ডেনিম এর ইতিহাস
‘ফুড, ওয়াটার,ডেনিম। লেটস গেট ব্যাক টু এসেনসিয়ালস।’ অজ্ঞাতনামা কথকের এই উক্তি জানিয়ে দেয় ফ্যাশন জগতেই শুধু নয়, আধুনিক মানুষের জীবনযাপনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ডেনিম জিনস। জিনসের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেরিলিন মনরো, এলভিস প্রিসলি, মার্লোন ব্রান্ডো কিংবা হালের মার্ক জাকারবার্গ । ভেসে ওঠে গত শতকের ষাটের দশকের হিপি আন্দোলনের কথা, সত্তর বা আশির দশকের পাঙ্ক রক ও হেভিমেটালের কথা। ফ্যাশন ও বিনোদনের ঝাঁ–চকচকে ভুবন থেকে বেরিয়ে আর একটু পেছনে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে নাবিক, খনিশ্রমিক এবং কাউবয়দের ছবি। মূলত তাদের জন্যই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছিল ডেনিম নামের শক্ত, মোটা আর টেকসই কাপড়। যা দিয়ে তৈরি হতো পোশাক, মূলত প্যান্ট।
ডেনিমের কথা এলেই চলে আসে জিনসের কথা। ডেনিম হলো পোশাক তৈরির মূল কাপড়। এই কাপড় দিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে তৈরি করা হয় ব্যবহারের উপযোগী শার্ট, প্যান্ট বা অন্যান্য পোশাক। সাধারণ কাপড়ের সঙ্গে ডেনিমের পার্থক্য রয়েছে। এর গঠন টুইল ওয়েভ নামে পরিচিত। এতে সুতার কোনাকুনি সারি তৈরি হয়। এ ছাড়া ডেনিম তৈরি হয় শতভাগ সুতি সুতায়। অন্যদিকে সাধারণত ডেনিম থেকে তৈরি পোশাককে বলা হয়ে থাকে জিনস। দীর্ঘ সময় শুধু জিনস প্যান্টই তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু এখন তৈরি হয় জিনস শার্ট, কোট, জ্যাকেট, জুতা ইত্যাদি।
একটা গল্প বলা যাক। বিখ্যাত মার্কিন গায়ক বিং ক্রসবি একবার শিকার করতে গিয়েছিলেন কানাডায়। এ সময় তাঁর পরনে ছিল লেভি স্ট্রসের তৈরি জিনস। হোটেলে ঘর নিতে গিয়ে তিনি পড়লেন বিপাকে। ম্যানেজার জিনস পরা ক্রসবিকে শ্রমিক মনে করে ঘর দিলেন না। পরে ক্রসবির পরিচয় পেয়ে ম্যানেজার ঘর দিয়েছিলেন বটে।
হ্যাঁ, জিনস আসলে শ্রমিকদের পরিধেয় বস্ত্রই ছিল একটা সময় পর্যন্ত। শ্রমজীবী মানুষের ব্যবহারের জন্য মোটা খসখসে কাপড়ের ব্যবহার বেশ প্রাচীন। এই মোটা খসখসে কাপড়কে বলা হতো ডানগারিজ। সতেরো শতকে প্রথম এই শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয়। বিরূপ আবহাওয়ায় কঠোর পরিশ্রমে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে এমন পোশাকের প্রয়োজন হয়েছিল বলেই মোটা কাপড় তৈরি হয়েছিল। ইংল্যান্ডের মানুষেরা মোটা খসখসে ভারতীয় কাপড়কে ডাংরি বা ডানগারি বলত। সে অন্য গল্প।
এই মোটা খসখসে কাপড়ের ইতিহাসের গল্পেই নিহিত আছে ডেনিম তৈরির গল্প। এখানে একটু বিশদে বলার প্রয়োজন রয়েছে। ‘জিনস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৭৯৫ সালে। এ সময় সুইস ব্যাংকার জ্যঁ গ্যাব্রিয়েল আইনার্ড এবং তাঁর ভাই জ্যাকুইস জেনোয়া শহরে তাঁদের কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৮০০ সালে ফরাসি কমান্ডার আন্দ্রেঁ মাসনার নেতৃত্বে ফরাসি সেনাদল জেনোয়া শহর দখল করলে জ্যঁ গ্যাব্রিয়েল তাঁর প্রতিষ্ঠানের বানানো মোটা কাপড়ের ইউনিফর্ম সেনাবাহিনীর জন্য সরবরাহ শুরু করেন। এই জেন গ্যাব্রিয়েল ইউনিফর্ম বানাতেন জেনোয়ার বিশেষ নীল কাপড় থেকে। এটাই পরে বিখ্যাত হয় ‘ব্লু জিনস’ নামে। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, ‘জিনস’ শব্দটি এসেছে ইতালির সমুদ্রবন্দর জেনোয়ার নাবিকদের কাছ থেকে। জেনোয়া শহরের নাবিকদের বলা হতো ‘জিন’ বা দৈত্য। এ অঞ্চলের তাঁতিরা সার্জ নামে এক ধরনের মোটা সুতির কাপড় তৈরি করতেন। ১৭ শতকে উত্তর ইতালিতে এই মোটা কাপড় শ্রমিকশ্রেণির পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেই মোটা কাপড় দিয়ে বানানো পোশাক ব্যবহার করতেন জেনোয়ার নাবিকেরাও।
১৮০৫ সালে জেনোয়া শহরে ফরাসি কনসুলেটের একটি বিভাগ ছিল বলে ফ্রান্সের সঙ্গে জেনোয়ার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ফ্রান্সের নিমস শহরের তাঁতিদেরও মোটা কাপড় তৈরির ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু তা ছিল মধ্যম মানের অর্থাৎ জেনোয়ার তাঁতিদের তৈরি সুতির মোটা কাপড়ের চাইতে গুণগতমানে কিছুটা নিম্নমানের। নিমস শহরের তাঁতিরা জেনোয়ার তাঁতিদের অনুকরণে কিছুটা উন্নত কাপড় তৈরি করতে চেষ্টা করে সে সময়। এই অনুকরণ করতে গিয়েই তৈরি হয় ‘সার্জ ডি নিমস’। এর অর্থ, নিম শহরের সার্জ। একে সংক্ষিপ্ত করে বলা হয় ডি নিম বা ডেনিম।
এই ডেনিম বা মোটা কাপড়ের তৈরি পোশাক বিশেষ করে প্যান্টকে আমেরিকায় জনপ্রিয় করেন লেভি স্ট্রস, যিনি ১৮৫১ সালে ভাগ্যের অন্বেষনে পাড়ি জমিয়েছিলেন জার্মানি থেকে নিউইয়র্কে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই সময় আমেরিকায় চলছিল গোল্ড রাশ। ১৮৫৩ সালে তিনি সানফ্রান্সিসকো চলে যান এবং সেখানে শুকনো দ্রব্যাদির ব্যবসা শুরু করেন। কিংবদন্তি আছে, সানফ্রান্সিসকোতে সোনার খনির শ্রমিকদের প্যান্ট খুব দ্রুত ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে যেত। এই অবস্থা দেখে লেভি স্ট্রস ভাবতে থাকেন, মোটা কাপড় দিয়ে যদি শ্রমিকদের জন্য প্যান্ট বানানো যায় তাহলে তা বেশিদিন টিকতে পারে। এই ভাবনা থেকে লেভি তাঁর দোকানের মোটা বাদামি রংয়ের কাপড় দিয়ে শ্রমিকদের জন্য প্যান্ট তৈরি করেন। জ্যাকব ডেভিস নামের এক দর্জি এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। শ্রমিকদের কাছে তাঁর তৈরি প্যান্ট আকর্ষণীয় করার জন্য লেভি পরবর্তী সময়ে বাদামি কাপড়কে নীল রঙে ডাই করেন। এ ঘটনা তাঁকে অভাবিত সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু প্যান্টের বিশেষ বিশেষ জায়গা খনিতে ঘষা লেগে দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাওয়া বন্ধ হয়নি তখনো।
লেভি ও ডেভিস দুজনেই এ বিষয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে প্যান্টের যে জায়গাগুলো খনির গায়ে ঘষা লেগে ক্ষয় হয়ে যায়, সেগুলোতে তামার পাত লাগাতে শুরু করেন। এই পাত লাগানো প্যান্টগুলো টেকসই হওয়ায় শ্রমিকদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হয়। অন্য আর একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, সানফ্রান্সিসকোতে লেভি স্ট্রস তাঁর কাপড়ের ব্যবসায় ব্যাপক উন্নতি করেন নিজের চেষ্টায়। তাঁর কাছ থেকে জ্যাকব ডেভিস কাপড় কিনতেন। ডেভিস শ্রমিকদের জন্য আগে থেকেই তামার পাতযুক্ত প্যান্ট তৈরি করতেন। এই প্যান্টের পেটেন্ট নেওয়ার জন্য তিনি আবেদন করলে তাঁর একজন অংশীদারের প্রয়োজন হয়। ডেভিসের মনে পড়ে লেভি স্ট্রসের কথা। তিনি তাঁকে চিঠি লিখে নিজের ব্যবসার অংশীদার হওয়ার কথা জানালে লেভি স্ট্রস দেরি করেননি। এরপর থেকে লেভি স্ট্রস ও জ্যাকব ডেভিস যৌথভাবে খনিশ্রমিকদের জন্য তামার পাত বা রিভেটযুক্ত মোটা কাপড়ের প্যান্ট তৈরির কাজ করতে থাকেন এবং বলাই বাহুল্য এই ব্যবসায় তাঁরা দুজনেই সফল হয়েছিলেন। এ ঘটনার পরেই আমরা পাই পৃথিবী বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানি’।
এরপর জিনসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রচুর বিখ্যাত ব্র্যান্ড পৃথিবীতে এখন জিনস তৈরি করে চলেছে। জিনস এখন শুধু প্যান্টেই সীমাবদ্ধ নেই। জিনস থেকে প্যান্ট তো তৈরি হয়ই, সেই সঙ্গে তৈরি হয় শার্ট, জ্যাকেট, কোটসহ অনেক কিছু। নাবিক, খনিশ্রমিক, আমেরিকান কাউবয়, পোলো খেলোয়াড়দের বৃত্ত ভেঙে ডেমিনে তৈরি জিনস এখন সারা পৃথিবীর সব মানুষের প্রিয়।
সময়ের হাত ধরে জিনসের রং এবং স্টাইলেও এসেছে দারুণ পরিবর্তন। বসেছে স্লিটিং, ফেডিং, লেজার এনগ্রেভিং ইত্যাদি ইফেক্ট। ঋতুভেদে বিভিন্ন রঙের জিনস পাওয়া যায়। যেমন, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, গ্রীষ্মের জন্য লাইট ব্লু, সি বা ওশেন ব্লু, ইলেকট্রিক ব্লু, হোয়াইট ও অ্যাশ গ্রে এই পাঁচ রঙের এবং শীতের জন্য ইনটেন্স ইন্ডিগো ও কালো এই দুই রঙের জিনসের প্রচলন রয়েছে বর্তমানে। এ ছাড়া নারী এবং পুরুষের পোশাকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ডেনিম ফেব্রিক রয়েছে। যেমন, পুরুষের জন্য রয়েছে এইটিজ হেভিওয়েট স্ট্রেচ, ওপেন অ্যান্ড এস্ট্রেচ ইত্যাদি। আবার নারীদের জন্য রয়েছে অথেনটিক স্ট্রেচ, কমার্শিয়াল স্ট্রেচ, ইন্ডিগো স্ট্রিপ ইত্যাদি। পুরুষদের জন্য যে স্টাইলগুলো জনপ্রিয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ফাইভ পকেট জিনস, বাইকার ডিটেইলিং জিনস, জগার জিনস।
আধুনিক ফ্যাশন জগতের একক অধিপতি বলা যায় ডেনিম জিনসকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী থেকে পুরুষ সবাই জিনস ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ, দীর্ঘ টেকসই, পরিষ্কার করার ঝামেলা কম ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মানুষ জিনস ব্যবহার করেন। যে কারণেই ব্যবহার করা হোক না কেন, জিনস তার জায়গা পাকা করে নিয়েছে ফ্যাশন–সচেতন কিংবা অসচেতন সব শ্রেণীর মানুষের কাছে। এ জন্যই সম্ভবত বলা হয়, ফ্যাশন ফেডস, বাট ডেনিম ইজ ইটারনাল।
তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা
নেভাদা স্টেট মিউজিয়াম নিউজ লেটার, আগস্ট ২০০৬।
হিস্ট্রি অব জিনস ডটকম, র্যাকেড ডটকম, হেডলস এবং ডেনিম বিশেষজ্ঞ মোস্তাফিজ উদ্দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন