মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি ১৯৭৫ সালে। নানাবাড়ির লোকদের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হই। বাবার চাওয়া ছিল শিক্ষক। আর আমি হতে চাইতাম প্রকৌশলী। শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হই রসায়ন বিষয়ে। মাস্টার্সে থিসিসের বিষয় ছিল গন্ধভাদুলি নামের একটি গাছ। পেট খারাপ হওয়ার রোগে এর রস খাওয়ানোর চল আছে। আমি চাইলাম এর সেই নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠনটি জানতে, যা প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ওই সময় একটি বিজ্ঞান জার্নালে এই গবেষণা নিয়ে নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৮৪ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগদান করি। প্রথমে অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে, পরে রেডিয়েশন কেমিস্ট্রিতে চলে যাই।
তখন রেডিয়েশন কেমিস্ট্রি নতুন খোলা হয়েছে। মনে হলো, নতুন সাবজেক্ট। এখানে ক্যারিয়ার ডেভেলপের সুযোগ বেশি। হলোও তাই। দেশ-বিদেশে কাজের প্রচুর সুযোগ পেলাম। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে গবেষণা শেষ করে দেশে ফিরলাম ১৯৯০ সালে। কাঠের সঙ্গে পলিমার মিশিয়ে উড প্লাস্টিক কম্পোজিট তৈরি করার উপায় ছিল পিএইচডির বিষয়। আমি বেছে নিয়েছিলাম এখানকার সবচেয়ে ভালনারেবল (সহজেই আক্রান্ত হতে পারে এমন) কাঠ শিমুল ও আম। গবেষণা করে দেখলাম, শিমুল ও আম কাঠকে লোহার মতো শক্ত করা যায়। এর কিছুকাল পরই মাথায় এলো, কাঠে যদি হয় তাহলে পাটে হবে না কেন? পাটের দুটি খারাপ দিক প্রথমে নজরে এলো—এটা দ্রুত পানি শোষণ করে এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়।
পাটের প্রতি ভালোবাসা:
পাটের সুতাকে ইম্প্রুভ করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম পাট শুকিয়ে লিকুইড মনোমারের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে পাট মনোমারটা শোষণ করে নেয়। তারপর গামা রেডিয়েশন দিয়ে ক্রসলিংকিং করালাম। দেখলাম এতে পাটের শক্তি বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাটের যে গ্রুপটি পানি টেনে নিত তা আর কাজ করছে না। পানি নেয় না বলে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে না। আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল—পাটকে বায়োডিগ্রেডেবল (পচনযোগ্য) করা। পাট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৯২ সালের দিকে। আমেরিকার জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড পলিমার সায়েন্সে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হলো। এই জার্নালটিকে সায়েন্টিস্টরা পলিমার সায়েন্সের বাইবেল বলে থাকেন। তখন দেশে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের প্রফেসর হেনরিকসন চিঠি লিখে জার্নালটির কপি চাইলেন আমার কাছে। তখন আমি পোস্টডক খুঁজছিলাম। প্রফেসর হেনরিকসনকে লিখলাম, ‘নিশ্চয়ই তুমি ন্যাচারাল ফাইবার নিয়ে কাজ করো। তোমার ওইখানে কাজের কোনো সুযোগ আছে কি না?’ তিনি বললেন, ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ’ আমি উৎসাহ পেয়ে ঠিক করলাম পাট নিয়ে যা যা করা যায় সব করব।
প্রথমে পাটের বস্তা, পরে কার্পেট নিয়ে কাজ শুরু করলাম। এর মধ্যে জার্মান একাডেমি অব একচেঞ্জ সার্ভিস স্কলারশিপ নিয়ে জার্মান টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। ফিরে এসে কাজটা শুরু করলাম নতুন স্টাইলে। প্রলিপ্রোপাইলিন, পলিমার আর পাট গুঁড়া করে একসঙ্গে মিক্সড করা। পাটের চট, পলিমার আর প্রলিপ্রোপাইলিন কম্পোজ করে জিনিস বানানো শুরু করলাম।
এবার জাপানে:
১৯৯৭ সালে জাপান গেলাম দ্য মাসরুমাই ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন স্কলারশিপ নিয়ে। ওখানে প্রাকৃতিক রাবারের সঙ্গে সিনথেটিক বায়োপলিমার (বাইয়োনল) কম্পোজিট তৈরির কাজ শুরু করলাম। জাপানে এই কাজ শেষ হতে না হতেই জার্মানিতে এভিএইচ ফেলোশিপটা হয়ে গেল। ফ্যামিলিসহ জার্মানি চলে গেলাম। বছরখানেক পর ফিরে এলাম দেশে। ২০০১ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। একবার বোয়িং (উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) কম্পানির লোকেরা আমার প্রফেসরকে (প্রফেসর ড্রাজেল) এসে বললেন, ‘উড়োজাহাজের ভেতরের ফেনসিং ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করে দিতে পারবে?’ তখন প্রফেসর
আমাকে বললেন—‘পারবে?’
বললাম, ‘পারব। ’
আমি একদিন পাট ও পলিমার কম্পোজিট দিয়ে ফেনসিং বানিয়ে প্রফেসরের সামনে হাজির হলাম। উল্লেখ্য, ওই ফেনসিংটা সাধারণত গ্লাস ফাইবারের হয়। প্রফেসর খুব খুশি। জড়িয়ে ধরলেন। এর মধ্যে আমি টুক করে বলে দিলাম, ‘দেশে চলে যাব। ’
—মানে কী?
—আমার দেশের পাট। আমার আইডিয়া। আর এ দেশে কাজটা হচ্ছে। এতে আমেরিকার উপকার হচ্ছে।
—বাংলাদেশে গিয়ে কী করবা? তোমার দেশের মানুষ এসে আমাদের জিজ্ঞেস করে—কোথায় কেমনে থাকা যায়। আর তোমাকে এত কষ্ট করে আমি নিয়ে এলাম। তুমি বলছ চলে যাবে। আমার এ প্রজেক্ট কে চালাবে? কিন্তু আমি গোঁ ছাড়লাম না।
তখন পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘ইটস ওকে। ইউ আর আ রিয়েল প্যাট্রয়েট। ’
দেশে ফেরার কিছুদিন পর আবার জার্মান গেলাম। গাড়ির বডি বানানোর কথা ভাবলাম। মার্সিডিজ বেঞ্জ কম্পানির সঙ্গে কথা হলো। ওরা সহজে কোনো কিছুতে সায় দেয় না। সব কিছুর প্রমাণ চায়। শেষ পর্যন্ত আমি গাড়ির পুরো বডি বানাতে সক্ষম হলাম। কিন্তু পাটের গাড়িতে করে চলাচল করার সাহস এখনো মানুষের হয়নি। ফলে এই প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখেনি।
ঘর বানালাম:
জার্মানি থেকে ফেরার পর মাথায় ঢুকল টিন বানাব। পাটের সঙ্গে রেজিন দিয়ে দেখি টিন তো হচ্ছে ভালোই। হিটপ্রুফ। ফলে গরমের দিনে আরাম মেলে। জুটিন নামে একটা পেটেন্ট করে নিলাম। তারপর পাটের প্লেইন শিট, ডেকোরেটিভ শিট, চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে যত রকম ফার্নিচার আছে সব বানালাম। এ কে খান গ্রুপসহ আরো অনেকের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা হলো। কিন্তু ফাইনাল অ্যাগ্রিমেন্টে যেতে পারিনি। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও যে কিছু পারেন এই দেশের মানুষকে বিশ্বাস করানো মুশকিল। সাভারে একটি প্রটোটাইপ ঘর বানিয়ে রেখেছি, বারান্দাটারান্দা দিয়ে। মনে করছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আনব। দেখাব, সব কিছু পাট দিয়ে বানানো যায়।
পাটের ল্যাট্রিন:
একদিন এলজিআরডি মিনিস্ট্রি থেকে টেলিফোন পেলাম। বলল, ‘স্যার আমরা জেনেছি, আপনি পাট থেকে নানা ধরনের জিনিস বানান। আপনি কি স্যানিটারি ল্যাট্রিন বানিয়ে দিতে পারবেন?’ আইডিয়াটা একেবারে নতুন। তা-ও চ্যালেঞ্জটি নিলাম। তারপর এলজিআরডি মিনিস্ট্রি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওয়াটার এইড, আহ্ছানিয়া মিশনসহ বড় বড় এনজিওর প্রতিনিধিরা আমার সঙ্গে মিটিং করলেন। প্রথমে তাঁরা একটা মডেল দিতে বললেন। সেখানে একজন কথায় কথায় বললেন—‘স্যার, আমরা নেদারল্যান্ডসে গিয়েছিলাম প্লাস্টিকের ল্যাট্রিনের জন্য। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা একটা প্লাস্টিকের ল্যাট্রিনের দাম। তখন ওখানকার একজন আপনার কার্ডটা দিল। ’
যা হোক, প্রথমে ১০টি ল্যাট্রিনের মডেল বানিয়ে দিলাম। এরপর ৩০০ ল্যাট্রিন চাইল। দিলাম। এরপর আরো ৪০০ চাইল।
পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ:
২০০২ সালে পাটের ব্যাগ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। তখন পলিথিনে দেশ ছেয়ে গেছে। ভাবলাম, বিকল্প না দিলে শুধু আইন করে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। গবেষণার পর দেখলাম, পাটের আঁশ থেকে সেলুলোজ নামের উপাদান দিয়ে পলিথিনের বিকল্প তৈরি করা যায়। আমার দলের ছাত্র-ছাত্রীরা দিন-রাত খাটল। ফলও পেলাম। পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ দেখতে পলিথিন ব্যাগের মতো। সেই সঙ্গে অনেক টেকসই ও মজবুত। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে মাটিতে পুরোপুরি পচে যাবে। ২০১৭ সালের ১২ মে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে সোনালি ব্যাগের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। উদ্ভাবনের পর থেকে চিন্তা শুরু হয়েছিল কত দ্রুত এই উদ্ভাবনটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে এই কাজটি এত দিন এগোয়নি ফান্ডের অভাবে। এখন মেশিন কেনার জন্য টেন্ডার হয়ে গেছে। শিগগিরই দৈনিক এক টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে যাওয়া যাবে।
আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কম্পানিগুলোর কাছ থেকে অফার পেয়েছি। তারা সোনালি ব্যাগের পেটেন্ট কিনতে চায়। কিন্তু আমি চাই এটা বাংলাদেশে থাকুক। কারণ আমি মনে করি, সোনালি ব্যাগ বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করবে। এখন পাট থেকে সেলুলোজ ন্যানো ক্রিস্টাল এবং সেলুলোজ ন্যানো ফাইবার নিয়ে কাজ করছি। এটা মেডিক্যাল সায়েন্স এবং শিল্প-কারখানায় দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।
এতোক্ষণ যার গবেষণা নিয়ে কথা বলতেছিলাম তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আমাদের বাংলাদেশের গর্ব, বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন