এলসি অ্যাকাউন্ট জড়িত বিভিন্ন পার্টির পরিচয় ও এলসিতে তাদের ভূমিকা কী?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পেমেন্টের বিষয়াদি এলসির উপরে নির্ভরশীল হওয়ায় এলসি অ্যাকাউন্ট আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক- দুজনের কাছেই সমান গুরুত্ব রাখে। এলসির সাথে জড়িত থাকে বেশ কয়েকটি পক্ষ। কোন একটি পক্ষ এলসি তৈরির কাজে নিযুক্ত থাকে, কোন একটি পক্ষ নিযুক্ত থাকে এলসি তৈরি পরবর্তী কার্যক্রমে। এলসির শর্তাদি পূরণের ব্যবস্থাও করে অন্য পক্ষ। রপ্তানিকারকের পেমেন্ট যেমন এলসির উপরে নির্ভর করে, তেমনি আমদানিকারকের পণ্যও নির্ভর করে এলসির উপরে। তাই এলসি অ্যাকাউন্ট খোলা আগে এর সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষ সম্পর্কে আপনার জানা দরকার। চলুন তাহলে, এলসি অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত পার্টিদের নিয়ে জেনে নেওয়া যাক।
এলসি অ্যাকাউন্ট এর তিন রকম পক্ষ
১। কমার্শিয়াল পার্টি বা ব্যবসায়িক পক্ষ
আবেদনকারী (আমদানিকারক)
যে পক্ষ নিজ দেশের ব্যাংকের কাছে লেটার অব ক্রেডিটের আবেদন জমা দেন, তাকের আবেদনকারী বলা হয়। সাধারণত, পণ্যের বায়ার/ক্রেতা এলসি অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবেদন করেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ীই লেটার অব ক্রেডিট খোলা হয় এবং এলসির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তার অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যবর্তী পারচেজ অর্ডার এবং ব্যবসায়িক চুক্তির শর্তয়ানুসারে আবেদনকারী বায়ার নিজ ব্যাংকের সাথে লেটার অব ক্রেডিট খুলে থাকেন।
সুবিধাভোগী (রপ্তানিকারক)
লেটার অব ক্রেডিটের অন্য প্রধান গুরুত্বপূর্ণ পক্ষটি হলেন সুবিধাভোগী বা এক্সপোর্টার। এলসির শর্তানুসারে এই পক্ষ পেমেন্ট পেয়ে থাকেন। এলসিতে উল্লেখিত পণ্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন এই পক্ষ। রপ্তানিকারক বা সুবিধাভোগীর পক্ষেই এলসি করা হয়। এলসির শর্তানুসারে নিজস্ব অ্যাডভাইজারি ব্যাংকে সমস্ত ডকুমেন্ট প্রদানের মাধ্যমে পেমেন্ট পান এই পক্ষ।
২। ব্যাংকার
এলসি ইস্যুয়িং ব্যাংক বা প্রদানকারী ব্যাংক
আমদানিকারকের অনুরোধে তার নিজ দেশের কোন ব্যাংক এলসি প্রদান করতে সম্মত হয়ে থাকলে সেই ব্যাংককে ইস্যুয়িং ব্যাংক বলা হয়। ইস্যুয়িং ব্যাংকের মূল দায়িত্ব হলো এলসির শর্তাদি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সম্মত হওয়া এবং যথাযথ শর্ত মেনে এক্সপোর্টার ডকুমেন্টস জমা দিলে তাকে টাকা প্রদান করা। মূলত আমদানিকারক ব্যাংকের শর্ত মেনে এলসি অ্যাকাউন্ট খুললে তারপরই রপ্তানিকারক নিজস্ব পণ্য সরবরাহে বা রপ্তানি করতে সম্মত হন ও শুরু করেন। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইস্যুয়িং ব্যাংক অত্যন্ত বড় ভূমিকা পালন করে।
অ্যাডভাইজিং ব্যাংক
অ্যাডভাইজিং ব্যাংক মূলত রপ্তানিকারকের দিক থেকে কাজ করে। আমদানিকারকের পক্ষ থেকে ইস্যুয়িং ব্যাংক এলসি প্রদান করলে সেটি অ্যাডভাইজিং ব্যাংক গ্রহণ করে। অ্যাডভাইজিং ব্যাংক এবং ইস্যুয়িং ব্যাংকের মধ্যকার এই সম্পর্ক এজেন্সির মাধ্যমে তৈরি হয়। এই সম্পর্ককে বলা হয় করেসপন্ডেন্ট রিলেশনশিপ। অন্যথায় অ্যাডভাইজিং ব্যাংক ইস্যুয়িং ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে সম্মত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অ্যাডভাইজিং ব্যাংক ইস্যুয়িং ব্যাংকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। সাধারনত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্নও ব্যাংক ( SCB/HSBC/CITI NA/Marshaqe etc) অ্যাডভাইজ না করলে এক্সপোর্টের ব্যাংক এল সি নিয়ে কাজ করতে চায় না কারণ সেটা বেশ ধুঁকি পূর্ণ । রপ্তানিকারকদের অবশ্যই ভাল অ্যাডভাইজিং ব্যাংক ছাড়া নতুন বায়ারের সাথে এল সি খলার আগে সতর্ক হওা উচিত। কারণ এখানে একটা জিনিস মনে রাখা উচিত । বায়ার এবং তার ব্যাংক দুই পক্ষই বিদেশে থাকে।
কনফার্মিং ব্যাংক
ইস্যুয়িং ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদানকৃত অ্যাডভাইজিং ব্যাংকের পেমেন্ট সংক্রান্ত নিশ্চয়তার পরেও তৃতীয় ব্যাংকের সাহায্য নেন অনেকে। এক্ষেত্রে যে ব্যাংকটি রপ্তানিকারককে পেমেন্ট প্রদান করার বাড়তি নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে, তাকে কনফার্মিং ব্যাংক বলা হয়।
নমিনেটেড ব্যাংক
রপ্তানিকারকের কর্তৃক ডকুমেন্টস জমাদানের ক্ষেত্রে ইস্যুয়িং ব্যাংক রপ্তানিকারকের যে ব্যাংকের নাম এলসিতে উল্লেখ করেন, সেটিকে নমিনেটেড ব্যাংক বলা হয়।
নেগোশিয়েটিং ব্যাংক
বায়ারের ইস্যুয়িং ব্যাংক রপ্তানিকারকের দেশের অন্য একটি ব্যাংককে বেছে নিতে পারেন। এলসির মাধ্যমে পাওয়া পেমেন্ট সংগ্রহ করতে সেই ব্যাংকে রপ্তানিকারককে তার ডকুমেন্টস প্রদান করতে হতে পারে। এই ব্যাংকটিকে নেগোশিয়েটিং ব্যাংক বলা হয়। ডকুমেন্টারি ক্রেডিটের উপরে ভিত্তি করে ইস্যুয়িং ব্যাংক, অ্যাডভাইজিং ব্যাংক বা অন্য যেকোনো ব্যাংক ফ্রি নেগোশিয়েবল ক্রেডিটের মাধ্যমে নেগোশিয়েটিং ব্যাংকের কাজ করতে পারে।
রিইম্বারসিং বা পরিশোধের ব্যাংক
ইস্যুয়িং ব্যাংক নেগোশিয়েটিং ব্যাংকের মাধ্যমে এলসির শর্তানুযায়ী রপ্তানিকারককে অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। এর সেক্ষেত্রে এই অর্থ প্রদানের কাজটি করার জন্য অন্য যে ব্যাংকটিকে বেছে নেওয়া হয়, সেটিকে রিইম্বার্সিং ব্যাংক বলে। এক্ষেত্রে ইস্যুয়িং ব্যাংক নস্ত্রো এ/সি ডেবিট দ্বারা পরিচালিত হয়।
ট্রান্সফারিং ব্যাংক
এলসি-তে ট্রান্সফারেবল কথাটি উল্লেখ করা হলে সেই এলসিকে ট্রান্সফার এলসি বলা হয়। অর্থের প্রাথমিক সুবিধাভোগীকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে যে ব্যাংককে ব্যবহার করা হয়, সেটিকে ট্রান্সফারিং ব্যাংক বলে।
৩। অন্যান্য পক্ষ
ইনস্যুরেন্স বা বীমা কোম্পানি
অর্থের নিরাপত্তার পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের জন্য বিমা কোম্পানি থেকে ইনস্যুরেন্স পলিসিও তৈরি করা হয়। সেক্ষেত্রে পরিবহনের সময় পণ্যের কোন ক্ষতি হলে কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বাধ্য থাকে।
ক্যারিয়ার বা বাহক (ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি)
রপ্তানি পণ্য সমুদ্র, ট্রেন, ট্রাক, আকাশপথ ইত্যাদিতে যাতায়াত করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যারিয়ার বলা হয়। পরিবহন প্রতিষ্ঠানের মূল কাজটিই হলো পণ্যকে নির্দিষ্ট শিপমেন্ট পয়েন্টে পৌঁছে দেওয়া। শিপ ডকুমেন্টের ভেতরে ট্রান্সপোর্ট ডকুমেন্টকেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়।
একটি পণ্য রপ্তানি হওয়ার সময় এই সাথে জড়িত থাকে অনেকগুলো পক্ষ। এদের প্রত্যেকের কাজগুলোই ছোট কিংবা বড় হলেও, সব মিলিয়ে তাদের প্রত্যেকটি কাজই রপ্তানি বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জড়ানোর আগে এলসি অ্যাকাউন্টের সাথে সম্পৃক্ত এই প্রতিটি পার্টি বা পক্ষ সম্পর্কে জেনে নেওয়া আবশ্যক। এতে করে বাণিজ্য কাজ যেমন সহজ হবে, তেমনি সফলতাও আসবে দ্রুত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন