মানুষ মাত্রই জ্ঞানপিপাষু প্রাণী। যুগ যুগ ধরে মানুষ জ্ঞান আহরণের জন্য দিক- বিদিক ছুটে চলেছে। মহাসাগর থেকে মরুভূমি পর্যন্ত সকল জায়গাতেই রয়েছে মানুষের পদচিহ্ন। মার্কো পোলো যেমন বিশ্বভ্রমণ করেছেন তেমনি কলম্বাস করেছেন আমেরিকা আবিষ্কার। অর্থাৎ মানুষের জীবনে ভ্রমণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ফেলেছে তেমনি তৈরি করেছে বিভিন্ন ঝামেলার। ভ্রমণের ক্ষেত্রে অন্যতম ঝামেলা ছিলো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বহন করা নিয়ে। যা নিয়ে হয়তো কেউই আগে চিন্তা করেনি। তবে একজন মানুষ এধরনের অভিনব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা কিরেছিলেন। তিনি হলেন লুই ভ্যিতন।
১৮২১ সালে ফ্রান্সে পর্বতের কোলঁঘেষা একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহন করেন লুই ভ্যিতন। খুবই নিম্ন- মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে তিনিই একসময় হয়ে ওঠেন ফ্রান্সের উচ্চবিত্তদের মধ্যমণি। প্রায় ১৩ বছর বয়সে সৎ মায়ের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসেন লুই ভ্যিতন এবং গড়ে তোলেন বিশাল ফ্যাশনের সাম্রাজ্য। ১৮৫২ সালে যখন নেপলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের সম্রাট হয়েছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী লুই ভ্যিতনকে তাঁর নিজস্ব কারিগর হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। লুই ভ্যিতনের প্রধান দায়িত্ব ছিল রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য ট্রাঙ্ক ও বাক্স তৈরি করা। ফলে তখন থেকেই লুই ভ্যিতন সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষদের সাথে মেলামেশা শুরু করেন এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী ট্রাঙ্ক ও বাক্স তৈরি করা শুরু করেন। ফলে ফ্রান্সের বাজারে লুই ভ্যিতনের চাহিদা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। এখান থেকেই লুই ভ্যিতন তার ব্র্যান্ড শুরু করার কথা চিন্তা করেন।
১৮৫৪ সালে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম লুই ভ্যিতন একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে নিজের পথচলা শুরু করে। তবে লুই ভ্যিতন ফ্যাশন নিয়ে কাজ শুরু করার আগে একটি অভিনব ব্যাপার নিয়ে কাজ করেন। তৎকালীন সময়ে ভ্রমনের ক্ষেত্রে মানুষ যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুভব করে তা হলো নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস বহন করার জন্য ব্যবহৃত স্যুটকেস ও ট্রাঙ্ক সাজিয়ে রাখা । তাই ১৮৫৮ সালে লুই ভ্যিতন সর্বপ্রথম একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের স্যুটকেস তৈরি করেন। এতে তিনি চামড়ার বদলে ধূসর রঙের ক্যানভাস ব্যবহার করেন এবং আয়তাকার সমতল আকৃতির ট্রাঙ্ক বাজারজাত করেন। ফলে এধরনের ট্রাঙ্ক পরিবহনখাতে ও ব্যবসায়িক খাতে বিশাল পরিবর্তন আনে। কারণ এটি ছিল ওজনে হালকা এবং আকৃতির কারণে সহজে সাজিয়ে রাখা যেত।
তাইতো বলা হয়ে থাকে লুই ভ্যিতন ছিলেন আধুনিক সময়ের লাগেজের জনক। এরপর থেকে লুই ভ্যিতনকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে লুই ভ্যিতনের চাহিদা ফ্রান্সের গন্ডি পেরিয়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের কারণে লুই ভ্যিতনকে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লুই ভ্যিতনকে হারাতে হয় তার ট্রাঙ্ক তৈরির কারখানা, সরঞ্জাম ও শ্রমিকদের। ফলে লুই ভ্যিতনের ব্যবসায় নেমে আসে ধস।
তবে মাত্র একমাসের মাথায় লুই ভ্যিতন ফ্রান্সে পুণরায় তার ব্যবসা শুরু করেন এবং এবার তিনি বাজারজাত করেন বেজ (beige) ও লাল রঙের স্ট্রাইপের নতুন ট্রাঙ্ক যা আবার বিশ্ববাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর লুই ভ্যিতনের পথচলা কেউ থামাতে পারেনি। তবে প্রায়ই তার ডিজাইন চুরির হওয়ার ঝামেলা এড়াতে ১৮৯৬ সালে লুই ভ্যিতন সর্বপ্রথম LV মনোগ্রাম পেটেন্টসহ বাজারে আনেন। তবে প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময় লুই ভ্যিতনের বিরুদ্ধে নাজি সৈন্যদের সাহায্য করার অভিযোগ উঠে আসে। ফলে আবারও লুই ভ্যিতনকে বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
তবে ১৯৫৪ সালে লুই ভ্যিতন ফের তাদের নতুন লেদার কালেকশান দিয়ে ফ্যাশন দুনিয়াকে তাক লাগায়।
তারা সর্বপ্রথম তাদের স্পিডি হ্যান্ডব্যাগ ও নেভারফুল হ্যান্ডব্যাগ কালেকশান ফ্যাশন জগতে পরিচয় করিয়ে দেন। ধীরে ধীরে তারা পোশাকে মনোনিবেশ করেন এবং পিওর লেদার জ্যাকেট-প্যান্ট ইত্যাদি বাজারজাত শুরু করেন। খুব অল্পদিনেই পোশাকখাতেও লুই ভ্যিতন সাড়া ফেলে দেয়।
অল্পদিনের মাঝেই তারা মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনার মতো তারকাদের নিজেদের ক্লায়েন্টদের তালিকায় নিয়ে আসেন। লুই ভ্যিতনের তৈরি জুতো, র্যাম্পার, ট্র্যাকস্যুট এখনো বিশ্ব-তারকাদের পছন্দের এক নম্বর তালিকায় রয়েছে। পৃথিবীতে লুই ভ্যিতনের এখন প্রায় ১৫০টির মতো স্টোর রয়েছে।
২০১১ সালে একটি সমীক্ষা অনুযায়ী লুই ভ্যিতন ব্র্যান্ডটির মোট মূল্য প্রায় ২৪.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।প্রায় ছয় বছর ধরে ব্র্যান্ডটি এখনো বিশ্বের মূল্যবান ব্র্যান্ডের তালিকায় নিজের নাম শীর্ষে ধরে রেখেছে।বলা হয়ে থাকে তাদের একটি সিগনেচার ট্রাঙ্ক তৈরি করতে প্রায় ৬০ ঘন্টা সময় লাগে। এই ট্রাঙ্ক তৈরির প্রধান উপকরন হচ্ছে ৩০ বছর বয়সী "পপলার" গাছ। প্রতিটি ট্রাঙ্কের একটি করে সিরিয়াল নাম্বার রয়েছে ফলে লুই ভ্যিতন ব্র্যান্ডের কাছে তাদের বিক্রিত প্রতিটি ট্রাঙ্কের তালিকা রয়েছে।
প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে লুই ভ্যিতন ব্র্যান্ডকে কাউন্টারফেট্টি অর্থাৎ নকল জিনিসের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। ২০০৭ সালে আমেরিকান গায়িকা "ব্রিটনি স্পিয়ার্স"- এর বিরুদ্ধে লুই ভ্যিতন কাউন্টারফেট্টির অভিযোগ আনেন। তারঁ বিরুদ্ধে অভিযোগ করার হয় যে তিনি তার নতুন গানের ভিডিও তে লুই ভ্যিতনের "চেরি ব্লোসোম" কালেকশানকে ব্যবহার করেন ব্র্যান্ডটির অনুমতি না নিয়েই। এছাড়াও হংকং এবং চায়নাতে বেশ কিছু কোম্পানীর বিরুদ্ধে লুই ভ্যিতন কাউন্টারফেট্টির অভিযোগ আনেন।
ফ্যাশন জগতে লুই ভ্যিতন এক অনবদ্য নাম। যুগে যুগে লুই ভ্যিতনের হাত ধরে বদলে চলেছে মানুষের নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি পদক্ষেপেই বেড়ে চলেছে লুই ভ্যিতনের (Louis Vuitton) আবেদন।
Organisation : Louis Vuitton
Type : Division
Industry : Fashion
Founded : 1854; 166 years ago
Founder : Louis Vuitton
Headquarters : Paris, France
Key people:
Michael Burke (Chairman & CEO)
Nicolas Ghesquière, Virgil Abloh
(Creative Directors)
Products : Luxury goods
Revenue : US$9.9 billion (2017)
Number of employees : 121,289 (2014)
Parent : LVMH
Website : www.louisvuitton.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন