মসলিন ফেব্রিক | Muslin Fabrics
মসলিনের অনেক ধরন ছিল—ছিল হরেকনাম। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর নামটি হলো, ‘বাফত-হাওয়া’—অর্থাৎ ‘হাতে বোনা বাতাস’। নামটি দিয়েছিলেন একজন রাজকবি। এই মসলিন ছিল অত্যন্ত হালকা এবং বাতাসের মতোই কোমল ও মসৃণ। এক পরিব্রাজকের দেয়া তথ্যানুসারে, ৩০০ ফুট লম্বা একটি মসলিনের কাপড় অনায়াসে একটি আংটির ভেতর দিয়ে ঢোকানো ও বের করা যেত। আরেকজন বলেছিলেন, ৬০ ফুট, অর্থাৎ ১৮ মিটার মসলিনের কাপড় একটা পকেট সাইজের নস্যির বাক্সে অনায়াসে এঁটে যেত। এমনই স্বচ্ছ আর পাতলা ছিল ঢাকাই মসলিন।
১৮ শতকের শেষদিকে এক নতুন ফ্যাশনের আমদানি ঘটে ইউরোপে। আমদানিকৃত সেই ফ্যাশন কেলেঙ্কারিফেলে দেয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সমাজের গোটা একটা শ্রেণির বিরুদ্ধে নগ্ন হয়ে জনসমক্ষে চলে আসার অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
এ কেলেঙ্কারির মূল হোতা ছিল ঢাকাই মসলিন। আজকের দিনের মসলিনের মতো ছিল না সে কাপড়। সে আমলের মসলিন বানানো হতো ১৬টি ধাপে। কাপড়টি বানাবার জন্য যে দুর্লভ জাতের সুতো ব্যবহৃত হতো, সেই তুলো জন্মাত কেবল মেঘনার তীরে। হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তার সাথে রাজত্ব করে এসেছে ঢাকাই মসলিন। সেই যুগের অন্যতম সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো মসলিনকে। প্রাচীন গ্রিসের দেবীদের পোশাক থেকে শুরু করে দূর দেশ থেকে আসা অগণিত সম্রাট, এবং মোগলসম্রাট ও তার প্রজন্মের সবার পরিধেয় ছিল মসলিনের তৈরি।
উনিশ শতকে ব্যঙ্গ চিত্র, প্রকাশ্যে মসলিন পরার বিপদ। রোদে বা বৃষ্টিতে সুক্ষ মসলিন পরে শরীর অনাবৃত হয়ে পড়ার ঝুঁকি
মসলিনের অনেক ধরন ছিল—ছিল হরেকনাম। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর নামটি হলো, 'বাফত-হাওয়া'—অর্থাৎ 'হাতে বোনা বাতাস'। নামটি দিয়েছিলেন একজন রাজকবি। এই মসলিন ছিল অত্যন্ত হালকা এবং বাতাসের মতোই কোমল ও মসৃণ। এক পরিব্রাজকের দেয়া তথ্যানুসারে, ৩০০ ফুট লম্বা একটি মসলিনের কাপড় অনায়াসে একটি আংটির ভেতর দিয়ে ঢোকানো ও বের করা যেত। আরেকজন বলেছিলেন, ৬০ ফুট, অর্থাৎ ১৮ মিটার মসলিনের কাপড় একটা পকেট সাইজের নস্যির বাক্সে অনায়াসে এঁটে যেত। এমনই স্বচ্ছ আর পাতলা ছিল ঢাকাই মসলিন।
ঐতিহ্যগতভাবে দামি এই কাপড় ব্যবহার করা হতো শাড়ি ও জামা বানানোর কাজে। পুরুষদের টিউনিক-জাতীয় পোশাকেও এর ব্যবহার দেখা যেত। যুক্তরাজ্যে আভিজাতদের পোশাকের ধরনই আমূল বদলে দেয় মসলিন। স্কটিশ চিত্রশিল্পী আইজ্যাক ক্রুইকশ্যাঙ্ক মসলিনের পোশাক পরা একদল নারীর ক্যারিকেচার এঁকেছিলেন। সে ক্যারিকেচারে উজ্জ্বল রঙের মসলিন পরা প্রত্যেক নারীর নিতম্ব, স্তনসহ শরীরের প্রতিটি ভাঁজ সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। ব্যঙ্গাত্মক ছবিটির নিচে লেখা ছিল—'১৮০০ সালে শীতের পোশাক পরা প্যারিসীয় রমণী।'
মসলিনের তৈরি অতি সূক্ষ্ম কাপড় নিয়ে আরও নানা ধরনের নেতিবাচক সমালোচনা প্রচলিত ছিল সে সময়।এ প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি মাসিক পত্রিকায় ছাপা এরকম একখানা ব্যঙ্গাত্মক লেখার উল্লেখ করা যায়। লেখাটিতে দেখা যায়, এক দর্জি একজন নারী খদ্দেরকে হাল ফ্যাশনের জামার ব্যাপারে জ্ঞান দিচ্ছে। নিজেকেহাল ফ্যাশনের সাথে খাপ খাওয়াতে 'এক মুহূর্তের' বেশি লাগবে না বলে আশ্বস্ত করে সে মহিলাকে। এরপর দর্জি তাকে প্রথমেসায়া, তারপর কাঁচুলিও খুলে ফেলতে অনুরোধ করে। তারপর বলে, 'এই দেখুন, জামাকাপড় খুলে ফেললেই আপনার হাল ফ্যাশনের কাপড় পরা হয়ে গেল।'
এত সমালোচনার পরও তুমুল সাফল্য পায় ঢাকাই মসলিন। সে যুগে সবচেয়ে দামি পোশাক ছিল এটি। ফরাসিরানি মেরি অ্যান্তোনি, সম্রাট নেপোলিয়নের সহধর্মিণী সম্রাজ্ঞী জোসেফিন বোনাপোর্ট, লেখিকা জেন অস্টেন-সহ অসংখ্য বিখ্যাত মানুষ ছিলেন মসলিনের গুণমুগ্ধ ভক্ত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মসলিন যত দ্রুত ইউরোপে জায়গা করে নিয়েছিল, কাপড়টি যেন ঠিক তত দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ছবিঃ নেপোলিয়ানের প্রথম স্ত্রীর অত্যান্ত প্রিয় পরিধেয় ছিল ঢাকাই মসলিন
২০ শতকের শুরুর দিকে, বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় ঢাকাই মসলিন। মসলিন এখন শুধু টিকে আছে জাদুঘরে আর কিছু ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। এই কাপড়গুলো বানানোর কৌশলও এখন আর কেউ জানে না। আর মসলিন বানাতে 'গসিপিয়াম আর্বোরিয়াম ভার. নেগলেক্টা' (ফুটি কার্পাস) নামে যে তুলা ব্যবহার করা হতো, বিলুপ্ত হয়ে যায় সেটিও।
ছবিঃ খেয়ালি আঁশ
মেঘনার তীরে জন্মানো গাছ থেকে যে তুলা পাওয়া যেত, তা থেকেই বানানো হতো ঢাকাই মসলিন। প্রতি বসন্তে এখানকার ধূসর, পললমাটিতে বড় হতো ম্যাপলজাতীয় পাতাওয়ালা গাছটি। বছরে দুবার হলুদ ফুল ফুটত প্রাপ্তবয়স্ক ফুটি কার্পাস গাছে। এ ফুল থেকেই পাওয়া যেত তুষার শুভ্র সুতি তন্তু। এগুলো কোনো সাধারণ তন্তু ছিল না।
বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ তুলা আসে মধ্য আমেরিকার গসিপিয়াম হিরসাটাম থেকে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর লম্বা এক ধরনের তন্তু পাওয়া যায় এ তুলা থেকে। ফুটি কার্পাসের জ্ঞাতিভাই বলা যায় গসিপিয়াম হিরসাটামকে। তবে ফুটি কার্পাস থেকে যে তন্তু হতো, সেগুলো ছিল খাটো ও মোটা।
ফুটি কার্পাসের খাটো তন্তু দিয়ে আসলে শিল্প-কারখানার মেশিনের সাহায্যে সস্তা সুতো বানানো যেত না। এই সুতা দিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন ছিল। স্থানীয়রা সহস্র বছর ধরে কাজ করে এই বেয়াড়া সুতাকে বাগে আনার অসাধারণ কৌশল আবিষ্কার করেছিল।
ছবিঃ ফুটি কার্পাস
মোট ১৬ ধাপে তৈরি হতো মসলিন। প্রতিটি ধাপের কাজ করতেন আলাদা বিশেষজ্ঞ। কাজগুলো করার জন্য এত বেশি বিশেষজ্ঞের লাগত যে, শুধু তাদের নিয়েই আলাদা কিছু গ্রাম গড়েওঠে ঢাকার আশপাশে। এখনকার পশ্চিমবঙ্গেও ছিল এরকম বেশ কিছু গ্রাম। মসলিন তৈরির কাজ শুধু পুরুষরাই নন—নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবাই করতেন।
প্রথম ধাপে সুতার গুটিগুলোকে স্থানীয় নদী-খাল বা বোয়াল মাছের চোয়াল দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। পরের ধাপ ছিল সুতো কাটা। উচ্চমাত্রার আর্দ্রতা লাগত এ কাজের জন্য। তাই এ ধাপের কাজটি করা হতো নৌকায়।একদল দক্ষ যুবতী নারী খুব ভোরে এবং শেষ বিকেলে নৌকায় বসে এ কাজ করত। কারণ দিনের এ দুই সময়ই আবহাওয়া সবচেয়ে আর্দ্র থাকে। বয়স্করা সাধারণত সুতা কাটার কাজ করতেন না। কেননা এই সূক্ষ্ম সুতো তারা খালি চোখে দেখতে পেতেন না।
২০১২ সালে মসলিন নিয়ে লেখা একটি বইয়ের লেখক এবং নকশা ইতিহাসবিদ সোনিয়া অ্যাশমোর বলেন, 'এই সুতোর তন্তুগুলোঅসংখ্য ছোট ছোট সংযুক্তির সাহায্যে একসঙ্গে জোড়া লাগানো থাকত। এতে সুতোর পৃষ্ঠে এক ধরনের রুক্ষ রুক্ষ ভাব আসত। ফলে সুতগুলো ধরলেও ভালো লাগত।'
সবশেষে আসত বুনন প্রক্রিয়া। এই ধাপের কাজ শেষ করতে এক মাসও লেগে যেত। ক্লাসিকজামদানিতে নানা ধরনের জ্যামিতি আকৃতির ফুলের নকশা থাকত। অজস্র রুপার তন্তুর কারুকার্য থাকত এই জামদানিতে।
এশিয়ার বিস্ময়ঃ
ঢাকাই মসলিন যে মানুষের হাতে বানানো হয়, এ কথা পশ্চিমা ক্রেতারা প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি। এমনও গুজব ছিল, মসলিন বুনত জিন-ভূত, মৎস্যকন্যা এবং পরিরা। আবার অনেকে বলত, এগুলো বানানো হয় পানির নিচে।
সেই একই রকম বয়ন-পদ্ধতি আজও আছে এই জনপদে। কিন্তু এখন ফুটি কার্পাসের বদলে সাধারণ তুলো দিয়ে নিম্নমানের মসলিন বানানো হয়। ২০১৩ সালে ইউনেস্কো জামদানিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়।
মসলিন কাপড়ের মূল কৃতিত্ব হলো এর কাউন্টে। কাপড়ের কাউন্ট যত বেশি হবে, কাপড়টি পরতেও তত আরামদায়ক এবং নরম হবে। প্রতি বর্গ ইঞ্চি কাপড়ে উল্লম্ব ও অনুভূমিকভাবে যতগুলো সুতো থাকে তা-ই কাউন্ট।
মসলিন পুনরুজ্জীবিত করার কাজে অনেকদিন ধরে জড়িত সাইফুল ইসলাম। সেইসাথে একটি ফটো এজেন্সিও চালান। তিনি বলেন, বর্তমানে বেশির ভাগ সংস্করণের কাউন্ট সংখ্যা ৪০ থেকে ৮০-র মধ্যে। অথচ ঢাকাই মসলিনের কাউন্ট ছিল অনেক বেশি—৮০০ থেকে ১২০০।
ঢাকাই মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে শত বছর আগে। তবে আজও বিভিন্ন জাদুঘরে ঢাকাই মসলিনের তৈরি শাড়ি, টিউনিক, স্কার্ফ ও অন্যান্য পোশাক সংরক্ষিত আছে অক্ষত অবস্থায়।
ঔপনিবেশিক বাজারঃ
অ্যাশমোর বলেন, 'মসলিনের বাণিজ্য যেমন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিবিস্তৃত করেছিল, তেমনি তা ধ্বংসও করেছিল তারা।'
ইউরোপের অভিজাত নারীরা মসলিন পরতে শুরু করার বহু আগে থেকেই দুনিয়াজুড়ে এটি বিক্রি হতো। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল এর। দু-হাজার বছর আগে এক অজ্ঞাত মিসরীয়বণিক তার লেখা 'দ্য পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রাইয়ান সি' বইয়ে'ভারতের মসলিন' সম্পর্কে লিখেছিলেন।
রোমান লেখক পেট্রোনিয়াসই সম্ভবত প্রথম এই কাপড়ের স্বচ্ছতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে লেখেন। ১৪ শতকে বারবার-মরক্কোর অভিযাত্রী ইবনে বতুতা, এবং ১৫ শতকে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক মা হুয়ানসহ আরও অনেকেই মসলিনের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।
তবে তর্কাতীতভাবে এই পোশাক সোনালি সময় পার করেছে মোগল আমলে। দক্ষিণ এশিয়ার এ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে, বর্তমান উজবেকিস্তান থেকে আসা একজন যোদ্ধার হাতে। সেই থেকে ১৮ শতকে পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে সাম্রাজ্যটি। এইসময়ে, পারস্য (বর্তমান ইরান), ইরাক, তুর্কি ও মধ্যপ্রাচ্যের সওদাগরদের মধ্যে আকছার মসলিন কেনাবেচা হতো।
মোগল সম্রাট ও তাদের স্ত্রীরা এই পোশাক খুব পছন্দ করতেন। মসলিন ছাড়া অন্য কোনো পোশাক তারা বলতে গেলে পরতেনই না। দূর-দূরান্ত থেকে সেরা বয়নশিল্পীদের খুঁজে বের করে তাদের কাছ থেকে মসলিন নিয়ে আসতেন সম্রাটরা। তাদের সরাসরি চাকরি দিতেন। সর্বোৎকৃষ্ট কাপড়গুলো অন্য কারও কাছে বিক্রি করা নিষিদ্ধ করে দিতেন। মসলিনের স্বচ্ছতা নিয়ে জনশ্রুতি আছে, সম্রাট আওরঙ্গজেব একবার তার মেয়েকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন সে কেন জনসম্মুখে নগ্ন অবস্থায় এসেছে। অথচ তার মেয়ের পরনে ছিল সাত স্তরের মসলিনের পোশাক।
মসলিন পরিহিত এক অভিজাত নারী
তরতরিয়ে এগিয়ে চলছিল মসলিনের জয়রথ। কিন্তু সে সময়ই উদয় হলো ব্রিটিশরা। ১৭৯৩ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সাম্রাজ্য জয় করে। এরপর এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে গোটা অঞ্চল ব্রিটিশ রাজেরদখলেচলে যায়।
ঢাকাই মসলিনের সর্বপ্রথম প্রদর্শন ১৮৫১ সালে, যুক্তরাজ্যে। এ প্রদর্শনীর বুদ্ধি বেরিয়েছিল রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের মাথা থেকে। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদেরকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অমূল্য ও বিস্ময়কর সব সংগ্রহ দেখিয়ে চমকে দেয়া। পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে এক লাখেরও বেশি জিনিস আনা হয়েছিল সেই প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীটি হয়েছিল ১,৮৫২ ফুট লম্বা ও ১২৮ ফুট উঁচু ক্রিস্টাল প্যালেসের গ্লাস হলে।
সে সময় এক গজ ঢাকাই মসলিনের দাম ছিল ৫০-৪০০ পাউন্ড—এখনকার হিসেবে ৭,০০০-৫৬,০০০ পাউন্ড। সবচেয়ে ভালো সিল্কের দামও তখন এর ২৬ ভাগের এক ভাগ ছিল।
ভিক্টোরিয়ান লন্ডনবাসীরা যখন এই পোশাক নিয়ে মাতামাতি করছিল, ঠিক তখন এর প্রস্তুতকারীরা ঋণের দায়ে অর্থনৈতিক দুর্দশায় জর্জরিত। ১৮ শতকের শেষের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে ঢাকাই মসলিনের ব্যবসায় আসে, সে বর্ণনা আছে 'গুডস ফ্রম দি ইস্ট, ১৬০০-১৮৮০' বইয়ে।
প্রথমে কোম্পানি স্থানীয় গ্রাহকদের সরিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে নিয়ে আসে গ্রাহক হিসেবে। উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় অদ্ভুত সব নিয়ম যোগ করে গোটা ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তারা। কম দামে বেশি মসলিন বুনতে বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের।
ফুটি কার্পাস থেকে কাপড় বানাবার জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিনশেষে এক কেজি তুলা থেকেমাত্র আট গ্রাম উৎকৃষ্ট মানের মসলিন পাওয়া যেত।
কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কাপড়ের জোগান দিতে হিমশিম খেতে শুরু করলবয়নশিল্পীরা। ফলেঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ে তারা। যে পোশাক বানাতে এক বছর লেগে যেত, তার মাত্র একভাগের মূল্য তারা পেত। আবার পোশাকটা যদি ব্রিটিশদের মনমতো না হতো, তবে পুরো অর্থই তাদের ফেরত দিতে হতো। এই চক্রে পড়ে বয়নশিল্পীরা কখনও ঘাড় থেকে ঋণের বোঝা নামাতে পারেনি।
চূড়ান্ত ধাক্কাটি আসে প্রতিযোগিতার কারণে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে যে শিল্পগুলোয় ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেগুলো তাদের নথিভুক্ত করতে ব্যস্ত ছিল। মসলিনও এর বাইরে ছিল না। পোশাক তৈরির প্রতিটি ধাপের খুঁটিনাটি লিখে ফেলে তারা।
ইউরোপীয়দের মধ্যে বিলাসবহুল পোশাকের চাহিদা যত বাড়তে থাকে,ততই তাদের নিজ দেশে মসলিনের সস্তা সংস্করণ উৎপাদন উৎসাহী করা হয়। উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ল্যাংকশায়ারে টেক্সটাইল ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওল্ডনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্দরমহল থেকে তথ্য নিয়ে বেশি পরিমাণে চরকাতৈরি করেন, যাতে লন্ডনে বিপুল পরিমাণে কাপড় সরবরাহ করা যায়। ১৭৮৪ সাল নাগাদ তার অধীনে এক হাজার বয়নশিল্পী কাজ করতে আরম্ভ করে।
তবে ব্রিটিশদের বানানো সেই মসলিন গুণে-মানে ঢাকাই মসলিনের ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ব্রিটিশ মসলিন বানানোনিম্নমানের তুলা থেকে। সুতার কাউন্ট থাকত কম।ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে সস্তা মানহীন কাপড় উৎপাদনের কারণে ধীরে ধীরে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এছাড়াও যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও ভূমিকম্পের কারণে উপমহাদেশের অনেক তাঁতি নিম্ন মানের পোশাক তৈরি করতে শুরু করে। অন্যরা পেশা বদলে কৃষিকাজ আরম্ভ করে। এর ফলেগোটা শিল্পই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। প্রজন্ম পেরোনোর সাথে সাথে হারিয়ে গেছে কীভাবে ঢাকাই মসলিন তৈরি হতো সেই জ্ঞান। রেশমি সুতো কাটার মতো দক্ষতাসম্পন্ন কোনো শিল্পী আর অবশিষ্ট নেই। মেঘনার তীর ছাড়া অন্য কোথাও জন্মানো ফুটি কার্পাস জন্মানো যায়নি। হারিয়ে গেছে কিংবদন্তির সেই তাঁতিরাও।
পুনর্জন্মঃ
সাইফুল ইসলামের জন্ম বাংলাদেশে। প্রায় 20 বছর আগে তিনি লন্ডনে চলে যান। ঢাকাই মসলিনের ব্যাপারে তিনি প্রথম জানেন ২০১৩ সালে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য এই পোশাকের একটি প্রদর্শনী আয়োজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল দৃকে কর্মরত সাইফুল ইসলামকে। দৃকের তখন মনে হয়, কাপড়টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কাজেই তারা নিজেরাই গবেষণা শুরু করে।
পরের একটা বছর জুড়ে সাইফুল ইসলাম তার সহকর্মীদের নিয়ে স্থানীয় বয়নশিল্পীদের সঙ্গে দেখা করেন। মসলিন যে অঞ্চলে তৈরি হতো, সেখানে ঘুরে বেড়ান। ইউরোপের জাদুঘরে রাখা মসলিনের নমুনা দেখতে যান। তিনি জানান, ইউরোপে এ কাপড়ের বিস্তর সংগ্রহ থাকলেও, বাংলাদেশে নেই।
তাদের দলটি শেষ পর্যন্ত মসলিনের ওপর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীরআয়োজন করে। সেইসাথে তৈরি করে একটি চলচ্চিত্র, প্রকাশ করে সাইফুল ইসলাম রচিত একটি বই। একপর্যায়ে তারা ভাবতে শুরু করেন, কিংবদন্তির এই পোশাকটিকে ফিরিয়ে আনার ক্ষীণ...অত্যন্ত ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা হয়তো আছে। সেই উদ্দেশ্যেই তারা প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল মসলিন।
প্রথম কাজটি ছিল উপযুক্ত গাছ খুঁজে বের করা। ফুটি কার্পাসের বীজ বর্তমানে কারও সংগ্রহে না থাকলেও, তারা রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ-তে এর শুকনো, সংরক্ষিত পাতার খোঁজ পান। এ থেকে ফুটি কার্পাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স করতে পেরেছিলেন তারা।
গাছটির জিন-রহস্য উন্মোচন করে দলটি চলে এলবাংলাদেশে। মেঘনার ঐতিহাসিক মানচিত্রের সাথে আধুনিক স্যাটেলাইট ছবি মিলিয়ে গত 200 বছরে নদীটির গতিপথ কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা বের করেন। তারপর সেই চিত্র ধরে খুঁজে বের করেন ফুটি কার্পাসের সম্ভাব্য জন্মস্থানগুলো। এরপর নৌকায় চেপে পুরনো মানচিত্র ধরে ১২ কিলোমিটার জায়গা চষে ফেলে সাইফুল ইসলামের দলটি। খুঁজে দেখেন এই অঞ্চলের কোনো উদ্ভিদের সাথে প্রাচীনকালে আঁকা ফুটি কার্পাসের মিল আছে কি না।
কোনো গাছকে সন্দেহ হলেই সেটির ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করে মূল গাছটির সাথে মিলিয়ে দেখা হতে লাগল। অবশেষে একটা ঝোপের গাছের সাথে ৭০ শতাংশ মিল পাওয়া গেল।
এ গাছ জন্মানোর জন্য সাইফুল ইসলামরা প্রথমে ঢাকার উত্তরে, কাপাসিয়ার মেঘনা নদীর মাঝখানে ছোট্ট একটা চরে একখণ্ড জমি বাছাই করেন। পলি জমার কারণে জমিটি খুব উর্বর ছিল। ২০১৫ সালে ওখানে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বীজ বোনা হয়। কিছুদিনের মাঝেই শুকনো মাটির বুক চিরে মাথা তুলল বেশ কিছু ফুটি কার্পাস। এক শতাব্দী পর আবার বাংলার মাটিতে ফিরে এল হারিয়ে যাওয়া ফুটি কার্পাস।
২০১৫ সালেই দলটি তাদের প্রথম ব্যাচের তুলা সংগ্রহ করে। ১০০ ভাগ খাঁটি ঢাকাই মসলিন তৈরির জন্য সেই তুলা পর্যাপ্ত না হলেও, সাইফুল ইসলামরা ভারতীয়বয়নশিল্পীদের সাথে মিলে সাধারণ ও ফুটি কার্পাস তুলার মিশ্রণে সংকর সুতো তৈরি করেন। এরপরের কাজটি ছিল বুননের। সাইফুল ইসলাম যতটা ভেবেছিলেন, কাজটি তারচেয়েও জটিল।
বাংলাদেশে যেহেতুএখনও তাঁতিরা জামদানি মসলিন তৈরি করছে—যদিও তা কাউন্টের হিসেবে নিম্নমানের—তাই সাইফুল ইসলামের আশা ছিল এই তাঁতিদের একটু প্রশিক্ষণ দিয়েই তাদের দিয়ে পুরনো মসলিনের কাছাকাছি মানের কাপড় তৈরি করা সম্ভব হবে।
কিন্তু তাঁতিদের কেউই এ কাজ করতে রাজি হয়নি। সাইফুল ইসলাম যখন ৩০০ কাউন্টের কাপড় তৈরি করাতে চান, তারা বলে এটা স্রেফ পাগলামি।
একে একে পঁচিশজন তাঁতির সঙ্গে কথা বলার পর অবশেষে আল আমিন একজন রাজি হলো।
এই অঞ্চলের বেশিরভাগ তাঁতিই দরিদ্র, কাজ করে সাধারণ কুঁড়েতে। কাজেই আল আমিনের কাজ করার জন্য তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা হলো। এদিকে মসলিন তৈরির জন্য যে ৫০ ধরনের সরঞ্জামাদি লাগত, সেগুলোও গেছে বিলুপ্ত হয়ে। কাজেই সাইফুল ইসলামরা নিজেই ওসব সরঞ্জাম বানিয়ে নিলেন। ওরকম একটা সরঞ্জামের নাম শানা। একটুকরোবাঁশের তৈরি এই যন্ত্রে কয়েক হাজার কৃত্রিম দাঁত থাকে মিহি সুতোগুলোকে কাজের সময় জায়গামতো ধরে রাখার জন্য।
ছয় মাস হাড়ভাঙা খাটুনি খাটল আল আমিন। অনেক সংশোধনী আনল সুতায়, তারপরই একটা 300 কাউন্টের শাড়ি বানাতে পারল। শাড়িটি গুণে-মানে আসল ঢাকাই মসলিনের ধারেকাছে না গেলেও বর্তমান তাঁতিদের কাজের চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি উন্নতমানের।
এরপর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাইফুল ইসলামের দল তাদের হাইব্রিড মসলিন থেকে বেশ কয়েকটি শাড়ি তৈরি করে। সেগুলো ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে প্রদর্শিত হয়েছে। কিছু কিছু শাড়ি কয়েক হাজার পাউন্ড দামে বিক্রি হয়েছে। জনপ্রিয়তা দেখে মনে হচ্ছে, মসলিনের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে।
বন্যা সমস্যার কারণে পুরনো জমি ছেড়ে দিতে হলেও, সাইফুল ইসলামরা এখনও ফুটি কার্পাস জন্মাচ্ছেন। তারা এখন নদীতীরের আরেকটি জমিতে পুনরুজ্জীবিত গাছটির চাষ করছেন। ইসলাম আশা করছেন, ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি কাউন্টের খাঁটি ঢাকাই মসলিন বানাতে পারবেন।তাদের এই প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারও সহায়তা দিয়েছে। কে জানে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো খাঁটি মসলিনের পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে পারবে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন