বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা এখন ১০৮ | Green Textile Projectof Bangladesh - Textile Lab | Textile Learning Blog
সবুজের সেঞ্চুরি

দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানা ও ভবনের সংখ্যা এখন ১০৮। তার মধ্যে পোশাক ও বস্ত্র খাতেই ৯৫টি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। তার মধ্যে সেরা ১০–এর ৬টিই বাংলাদেশের। 
ক্রিকেটার সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা এখন অহরহই সেঞ্চুরি করেন। অভিনন্দন পান। তাঁদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয় দেশের মানুষ। এবার দেশের উদ্যোক্তারাও অন্য রকম এক সেঞ্চুরি করে ফেললেন। বিভিন্ন এলাকায় এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন তাঁরা। এটির সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি ও দেশের সাধারণ মানুষ। 



পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে তিনি স্থাপন করেন ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। তাঁর দেখানো পথ ধরে ৯৪টি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে। পিছিয়ে নেই অন্যরাও। শিপইয়ার্ড, জুতা, ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে। তবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্রকল রয়েছে। 

দেশে এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা হলেও সেগুলো কিন্তু যেনতেন মানের না। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বে জিনস বা ডেনিম কাপড় উৎপাদন করার প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় এনভয় টেক্সটাইল। নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে রেমি হোল্ডিংস, সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা। আবার নারায়ণগঞ্জের উত্তর নরসিংহপুরের প্লামি ফ্যাশনস, নিট পোশাক তৈরি করা বিশ্বের প্রথম ও শীর্ষ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা।

সারা বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়। 

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৭ দেশে লিড সনদ পাওয়া স্থাপনার সংখ্যা ৯২ হাজারের বেশি। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে।

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলোর একটি ছাড়া সবগুলো ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০৭টি স্থাপনা লিড সনদ পেয়েছে। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ২৮টি, গোল্ড ৬৬টি, সিলভার ১১টি এবং ২টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। ১০৭টি পরিবেশবান্ধব স্থাপনার মধ্যে ৯৫টিই পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা। বর্তমানে ৫০০-এর বেশি প্রকল্প পরিবেশবান্ধব হতে ইউএসজিবিসির অধীনে কাজ চলছে। তা ছাড়া দেশের একমাত্র পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙার ইয়ার্ড পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পিএইচপি গ্রুপের এই ইয়ার্ড ২০১৭ সালে হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব শিপ ইয়ার্ডের মর্যাদা পায়।

সাধারণত অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ৫-২০ শতাংশ খরচ বেশি হয়। তবে বাড়তি খরচ করলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়। ইউএসজিবিসি লিড সনদ পেতে স্থাপনা নির্মাণে ৯টি শর্ত পরিপালন করতে হয়। তার মধ্যে আছে এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হয়, যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। এ জন্য পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি ইট, সিমেন্ট ও ইস্পাত লাগে। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে সূর্যের আলো, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি পানি সাশ্রয়ী কল ও ব্যবহৃত পানি প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করতে হয়। এ ছাড়া স্থাপনায় পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ২৪-৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৩৩-৩৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ এবং ৪০ শতাংশ পানি ব্যবহার কমানো সম্ভব। তার মানে দেশে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই তা পরিবেশের ওপর চাপ কমাবে। 

পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় অর্থনীতি, পরিবেশ ও মানুষ উপকৃত হয়, এমনটাই বললেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ৩৬০ ডিগ্রি টোটাল সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনন্ত আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও পানির খরচ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমানো যায়। তাতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় সাশ্রয় হয়। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব কারখানায় উন্নত কর্মপরিবেশের কারণে কর্মীদের উৎপাদনশীলতাও বাড়ে। 


শুরুর গল্প 

আগেই বলা হয়েছে, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও দিয়ে দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয়। তবে গত সাত বছরে শতাধিক পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে সাভারের রানা প্লাজা ধস। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন ওঠে। তখন বিদেশি ক্রেতাদের চাপে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে লেগে পড়েন উদ্যোক্তারা। তাঁরা কারখানার বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধন করার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব নতুন কারখানা নির্মাণ শুরু করেন। কেউ কেউ আবার পুরোনো কারখানাকেই পরিবেশবান্ধব করার উদ্যোগ নেন। 

চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনসের কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার মান উন্নয়নের তাগিদ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা পুরোনো কারখানাকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলেছি। অনেক উদ্যোক্তাই সেই কাজটি করেছেন। সে জন্যই বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশের কারখানা এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’ 



 প্লামি ও শুনিভার্সের গল্প 

ফটক দিয়ে ঢুকতেই সারি সারি গাছ। বেশ খানিকটা এগোনোর পর ছিমছাম কারখানা ভবন। চট করে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেন না যে ভেতরে দেড় হাজার নারী-পুরুষ বিদেশি নামীদামি ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করছেন। খোলামেলা পরিবেশ। চারপাশে প্রচুর গাছপালা। আলাদা ভবনে রয়েছে শিশু দিবাযত্ন ও চিকিৎসাকেন্দ্র এবং বিশাল খাবার কক্ষ।



নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে প্লামি ফ্যাশনসের চিত্র এটি। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বুধবার কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেল, গত চার বছরেও প্লামি এতটুকু রং হারায়নি। 

২১ বিঘা জমির ৬২ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রেখে প্লামির মূল কারখানাটি করা হয়েছে। দুই তলাবিশিষ্ট কারখানার চারপাশে স্বচ্ছ কাচের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো ভেতরে আসে। সে জন্য বৈদ্যুতিক বাতির প্রয়োজন কম হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ভূগর্ভে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক জলাধার। সেই পানি ব্যবহারের পাশাপাশি বাথরুমে পানিসাশ্রয়ী কল লাগানো হয়েছে। এসব কারণে কারখানাটিতে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার ৪০ শতাংশ কম হয়।



জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুনাফার জন্য আমরা ব্যবসা করি। তবে আত্মতৃপ্তি ও দায়িত্ববোধের একটি বিষয় তো আছেই। দেশ ও শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই পরিবেশবান্ধব কারখানা করেছি। সে জন্য আমরা বেশ খুশি।’ 

অন্যদিকে দেশের একমাত্র পরিবেশবান্ধব জুতার কারখানা ময়মনসিংহের ভালুকার শুনিভার্স ফুটওয়্যার। কারখানাটিতে দিনে গড়ে সাড়ে চার হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হয়, যার পুরোটাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। 






আমাদের ভালুকা প্রতিনিধি জানান, মূল ফটকের দিয়ে কয়েক কদম প্রশাসনিক ভবন। তার বাঁ দিকে কারখানা ভবন। ভেতরের পরিবেশটা সাজানো–গোছানো। ভবনের নকশাটি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে করে সূর্যের আলোতে কাজ করতে পারেন শ্রমিকেরা। বৃষ্টির পানি ধরে তা পরিশোধন করে ব্যবহার করা হয়। শ্রমিকদের খাবারের জন্য আছে আলাদা জায়গা। প্রতিটি ভবনের আশপাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। 

শুনিভার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকের পরই সম্ভাবনাময় খাত চামড়া। তা ছাড়া পোশাকশিল্পের কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো অবধারিতভাবেই চামড়া খাতে চলে আসবে। সেটি উপলব্ধি করতে পেরেই আমরা পরিবেশবান্ধব কারখানা করেছি।





 সর্বোচ্চ সনদ যাদের

পোশাক ও বস্ত্র খাতের লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ২৪। সেগুলো হচ্ছে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, জেনেসিস ওয়াশিং ও জেনেসিস ফ্যাশনস, কলাম্বিয়া ওয়াশিং প্ল্যান্ট, ইউএইচএম লিমিটেড, প্লামি ফ্যাশনস, বিটপী গ্রুপের রেমি হোল্ডিংস ও তারাসিমা অ্যাপারেল, ডিজাইনার ফ্যাশনস, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, কানিজ ফ্যাশনস, এসকিউ কোলব্লেনস, এসকিউ সেলসিয়াস ২, এসকিউ বিরিকিনা, এসকিউ সেন্ট্রাল, ইকোটেক্স, এআর জিনস, গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের ইউনিট ৩, পাইওনিয়ার ডেনিম, কেনপার্ক ২ এবং দ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ওভেন অ্যান্ড ইউনিট ২। পোশাক ও বস্ত্র খাতের বাইরে ৪টি লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে এএসজি ফ্যান ফ্যাক্টরি, বিআইএফএফএল, সিটিস্কেপ ও সায়হাম টাওয়ার। 




পোশাকের গ্রিন ব্র্যান্ডিং 

পোশাক ও বস্ত্র খাতে ৯৫টি পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে। অর্জনটিকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে পারলে পোশাকের বাড়তি দাম পাওয়া সম্ভব। তবে সেই কাজটি সঠিকভাবে শুরু করা যায়নি বলে পরিবেশবান্ধব কারখানার উদ্যোক্তারা আক্ষেপ করলেন। 

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব কারখানা পোশাকশিল্পের জন্য বড় শক্তি। আমাদের শিল্পকে নিরাপদ ও টেকসই করতে সহায়তা করছে কারখানাগুলো। এটিকে কাজ লাগাতে আমরা কাজ শুরু করেছি। ইউএসজিবিসির সঙ্গে আমরা শিগগিরই একটি সমঝোতা স্মারক সই করব। তারা আমাদের পরিবেশবান্ধব কারখানার প্রচার-প্রচারণা চালাবে। তা ছাড়া আমরা নিজেরাও ব্র্যান্ডিংয়ে নামব।’




শুভংকর কর্মকার
প্রথম আলো 
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা এখন ১০৮ | Green Textile Projectof Bangladesh

সবুজের সেঞ্চুরি

দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানা ও ভবনের সংখ্যা এখন ১০৮। তার মধ্যে পোশাক ও বস্ত্র খাতেই ৯৫টি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। তার মধ্যে সেরা ১০–এর ৬টিই বাংলাদেশের। 
ক্রিকেটার সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা এখন অহরহই সেঞ্চুরি করেন। অভিনন্দন পান। তাঁদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয় দেশের মানুষ। এবার দেশের উদ্যোক্তারাও অন্য রকম এক সেঞ্চুরি করে ফেললেন। বিভিন্ন এলাকায় এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন তাঁরা। এটির সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি ও দেশের সাধারণ মানুষ। 



পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে তিনি স্থাপন করেন ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। তাঁর দেখানো পথ ধরে ৯৪টি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে। পিছিয়ে নেই অন্যরাও। শিপইয়ার্ড, জুতা, ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে। তবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্রকল রয়েছে। 

দেশে এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা হলেও সেগুলো কিন্তু যেনতেন মানের না। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বে জিনস বা ডেনিম কাপড় উৎপাদন করার প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় এনভয় টেক্সটাইল। নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে রেমি হোল্ডিংস, সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা। আবার নারায়ণগঞ্জের উত্তর নরসিংহপুরের প্লামি ফ্যাশনস, নিট পোশাক তৈরি করা বিশ্বের প্রথম ও শীর্ষ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা।

সারা বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়। 

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৭ দেশে লিড সনদ পাওয়া স্থাপনার সংখ্যা ৯২ হাজারের বেশি। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে।

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলোর একটি ছাড়া সবগুলো ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০৭টি স্থাপনা লিড সনদ পেয়েছে। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ২৮টি, গোল্ড ৬৬টি, সিলভার ১১টি এবং ২টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। ১০৭টি পরিবেশবান্ধব স্থাপনার মধ্যে ৯৫টিই পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা। বর্তমানে ৫০০-এর বেশি প্রকল্প পরিবেশবান্ধব হতে ইউএসজিবিসির অধীনে কাজ চলছে। তা ছাড়া দেশের একমাত্র পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙার ইয়ার্ড পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পিএইচপি গ্রুপের এই ইয়ার্ড ২০১৭ সালে হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব শিপ ইয়ার্ডের মর্যাদা পায়।

সাধারণত অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ৫-২০ শতাংশ খরচ বেশি হয়। তবে বাড়তি খরচ করলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়। ইউএসজিবিসি লিড সনদ পেতে স্থাপনা নির্মাণে ৯টি শর্ত পরিপালন করতে হয়। তার মধ্যে আছে এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হয়, যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। এ জন্য পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি ইট, সিমেন্ট ও ইস্পাত লাগে। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে সূর্যের আলো, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি পানি সাশ্রয়ী কল ও ব্যবহৃত পানি প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করতে হয়। এ ছাড়া স্থাপনায় পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ২৪-৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৩৩-৩৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ এবং ৪০ শতাংশ পানি ব্যবহার কমানো সম্ভব। তার মানে দেশে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই তা পরিবেশের ওপর চাপ কমাবে। 

পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় অর্থনীতি, পরিবেশ ও মানুষ উপকৃত হয়, এমনটাই বললেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ৩৬০ ডিগ্রি টোটাল সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনন্ত আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও পানির খরচ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমানো যায়। তাতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় সাশ্রয় হয়। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব কারখানায় উন্নত কর্মপরিবেশের কারণে কর্মীদের উৎপাদনশীলতাও বাড়ে। 


শুরুর গল্প 

আগেই বলা হয়েছে, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও দিয়ে দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয়। তবে গত সাত বছরে শতাধিক পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে সাভারের রানা প্লাজা ধস। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন ওঠে। তখন বিদেশি ক্রেতাদের চাপে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে লেগে পড়েন উদ্যোক্তারা। তাঁরা কারখানার বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধন করার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব নতুন কারখানা নির্মাণ শুরু করেন। কেউ কেউ আবার পুরোনো কারখানাকেই পরিবেশবান্ধব করার উদ্যোগ নেন। 

চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনসের কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার মান উন্নয়নের তাগিদ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা পুরোনো কারখানাকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলেছি। অনেক উদ্যোক্তাই সেই কাজটি করেছেন। সে জন্যই বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশের কারখানা এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’ 



 প্লামি ও শুনিভার্সের গল্প 

ফটক দিয়ে ঢুকতেই সারি সারি গাছ। বেশ খানিকটা এগোনোর পর ছিমছাম কারখানা ভবন। চট করে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেন না যে ভেতরে দেড় হাজার নারী-পুরুষ বিদেশি নামীদামি ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করছেন। খোলামেলা পরিবেশ। চারপাশে প্রচুর গাছপালা। আলাদা ভবনে রয়েছে শিশু দিবাযত্ন ও চিকিৎসাকেন্দ্র এবং বিশাল খাবার কক্ষ।



নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে প্লামি ফ্যাশনসের চিত্র এটি। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বুধবার কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেল, গত চার বছরেও প্লামি এতটুকু রং হারায়নি। 

২১ বিঘা জমির ৬২ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রেখে প্লামির মূল কারখানাটি করা হয়েছে। দুই তলাবিশিষ্ট কারখানার চারপাশে স্বচ্ছ কাচের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো ভেতরে আসে। সে জন্য বৈদ্যুতিক বাতির প্রয়োজন কম হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ভূগর্ভে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক জলাধার। সেই পানি ব্যবহারের পাশাপাশি বাথরুমে পানিসাশ্রয়ী কল লাগানো হয়েছে। এসব কারণে কারখানাটিতে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার ৪০ শতাংশ কম হয়।



জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুনাফার জন্য আমরা ব্যবসা করি। তবে আত্মতৃপ্তি ও দায়িত্ববোধের একটি বিষয় তো আছেই। দেশ ও শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই পরিবেশবান্ধব কারখানা করেছি। সে জন্য আমরা বেশ খুশি।’ 

অন্যদিকে দেশের একমাত্র পরিবেশবান্ধব জুতার কারখানা ময়মনসিংহের ভালুকার শুনিভার্স ফুটওয়্যার। কারখানাটিতে দিনে গড়ে সাড়ে চার হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হয়, যার পুরোটাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। 






আমাদের ভালুকা প্রতিনিধি জানান, মূল ফটকের দিয়ে কয়েক কদম প্রশাসনিক ভবন। তার বাঁ দিকে কারখানা ভবন। ভেতরের পরিবেশটা সাজানো–গোছানো। ভবনের নকশাটি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে করে সূর্যের আলোতে কাজ করতে পারেন শ্রমিকেরা। বৃষ্টির পানি ধরে তা পরিশোধন করে ব্যবহার করা হয়। শ্রমিকদের খাবারের জন্য আছে আলাদা জায়গা। প্রতিটি ভবনের আশপাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। 

শুনিভার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকের পরই সম্ভাবনাময় খাত চামড়া। তা ছাড়া পোশাকশিল্পের কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো অবধারিতভাবেই চামড়া খাতে চলে আসবে। সেটি উপলব্ধি করতে পেরেই আমরা পরিবেশবান্ধব কারখানা করেছি।





 সর্বোচ্চ সনদ যাদের

পোশাক ও বস্ত্র খাতের লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ২৪। সেগুলো হচ্ছে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, জেনেসিস ওয়াশিং ও জেনেসিস ফ্যাশনস, কলাম্বিয়া ওয়াশিং প্ল্যান্ট, ইউএইচএম লিমিটেড, প্লামি ফ্যাশনস, বিটপী গ্রুপের রেমি হোল্ডিংস ও তারাসিমা অ্যাপারেল, ডিজাইনার ফ্যাশনস, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, কানিজ ফ্যাশনস, এসকিউ কোলব্লেনস, এসকিউ সেলসিয়াস ২, এসকিউ বিরিকিনা, এসকিউ সেন্ট্রাল, ইকোটেক্স, এআর জিনস, গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের ইউনিট ৩, পাইওনিয়ার ডেনিম, কেনপার্ক ২ এবং দ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ওভেন অ্যান্ড ইউনিট ২। পোশাক ও বস্ত্র খাতের বাইরে ৪টি লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে এএসজি ফ্যান ফ্যাক্টরি, বিআইএফএফএল, সিটিস্কেপ ও সায়হাম টাওয়ার। 




পোশাকের গ্রিন ব্র্যান্ডিং 

পোশাক ও বস্ত্র খাতে ৯৫টি পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে। অর্জনটিকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে পারলে পোশাকের বাড়তি দাম পাওয়া সম্ভব। তবে সেই কাজটি সঠিকভাবে শুরু করা যায়নি বলে পরিবেশবান্ধব কারখানার উদ্যোক্তারা আক্ষেপ করলেন। 

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব কারখানা পোশাকশিল্পের জন্য বড় শক্তি। আমাদের শিল্পকে নিরাপদ ও টেকসই করতে সহায়তা করছে কারখানাগুলো। এটিকে কাজ লাগাতে আমরা কাজ শুরু করেছি। ইউএসজিবিসির সঙ্গে আমরা শিগগিরই একটি সমঝোতা স্মারক সই করব। তারা আমাদের পরিবেশবান্ধব কারখানার প্রচার-প্রচারণা চালাবে। তা ছাড়া আমরা নিজেরাও ব্র্যান্ডিংয়ে নামব।’




শুভংকর কর্মকার
প্রথম আলো 
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কোন মন্তব্য নেই: