আধুনিক শাড়ি পরার ধরন প্রচলনকারী যশোরের জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর
আজকের দিনে নারীরা যেভাবে শাড়ি পরে, সেটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বধু জ্ঞানদানন্দিনীর কাছ থেকে এসেছে। তিনি ১৯ শতকের একজন সমাজ সংস্কারক। তিনি বাংলার নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য নেতৃত্ব দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, এই জ্ঞানদানন্দিনী আমাদের যশোরের মেয়ে। তিনি যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে ১৮৫০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন । তার বাবা অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় এবং মা নিস্তারিনী দেবী। তার বাবা তাকে সেকালের রীতি অনুসারেই, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ১৮৫৭ সালে বিয়ে দেন। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি লেখক, ও ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজো ভাই ও ব্রিটিশ ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনের নায়কও ছিলেন তিনি।
জ্ঞানদানন্দিনী যশোরের শান্তু ও মনোরোম পরিবেশকে ছেড়ে গেলেন কলকাতার সবচাইতে বনেদি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে, সে এক বিশাল পরিবার। নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন নতুনভাবে। ১৮৬২ সালে স্বামী যখন ট্রেনিংয়ের জন্য বিলাত গেলেন, তখন তিনি স্বামীর সাথে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে বিলাত যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাধঁ সাধলো শশুর। শশুর দেবেন্দ্রনাথের বিরোধিতার কারণে স্বামীর সাথে তার আর ইংল্যান্ডে যাওয়া হলো না। কিন্তু তিনি বসে থাকেননি। দেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তিনি লেখাপড়া শেখেন। এরপর স্বামী ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসেন এবং চাকুরিসূত্রে বোম্বেতে বসবাস শুরু করলে; জ্ঞানদানন্দিনী তার কাছে বোম্বেতে চলে যান। বোম্বেতে গিয়ে তিনি এবার ইউরোপীয়দের ইংরেজি আদব-কায়দা শেখেন। সামাজিক অবস্থানের এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় শাড়ী-কাপড় পরার বিষয়। কারণ বাঙ্গালী কায়দায় শাড়ি পরার প্রচলিত রীতি যা ছিল তা অনেকটাই অন্যরকম। তার সময়ে ভারতীয় নারীরা পেটিকোট ছাড়া যেভাবে শাড়ী পরত তা খুবই বেমানান ও দৃষ্টিকটু ছিল। তিনি তখন শাড়ীর সাথে পেটিকোট ও ব্লাউজ ব্যবহার করেন এবং নতুনভাবে শাড়ি পরার স্টাইল তৈরি করেন। এই কারণে তাকে ভারতীয় বাঙালী সমাজে পোষাকের ফ্যাশন ট্রেন্ডসেটার বলে। আজকে আমাদের নারীরা যেভাবে শাড়ি পরে সেটা তার কাছ থেকেই এসেছে। বর্তমান যুগেও দক্ষিণ এশিয়া ও বাঙালি রমণীর প্রথম পছন্দ শাড়ি।
তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে যেসব বিদ্যা-জ্ঞান লাভ করেন; তা সমাজকে শেখাতে নিজে আগে ব্যবহার করতেন। স্বামীর সাথে গুজরাটে বেড়াতে গিয়ে পারসি নারীদের শাড়ি পরার ধরন শিখে, তিনি নিজের মতো করে নতুনভাবে নিজস্ব একটা স্টাইল চালু করলেন। যেমন- তিনিই প্রথম শাড়ির আঁচল বাম দিক দিয়ে পরার ধরন চালু করেন,যেটা ছিল পারসি স্টাইলের বিপরীত। সুতরাং বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনিই শুরু করেন। এমনকি তিনি তার মতো করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে ‘বামাবোধিনি পত্রিকাতে’ বিজ্ঞাপনও করেছেন । কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের নারীদের মধ্যে তা দ্রুত ছড়িয়ে পরে ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এজন্য এই স্টাইলকে ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’ নামে ডাকা হতো।
জ্ঞানদানন্দিনীর জীবনী থেকে আরো জানা যায় যে, ভাইসরয় লর্ড লরেন্স ১৮৬৬ সালে ভোজসভায় তাদের দাওয়াত দেন। সকল প্রথা-রীতিনীতি ভেঙ্গে তিনি সেসময় স্বামীর সাথে ঐ ভোজসভায় যোগ দিয়েছিলেন। সেসময় এরকম রীতি ছিল না। এটাকে তার পরিবারের কেউই ভালো চোখে দেখিনি। ফলে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে একধরনের মতভেদ দেখা যায় বলে শোনা যায়। এভাবে একটু একটু করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনা মানুষকে উৎসাহিত করে আটপৌড়ে জীবন থেকে বের হয়ে বাইরের বিশাল জগত দেখার।
আমরা তার কাছ থেকে একক পরিবারের ধারনাও পাই। যৌথ পরিবার থেকে বের হয়ে জ্ঞানদান্দিনী নিজের মত করে থাকতে ১৮৬৮ সালে জোড়াসাঁকো ছেড়ে কাছেই পার্ক স্ট্রিটে চলে যান। যা ছিল সেসময় নতুন। কিন্তু দেবরগুলোকে মানুষ করতে সর্বদা তার ছিল কড়া নজর। একবার জোড় করেই রবীন্দ্রনাথকে নতুন নতুন ধরনের জামা-কাপড় পরা শিখিয়েছিলেন। ছোট দেবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার ছিল স্নেহের সম্পর্ক। পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়মিতভাবেই রবীন্দ্রনাথ আসতেন।
তিনি ছিলেন বিপ্লবী ও সমাজবাদী। নিজের সন্তানগুলোকে সুশিক্ষিত করতে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেন। মেয়ে ইন্দিরাকে মুসলিম হাউজ টিউটরের কাছে পড়তে দিয়ে বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি তার স্বাধীনচেতা মনোভাবকে তুলে ধরেন। কলকাতায় জ্ঞানদানন্দিনী উচ্চবর্ণের পরিবারের বহু পুরানো রীতিনীতি ভাঙলেন; যা ছিল নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ।
জ্ঞানদানন্দিনী তার স্বামীর সাথে বোম্বে, পুনা, বিজাপুরসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। ১৮৭৭ সালে গর্ভবতী অবস্থায় তিনি ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেই সময় কোন ভারতীয় নারীর সাগর পাড়ি দেয়ার কথা শোনা যেতনা, তার উপর আাবার সঙ্গে স্বামীও ছিলেন না। তার এই সাহসিকতাটি সেই সময় আবারো সামাজিকভাবে বিরাট আলোড়ন তৈরি করে। স্বামীর কাকা জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাকে লন্ডনে স্বাগত জানান। কিংসটন গার্ডেনসে তার বাড়িতে কিছুদিন থাকার পরে তিনি ব্রাইটনে অন্য বাড়িতে চলে যান। পরে স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ লন্ডন গিয়ে তাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ১৯৪১ সালে তিনি মারা যান । আমাদের বাংলাদেশের গৌরব জ্ঞানদানন্দিনীকে আমরা ভুলে গেছি; কিন্তু ইতিহাস তাকে ঠিকই মনে রেখেছে।
সরলা দেবী চৌধুরানী তার ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইতে লিখেছেন, জ্ঞানদানন্দিনী আমাদেরকে জন্মদিন নামক নতুন একটা অনুষ্ঠানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি ছিলেন আমার মামী। যখন জ্ঞানদা বিলাত থেকে ফিরে আসেন, তথন তিনি সাথে করে নতুন একটি অনুষ্ঠান নিয়ে আসেন। সেটি হল “জন্মদিন”। আমরা কেউই এই ধরনের অদ্ভুত অনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত ছিলাম না। এমনকি আমরা কে, কবে জন্ম নিয়েছি সেটাই তো জানতাম না। সুরেনের জন্মদিনের উৎসব থেকে ফেরার সময় জোড়াসাঁকোর ছেলে-মেয়েদের মাঝে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো স্মরণ করতে পারি। এই উৎসব সকলকেই আন্দোলিত করে। শুধু তাই না শিশুরা তাদের জন্ম কবে হয়েছিল তার খোঁজ নিতে শুরু করলো। আমাদের জোড়াসাঁকোর পরিবার শুধু নয়, দ্রুত এই ধারনা ব্রাহ্ম সমাজও গ্রহণ করেছিল এবং তা কলকাতা ছাড়িয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পরে। শুরু হয় উৎসবের এক নতুন রূপ। আমরা তার কাছে অনেকভাবে ঋণী। এসবের জন্য জ্ঞানদানন্দিনীকে আমাদের ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন রয়েছে। তার এই বিপ্লবী, স্বাধীনচেতা মনোভাবই তাকে ঠাকুর পরিবারে একটা বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন