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তৈরি পোশাকসহ বেশ কয়েকটি খাত নগদ সহায়তাসহ নানা প্রণোদনা পাচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজার, ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজারে সরকারি প্রণোদনার তেমন প্রভাব না থাকলেও এর ফলে রপ্তানি বিশেষত, পোশাক খাত এগিয়েছে। তৈরি পোশাক খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে সরকারি প্রণোদনা।
পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। রয়েছে শুল্ক্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে কম সুদে ঋণ নিতে পারছেন উদ্যোক্তারা। রপ্তানিতে হ্রাসকৃত হারে উৎসে করের সুবিধা রয়েছে। করপোরেট করও তুলনামূলক কম। তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী কিছু রপ্তানিকারক দেশ সাম্প্রতিক সময়ে সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন প্রণোদনার সুবিধার জন্য সরকারের প্রতি তারা কৃতজ্ঞ। তবে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় তারা আরও কিছু সুবিধা চান, যার অন্যতম হলো ডলারের বিপরীতে টাকার দর অবমূল্যায়ন।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে 'এক্সপোর্ট বেনিফিট' নামে আর্থিক প্রণোদনা শুরু হয়। এ সুবিধার আওতায় সব ধরনের আইটেম যে কোনো বাজারে রপ্তানিতে ৫ শতাংশ প্রণোদনা পেতেন উদ্যোক্তারা। পরের তিন বছর এ সুবিধা অব্যাহত থাকে। তবে পোশাক খাতকে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় মজবুত ভিত্তি এনে দেয় দেশি বস্ত্র ব্যবহারে ২৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা। ১৯৯৬ সালে এ সুবিধা দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন শুরু হয়। দেশি কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধির সুবাদে বস্ত্র খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসে। আবার দেশি বস্ত্র ব্যবহার উৎসাহিত হওয়ার ফলে পোশাক খাতের নিট ক্যাটাগরিতে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ শতাংশ। এর আগে পোশাক উৎপাদনে যাবতীয় সুতা ও কাপড় আমদানি করতে হতো। আমদানিতে অনেক সময় লাগত। লিড টাইম বা রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছাতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, প্রণোদনার কারণে একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায় দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাত। তাদের সদস্য ৭০ শতাংশ কারখানা শুধু দেশি বস্ত্রের ওপর টিকে আছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিসংখ্যান বিশ্নেষণে দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে পোশাক খাতের অংশ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ওই অর্থবছরে রপ্তানি হয় তিন কোটি ১৬ লাখ ডলারের পণ্য। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক। এ সময়ের ব্যবধানে রপ্তানি আয় বেড়েছে এক হাজার গুণ। মোট রপ্তানিতে পোশাকের অংশ এখন ৮৪ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে চীনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। পোশাক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) জন্য অতিরিক্ত ৪ শতাংশ হারে প্রণোদনা রয়েছে। বছরের নূ্যনতম ৩৫ লাখ ডলার এবং সর্বোচ্চ দুই কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন এমন উদ্যোক্তারাই এ সুবিধা পেয়ে থাকেন। চলতি অর্থবছর থেকে অবশ্য রপ্তানি আয়ের সীমা নূ্যনতম ৫০ লাখ ডলার করা হয়েছে।
তৈরি পোশাকের বাণিজ্য পুরোটাই আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এ খাতে বিশেষ প্রভাব রাখে। ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপ ও আমেরিকার নাগরিকদের ভোগক্ষমতা এবং চাহিদা কমে আসে। প্রচলিত এ দুই বাজার হারানোর শঙ্কায় নতুন বাজারের সন্ধানে নামে সরকার এবং উদ্যোক্তারা। নতুন নতুন দেশ বা অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি উৎসাহ জোগাতে প্রচলিত বাজারের বাইরে নতুন বাজারে রপ্তানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করে সরকার। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে এই প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যকর হয়। এ সুবিধায় অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, ভারতসহ অন্তত ৩০টি দেশে পোশাক রপ্তানিতে গতি আসে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে নতুন বাজারে রপ্তানি বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ। শুধু ভারতেই রপ্তানি বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ।
২০১৫ সালে ইউরোপে মন্দা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোর বিনিময় হার এক যুগের সর্বনিল্ফেম্ন নেমে আসে। এতে ইইউতে রপ্তানিতে মুনাফা কমে যায়। এতে রপ্তানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক খাতে নতুন প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে ইইউতে পোশাক রপ্তানির ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বহাল আছে।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে পোশাক খাতে দুই হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। বিদ্যমান প্রণোদনার ওপর অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গতকাল সমকালকে বলেন, প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রণোদনা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে সব প্রতিযোগী দেশ ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে রপ্তানি খাতকে টিকিয়ে রাখছে। তারা বাংলাদেশে এ ধরনের পদক্ষেপ চান।
পোশাকের মতো অন্যান্য খাত সমহারে প্রণোদনা সুবিধা পাচ্ছে না। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবদুল বারেক খান সমকালকে বলেন, রপ্তানিযোগ্য পাটপণ্যের কাঁচামাল শতভাগই দেশি হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখ করার মতো কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না। এমনকি ইডিএফ তহবিল থেকেও পাট খাতকে ঋণ দেওয়া হয় না। প্রায় সব রপ্তানি গন্তব্যেই কয়েক বছর ধরে নানা প্রতিকূলতা চলছে।
বাণিজ্য বিশ্নেষকরা মনে করেন, প্রণোদনায়ও ভারসাম্য থাকা উচিত। সম্ভাবনা বিবেচনায় খাতভিত্তিক প্রণোদনা হতে পারে। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক থেকে। ফলে পোশাকে প্রণোদনা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তবে শুধু প্রণোদনায় শিল্পের স্থায়ী উন্নয়ন হয় না। প্রণোদনা প্রদানের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আসল কথা হচ্ছে, প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কীভাবে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন করা যায়, লিড টাইম কমানো যায়- এসব বিষয় নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০১৯
আবু হেনা মুহিব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন