ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড | ABA Group - Vintage Denim Studio Ltd - Textile Lab | Textile Learning Blog
ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড | ABA Group - Vintage Denim Studio Ltd

কারখানা চালিয়েও কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করা যায়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদীর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ১০ একর জমির ওপর তৈরি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড।

প্রথম শীতের দুপুর। রোদের তেমন তেজ নেই। একটা কৃত্রিম আয়তাকার পুকুরের সবজেটে পানিতে সাঁতার কাটছে তেলাপিয়াসহ একঝাঁক মাছ। এই সবুজ রঙের পানি ডেনিম ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। সেই পানি রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। পুকুরটি সাজানো হয়েছে পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা পাত্রে লাগানো বিদেশি গাছপালা দিয়ে।

দুপুরের খাবারের বিরতির সময় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছেদের খেলা দেখছিলেন কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর আফরোজা পিংকি। এ সময় কারখানা প্রাঙ্গণের ফাঁকা ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন কয়েকজন পুরুষ শ্রমিক।

দুই বছর ধরে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেডে কর্মরত পিংকি বললেন, 'এই মাছগুলো আমার পছন্দ। এখানকার পরিবেশ অন্যান্য কারখানার চেয়ে একেবারেই আলাদা। মাঝে মাঝে তো ভুলেই যাই যে আমি কাজ করছি।'

কারখানা চালিয়েও কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করা যায়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদীর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ১০ একর জমির ওপর তৈরি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড। তাছাড়া কর্মীদের জন্য কীভাবে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা যায় এবং পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সহজ ভাষায় বললে, সবুজ কারখানা হলো এমন পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থা যেখানে পরিবেশের ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। 

৯০ পয়েন্ট নিয়ে দেশের প্রথম লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইনের (লিড) প্লাটিনাম সনদ পাওয়া তৈরি পোশাক কারখানা (আরএমজি) ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড আগামী মে মাসে ১০ বছরে পা দেবে।
গত সাড়ে নয় বছরে এই কারখানার মালিকদের কখনও কার্যাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। কেননা পশ্চিমা ক্রেতারা পণ্য কিনতে নিয়মনীতি মেনে চলা এই সবুজ কারখানাকে অগ্রাধিকার দেয়।

ওভেন বোতাম ও টপস তৈরির কারখানাটিতে এখন ৩ হাজারের বেশি লোক কাজ করছে। এর বার্ষিক টার্নওভার ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর থেকে পোশাক উদ্যোক্তারা সবুজ উদ্যোগে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। 

তবে ভিনটেজ ডেনিমের সবুজ কারখানাটি স্থাপন করা হয় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিরও এক বছর আগে। ওই ট্র্যাজেডির পর কয়েক হাজার আরএমজি কারখানা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিয়মনীতি ঢেলে সাজায়। 

এবিএ গ্রুপ আরও তিনটি সবুজ কারখানা স্থাপন করেছে—ভিনটেজ ডেনিম অ্যাপারেলস লিমিটেড, এবিএ ফ্যাশনস লিমিটেড, পিমকি অ্যাপারেলস লিমিটেড। এই তিনটি আরএমজি কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে আরও অনেক কোম্পানিই সবুজ কারখানার ধারণা স্থাপনে এগিয়ে আসছে। গত অক্টোবরে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) কাছ থেকে লিড সনদ পেয়েছে আরেক বাংলাদেশি কারখানা ডেনিম প্রসেসিং প্ল্যান্ট।
 
এ নিয়ে বাংলাদেশে এখন ইউএসজিবিসি থেকে লিড সনদ পাওয়া মোট কারখানার সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে ৪৪টি কারখানা প্লাটিনাম, ৯৩টি গোল্ড, নয়টি সিলভার ও চারটি কারখানা লেড-রেটেড সনদপ্রাপ্ত।

আরএমজি কারখানার মালিকদের বিশ্বাস, সবুজ উদ্যোগ একইসাথে শিল্প ও দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা সবুজ ভবনে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন।

যেভাবে শুরুঃ

২০১০ সালে, এবিএ গ্রুপের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান মৃধা দেশে একটি আধুনিক আরএমজি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। সে উদ্দেশ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ করেন। ওই পরামর্শক সংস্থাটির এর আগে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে একটি লিড প্লাটিনাম সনদপ্রাপ্ত কারখানা নির্মাণে সহায়তা করার অভিজ্ঞতা ছিল। 

পরামর্শদাতা সংস্থাটি সাজ্জাদুর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিল, তিনি তার পোশাক কারখানাকে সবুজ কারখানায় রূপান্তরিত করতে চান কি না। সাজ্জাদুর রহমান সম্মতি দেন। তবে বলে দেন যে, আগে তিনি শ্রীলঙ্কার কারখানাটি দেখে নেবেন। 

সাজ্জাদুরকে প্রথমে শ্রীলঙ্কার কারখানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তবে এক এক সপ্তাহ পর তিনি কারখানাটি পরিদর্শনের অনুমতি পান। সেখান থেকে সাজ্জাদুর সবুজ কারখানা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সবুজ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

সাজ্জাদুর জানান, কলম্বোর ওই আরএমজি কারখানাটির খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ব্রিটিশ রিটেইল জায়ান্ট মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের সাথে যৌথভাবে কাজ করছিল ওই কারখানা। 

তিনি বলেন, 'আমি যখন শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কে যেতাম, তখন দেখতাম তাদের কারখানাগুলো আমাদের তুলনায় অনেক আধুনিক ও সুশৃঙ্খল। একটা আধুনিক কারখানা শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে। আপনি যখন কর্মীদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবেন, তখন তাদের উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা দুটোই বাড়বে।

'কারখানায় সেন্ট্রাল এসি থাকায় আমার শ্রমিকদের ঘামতে হয় না।

২০১২ সালের মে মাসে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড ৯০ পয়েন্টসহ লিড সনদ পায়।
লিড সনদ পেতে হলে একটি কারখানায় বায়ু পরিশোধনের জন্য সাতটি ফিল্টারসহ কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হয়। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে কমপক্ষে ১৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকতে হয়। 

নির্মাণ নির্দেশিকা অনুযায়ী কারখানার কাঠামো তৈরির জন্য ভিনটেজ ডেনিম মালিকদের আধপোড়া ইট ব্যবহার করতে হয়েছে। ভবন যেন তাপ ও বায়ু শোষণ করতে পারে, সেজন্য আধপোড়া ইট ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ভবনের ভেতরে ও বাইরে ন্যূনতম পরিমাণে পেইন্টিং ব্যবহার করতে হয়।

কোম্পানিটি তাদের জ্বালানি খরচ ৪৬ শতাংশ, পানি খরচ ৫৩ শতাংশ ও কার্বন ফুটপ্রিন্ট ৪৫ শতাংশ কমিয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ সরবরাহের ১০ শতাংশ আসছে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে। এর ফলে কোম্পানিটির উৎপাদনশীলতা যেমন বেড়েছে, তেমনি কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্রও নিশ্চিত হয়েছে।

কারখানাটি ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোথাও না বানিয়ে বানানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বহু দূরে ঈশ্বরদী ইপিজেডে। কেননা লিড সনদের শর্তানুসারে, কৃষি জমি, পতিত জমি বা শিল্প বেল্টে কোনো কারখানা নির্মাণ করা যাবে না।

সাজ্জাদুর বলেন, 'আমরা ঢাকা বা চট্টগ্রামে এমন কোনো প্লট পাইনি। বেপজার পরামর্শ অনুযায়ী আমরা সেখানে [ইপিজেডের ভেতরে] কারখানা তৈরি করেছি এবং তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা পেয়েছি।'

সবুজ কারখানার সুফল ঘরে তুলছে ভিনটেজঃ

সবুজ কারখানার মালিকরা ক্রেতাদের কাছ থেকে দামের সুবিধা পান না ঠিকই, তবে কার্যাদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পান।

সাজ্জাদুর বলেন, 'নন-গ্রিন ফ্যাক্টরি আর গ্রিন ফ্যাক্টরির পণ্যের দাম একই। তবে গ্রিন ফ্যাক্টরি হলে আপনি ব্যবসায়িক অগ্রাধিকার পাবেন। এটাই সুবিধা।'
তিনি আরও বলেন, সবুজ কারখানার মালিকেরা দীর্ঘমেয়াদে সুফল পান। গত দশ বছরে তার কারখানার ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এমনকি করোনাকালেও কারখানাটির ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ।

সাজ্জাদুর বলেন, 'সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছি বলে আমাদের বিদ্যুৎ খরচ বাঁচছে।'

তবে সবুজ কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি। কারণ সবুজ কারখানার চেহারা নতুনের মতো রাখতে হয়। ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড প্রায় দশ বছর আগে নির্মিত হলেও কারখানাটিকে এখনও নতুনের মতোই দেখায়।

ভিনটেজ ডেনিমের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, এবিএ গ্রুপের মোট ক্রেতাসংখ্যা ৫০-৬০। তাদের মধ্যে বিখ্যাত জিএপি, এইচঅ্যান্ডএম ও আমেরিকান ইগলসহ পাঁচ-ছয়টি ক্রেতার জন্য কাজ করে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড।

মামুন বলেন, 'ইউরোপ ও আমেরিকার সব ক্রেতাই এখন কমপ্লায়েন্সকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তাই স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো সবুজ কারখানা স্থাপনের দিকে যাচ্ছে।'
লিড সনদে ১০০-তে ১০০ স্কোর অর্জনের জন্য ভিনটেজ ডেনিমকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। 

বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে লিড সনদের স্কোর দেওয়া হয়। ভিনটেজ ডেনিমের কারখানাটি টেকসই সাইটে ২৬-এ ২৩, জ্বালানি দক্ষতায় ৩৫-এ ২৮, উপকরণ ও সম্পদে ১৪-তে ৬ এবং অভ্যন্তরীণ পরিবেশের গুণমানে ১৫-এর মধ্যে ১৩ স্কোর পেয়েছে।

এছাড়াও কারখানাটি পানি দক্ষতায় ১০-এ ১০, উদ্ভাবনে ৬-এ ৬ এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারে ৪-এ ৪ স্কোর পেয়েছে।

নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'আমাদের লিড সার্টিফিকেশন স্কোর ১০০ পয়েন্টে উন্নীত করার জন্য এখন আমাদের যেসব ক্ষেত্রে উন্নতি করা প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।'

কপিরাইটঃ
রিপোর্টঃআরিফুল ইসলাম মিঠু
টিবিএস বাংলা 
ছবি: ওয়ালিদ ইবনে শাহ

ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড | ABA Group - Vintage Denim Studio Ltd

ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড | ABA Group - Vintage Denim Studio Ltd

কারখানা চালিয়েও কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করা যায়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদীর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ১০ একর জমির ওপর তৈরি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড।

প্রথম শীতের দুপুর। রোদের তেমন তেজ নেই। একটা কৃত্রিম আয়তাকার পুকুরের সবজেটে পানিতে সাঁতার কাটছে তেলাপিয়াসহ একঝাঁক মাছ। এই সবুজ রঙের পানি ডেনিম ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। সেই পানি রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। পুকুরটি সাজানো হয়েছে পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা পাত্রে লাগানো বিদেশি গাছপালা দিয়ে।

দুপুরের খাবারের বিরতির সময় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছেদের খেলা দেখছিলেন কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর আফরোজা পিংকি। এ সময় কারখানা প্রাঙ্গণের ফাঁকা ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন কয়েকজন পুরুষ শ্রমিক।

দুই বছর ধরে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেডে কর্মরত পিংকি বললেন, 'এই মাছগুলো আমার পছন্দ। এখানকার পরিবেশ অন্যান্য কারখানার চেয়ে একেবারেই আলাদা। মাঝে মাঝে তো ভুলেই যাই যে আমি কাজ করছি।'

কারখানা চালিয়েও কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করা যায়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদীর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ১০ একর জমির ওপর তৈরি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড। তাছাড়া কর্মীদের জন্য কীভাবে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা যায় এবং পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সহজ ভাষায় বললে, সবুজ কারখানা হলো এমন পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থা যেখানে পরিবেশের ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। 

৯০ পয়েন্ট নিয়ে দেশের প্রথম লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইনের (লিড) প্লাটিনাম সনদ পাওয়া তৈরি পোশাক কারখানা (আরএমজি) ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড আগামী মে মাসে ১০ বছরে পা দেবে।
গত সাড়ে নয় বছরে এই কারখানার মালিকদের কখনও কার্যাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। কেননা পশ্চিমা ক্রেতারা পণ্য কিনতে নিয়মনীতি মেনে চলা এই সবুজ কারখানাকে অগ্রাধিকার দেয়।

ওভেন বোতাম ও টপস তৈরির কারখানাটিতে এখন ৩ হাজারের বেশি লোক কাজ করছে। এর বার্ষিক টার্নওভার ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর থেকে পোশাক উদ্যোক্তারা সবুজ উদ্যোগে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। 

তবে ভিনটেজ ডেনিমের সবুজ কারখানাটি স্থাপন করা হয় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিরও এক বছর আগে। ওই ট্র্যাজেডির পর কয়েক হাজার আরএমজি কারখানা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিয়মনীতি ঢেলে সাজায়। 

এবিএ গ্রুপ আরও তিনটি সবুজ কারখানা স্থাপন করেছে—ভিনটেজ ডেনিম অ্যাপারেলস লিমিটেড, এবিএ ফ্যাশনস লিমিটেড, পিমকি অ্যাপারেলস লিমিটেড। এই তিনটি আরএমজি কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে আরও অনেক কোম্পানিই সবুজ কারখানার ধারণা স্থাপনে এগিয়ে আসছে। গত অক্টোবরে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) কাছ থেকে লিড সনদ পেয়েছে আরেক বাংলাদেশি কারখানা ডেনিম প্রসেসিং প্ল্যান্ট।
 
এ নিয়ে বাংলাদেশে এখন ইউএসজিবিসি থেকে লিড সনদ পাওয়া মোট কারখানার সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে ৪৪টি কারখানা প্লাটিনাম, ৯৩টি গোল্ড, নয়টি সিলভার ও চারটি কারখানা লেড-রেটেড সনদপ্রাপ্ত।

আরএমজি কারখানার মালিকদের বিশ্বাস, সবুজ উদ্যোগ একইসাথে শিল্প ও দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা সবুজ ভবনে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন।

যেভাবে শুরুঃ

২০১০ সালে, এবিএ গ্রুপের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান মৃধা দেশে একটি আধুনিক আরএমজি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। সে উদ্দেশ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ করেন। ওই পরামর্শক সংস্থাটির এর আগে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে একটি লিড প্লাটিনাম সনদপ্রাপ্ত কারখানা নির্মাণে সহায়তা করার অভিজ্ঞতা ছিল। 

পরামর্শদাতা সংস্থাটি সাজ্জাদুর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিল, তিনি তার পোশাক কারখানাকে সবুজ কারখানায় রূপান্তরিত করতে চান কি না। সাজ্জাদুর রহমান সম্মতি দেন। তবে বলে দেন যে, আগে তিনি শ্রীলঙ্কার কারখানাটি দেখে নেবেন। 

সাজ্জাদুরকে প্রথমে শ্রীলঙ্কার কারখানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তবে এক এক সপ্তাহ পর তিনি কারখানাটি পরিদর্শনের অনুমতি পান। সেখান থেকে সাজ্জাদুর সবুজ কারখানা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সবুজ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

সাজ্জাদুর জানান, কলম্বোর ওই আরএমজি কারখানাটির খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ব্রিটিশ রিটেইল জায়ান্ট মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের সাথে যৌথভাবে কাজ করছিল ওই কারখানা। 

তিনি বলেন, 'আমি যখন শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কে যেতাম, তখন দেখতাম তাদের কারখানাগুলো আমাদের তুলনায় অনেক আধুনিক ও সুশৃঙ্খল। একটা আধুনিক কারখানা শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে। আপনি যখন কর্মীদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবেন, তখন তাদের উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা দুটোই বাড়বে।

'কারখানায় সেন্ট্রাল এসি থাকায় আমার শ্রমিকদের ঘামতে হয় না।

২০১২ সালের মে মাসে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড ৯০ পয়েন্টসহ লিড সনদ পায়।
লিড সনদ পেতে হলে একটি কারখানায় বায়ু পরিশোধনের জন্য সাতটি ফিল্টারসহ কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হয়। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে কমপক্ষে ১৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকতে হয়। 

নির্মাণ নির্দেশিকা অনুযায়ী কারখানার কাঠামো তৈরির জন্য ভিনটেজ ডেনিম মালিকদের আধপোড়া ইট ব্যবহার করতে হয়েছে। ভবন যেন তাপ ও বায়ু শোষণ করতে পারে, সেজন্য আধপোড়া ইট ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ভবনের ভেতরে ও বাইরে ন্যূনতম পরিমাণে পেইন্টিং ব্যবহার করতে হয়।

কোম্পানিটি তাদের জ্বালানি খরচ ৪৬ শতাংশ, পানি খরচ ৫৩ শতাংশ ও কার্বন ফুটপ্রিন্ট ৪৫ শতাংশ কমিয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ সরবরাহের ১০ শতাংশ আসছে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে। এর ফলে কোম্পানিটির উৎপাদনশীলতা যেমন বেড়েছে, তেমনি কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্রও নিশ্চিত হয়েছে।

কারখানাটি ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোথাও না বানিয়ে বানানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বহু দূরে ঈশ্বরদী ইপিজেডে। কেননা লিড সনদের শর্তানুসারে, কৃষি জমি, পতিত জমি বা শিল্প বেল্টে কোনো কারখানা নির্মাণ করা যাবে না।

সাজ্জাদুর বলেন, 'আমরা ঢাকা বা চট্টগ্রামে এমন কোনো প্লট পাইনি। বেপজার পরামর্শ অনুযায়ী আমরা সেখানে [ইপিজেডের ভেতরে] কারখানা তৈরি করেছি এবং তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা পেয়েছি।'

সবুজ কারখানার সুফল ঘরে তুলছে ভিনটেজঃ

সবুজ কারখানার মালিকরা ক্রেতাদের কাছ থেকে দামের সুবিধা পান না ঠিকই, তবে কার্যাদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পান।

সাজ্জাদুর বলেন, 'নন-গ্রিন ফ্যাক্টরি আর গ্রিন ফ্যাক্টরির পণ্যের দাম একই। তবে গ্রিন ফ্যাক্টরি হলে আপনি ব্যবসায়িক অগ্রাধিকার পাবেন। এটাই সুবিধা।'
তিনি আরও বলেন, সবুজ কারখানার মালিকেরা দীর্ঘমেয়াদে সুফল পান। গত দশ বছরে তার কারখানার ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এমনকি করোনাকালেও কারখানাটির ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ।

সাজ্জাদুর বলেন, 'সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছি বলে আমাদের বিদ্যুৎ খরচ বাঁচছে।'

তবে সবুজ কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি। কারণ সবুজ কারখানার চেহারা নতুনের মতো রাখতে হয়। ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড প্রায় দশ বছর আগে নির্মিত হলেও কারখানাটিকে এখনও নতুনের মতোই দেখায়।

ভিনটেজ ডেনিমের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, এবিএ গ্রুপের মোট ক্রেতাসংখ্যা ৫০-৬০। তাদের মধ্যে বিখ্যাত জিএপি, এইচঅ্যান্ডএম ও আমেরিকান ইগলসহ পাঁচ-ছয়টি ক্রেতার জন্য কাজ করে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড।

মামুন বলেন, 'ইউরোপ ও আমেরিকার সব ক্রেতাই এখন কমপ্লায়েন্সকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তাই স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো সবুজ কারখানা স্থাপনের দিকে যাচ্ছে।'
লিড সনদে ১০০-তে ১০০ স্কোর অর্জনের জন্য ভিনটেজ ডেনিমকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। 

বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে লিড সনদের স্কোর দেওয়া হয়। ভিনটেজ ডেনিমের কারখানাটি টেকসই সাইটে ২৬-এ ২৩, জ্বালানি দক্ষতায় ৩৫-এ ২৮, উপকরণ ও সম্পদে ১৪-তে ৬ এবং অভ্যন্তরীণ পরিবেশের গুণমানে ১৫-এর মধ্যে ১৩ স্কোর পেয়েছে।

এছাড়াও কারখানাটি পানি দক্ষতায় ১০-এ ১০, উদ্ভাবনে ৬-এ ৬ এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারে ৪-এ ৪ স্কোর পেয়েছে।

নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'আমাদের লিড সার্টিফিকেশন স্কোর ১০০ পয়েন্টে উন্নীত করার জন্য এখন আমাদের যেসব ক্ষেত্রে উন্নতি করা প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।'

কপিরাইটঃ
রিপোর্টঃআরিফুল ইসলাম মিঠু
টিবিএস বাংলা 
ছবি: ওয়ালিদ ইবনে শাহ

কোন মন্তব্য নেই: