টেক্সটাইলীও গল্প / Story of Textile :- একটি স্পিনিং মিলের বাস্তবতা এবং জীবনের গল্প
একটু না হয় কষ্ট ই সই !
বুয়েট থেকে পাশ করে কিছু কারনে আমার দেশে থাকতে হলো। আমার মা বাবা কে ছেড়ে যাওয়া টা সম্ভব ছিলো না ওই সময়। অনেকে হায়ার স্টাডিজ এর জন্য বিদেশ চলে গেলো। আবার আমরা বন্ধু রা কেউ কেউ বাংলাদেশে রয়ে গেলাম। আমি পাশ করার সাথে সাথেই একটা চাকরী পেয়ে গেলাম। যদি ও ঢাকার বাইরে। আমার যথেষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা একপ্রকার জোর করেই পাঠালেন। বাবা একটা কথা ই বল্লেন, মিল কারখানায় কিছু দিন কাটিয়ে আসো, অনেক এক্সপেরিয়েন্স হবে। মানুষ ঠেকে শেখে, তুমি ও ঠেকে শিখবা। বাবার আদেশ শিরোধার্য, চলে গেলাম টাঙ্গাইলের এক স্পিনিং মিলে।
প্রথম প্রথম আমার কান্না চলে আসতো। অসহ্য কষ্ট। প্রচন্ড গরমে টানা আট ঘন্টা ডিউটি। তাও আবার শিফটের চাকুরী। নাইট শিফট মানে রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬ টা। আমি ছিলাম প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার। স্পিনিং মিলে তুলা থেকে ইয়ার্ন তৈরী হয়। এর প্রোসেস বেশ লম্বা। আমি ছিলাম রিং স্পিনিং সেকশনে। সবচেয়ে যন্ত্রণাময় সেকশন। আকাশে বাতাসে তুলার আশ উড়ছে। নাক মুখ বন্ধ হয়ে আসে। আর কাজ ছিলো শ্রমিক দের সাথে। তাও আবার আমার সেকশনে ৪৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে বেশীর ভাগই মেয়ে। সবচেয়ে যন্ত্রণা ছিলো এদের ঝাড়ি মারা যেতো না। বকা দিলে ই ঘাড়ত্যাড়া করে গ্যাট ধরে থাকবে। আর যেহেতু কন্টিনিউয়াস প্রসেস, কাজে একটু ঢিলা দিলে পুরা প্রসেসে বারোটা বেজে যায়। আমি কূল কিনারা না পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। আমার দুঃস্বপ্ন ছিলো রিং স্পিনিং সেকশনের মহিলা শ্রমিক গুলা। মাঝে মাঝে সিনিয়র কলিগ দের সাথে কথা বলতাম। উনারা বিভিন্ন টিপস দিতেন। প্রথমত টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক রা বান্দরের মতো। বেশী আস্কারা দিলে মাথায় উঠে উকুন বাছা শুরু করবে, উকুন না পেলে চুল টেনে ছিড়বে। সো আস্কারা দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত এরা জন্মই হইসে কথা না শুনার জন্য। এদের শায়েস্তার উপায় একটা ই। কাজ থেকে বের করে দুই তিন দিন ঘুরানো। মিল কারখানায় এল,ডব্লিউ,পি নামক শাস্তি আছে। যার মানে লিভ উইথআআউট পে। সহজ বাংলায় ছুটি নিয়া বাতাস খা, বেতন পাবি না। এই পদ্ধতি তে এরা ঘায়েল।
আমি চালু করলাম এই পদ্ধতি, ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। মাস দুয়েক পর আমার জব ভালো লাগা শুরু করলো। এদের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্কের অবসান ঘটলো। আমি একটা জিনিস বের করলাম, এদের আই,ডি নাম্বার ধরে না ডেকে নাম ধরে ডাকলে খুব সন্মানিত বোধ করে। আমি ধীরে ধীরে ৪৫ জনের নাম মুখস্ত করে ফেল্লাম। আসমা, জমিরন, রাহেলা, হনুফা, তসলিমা, ঝর্না, শিরিন, লাভলী... এক সময় এদের সাথে গল্প করে এমন এক অবস্থা হলো, আমি কোনো অর্ডার দিলে এরা এক সাথে তিন জন ছুটে আসে, কে কাজ টা করবে। এক দিন আমার শিফটে প্রোডাকশন টার্গেট ছিলো ৭ টন। মোটামুটি অনেক বেশী। টার্গেট ফিল আপ না হলে ঝামেলা লেগে যাবে। কারন কাল এম,ডি নিজে প্রোডাকশনের সাথে মিটিং এ বসবে। আমি নতুন মানুষ, এই অবস্থায় আমি যদি টার্গেট অ্যাচিভ করতে না পারি, আমার ব্যাপারে সবাই প্রশ্ন তুলবে। আর টেক্সটাইল মিল মানে ই অনেক রকম পলিটিক্স, যাতে বলি হয় আমার মতো নতুন ইঞ্জিনিয়ার গুলো।
সেই দিন টা আমার মনে আছে। প্রচন্ড বৃষ্টি ছিলো। এর উপর নাইট শিফট। আমি ফ্লোরে গিয়ে দেখি আগের শিফট অনেক কাজ বাকী রেখে চলে গেছে। আর আমার শিফটে ৪৫ জনের যায়গায় ৩২ জন ওয়ার্কার এসেছে। আমার হাত পা অসাড়। বৃষ্টির কারনে অনেক ওয়ার্কার আসে নাই, এই ব্যাপারে কিছু বলার নাই। আমি আগের শিফটের বাকী কাজ শেষ করতেই ১ ঘন্টা খেয়ে ফেল্লাম। এরপর ডাক দিলাম আসমা কে। অনেক করুণ কন্ঠে বল্লাম, "আজ সাত টন প্রোডাকশন দিতে হবে। এমন এক দিনে তোমাদের অনুরোধ করলাম, যেই দিনে লোক নাই, সময় ও নাই। কাজ না করতে পারলে তোমাদের কোনো সমস্য নাই, কারন কাজ টা এই কয় জন মিলে করা সম্ভব না আমি জানি। শুধু মনে কইরো, আজ ৩২ না, ৩৩ জন ওয়ার্কার, আমি সহ।"
আমার কথা শুনে আসমা বল্লো, "স্যার, আইজ সাড়ে সাত টন নামামু, আপনে আমাগোর উপ্রে ছাইড়া দেন, এক এক জন দুই টা কইরা লাইন দেখুম। (সাধারনত এক ওয়ার্কার এক লাইন করে দেখে, মোট ছিলো ৪০ লাইন)
সেই রাতে আমি ও নিজের হাতে ববিনের ট্রলি ঠেলেছি। নিজের হাতে রোভিং (ইয়ার্ন যা থেকে তৈরী হয়) লোড করেছি। আর আমার সেই ৩২ জন ওয়ার্কার? মাঝে টিফিন ব্রেকে ওরা খেতেও যায় নি কেউ! ভোর পাচ টা চল্লিশে আমাদের পৌনে আট টন সুতা রেডী।
আমি বাক্য হারা। হনুফা আমাকে বলে, "স্যার আপনের অসন্মান হইবো, এই টা কহনো হইবো না।"
আমার চাকুরী জীবনের টিম মেম্বার এই পঁয়তাল্লিশ জন অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক। যারা মাঝে মাঝে আমার জন্য পিঠা, পায়েস রান্না করে নিয়ে আসতো। কেউ কেউ গাছের আম, নারিকেল অথবা কামরাঙ্গা ব্যাগ ভরে নিয়ে আসতো। বিনিময়ে তাদের প্রত্যাশা ছিলো একটু মমতা, একটু কোমল গলায় কথা। টেক্সটাইল মিলের ওয়ার্কারদের যে কী পরিমান কষ্ট করতে হয়, তা কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। এদের কেউ কেউ নিজের প্রচন্ড জ্বর, বাচ্চার অসুখ রেখে কাজ করতে আসে। কেউ কেউ না খেয়ে আসে। কেউ কেউ একটু পয়সা বাচানোর জন্য টিফিন খায় না। কারো কারো এতো বেশী কষ্ট যে নিজের কষ্ট কে হাস্যকর মনে হয়।
আমি এর হয়তো কিছুই জানতাম না। জেনেছি এদের সাথে মিশে।
রাশেদা, ও পাচ নম্বর মেশিনে কাজ করতো। চুপচাপ মেয়ে। কাজে খুব দক্ষ। জানলাম ও খুব ভালো ছাত্রী। এস,এস,সি দেবে কিছু দিন পর। আমার কাছে খুব ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে এলো। "স্যার আমি পরীক্ষা দিমু, মাঝে পরীক্ষার দিন গুলান ছুটি লাগবো।"
আমি হেসে ফেল্লাম। ওকে পাচশ টাকা দিয়ে বল্লাম, "দোয়া করি, ভালো মতো পরীক্ষা দাও, আর এই টাকা টা দিয়ে পছন্দ মতো কিছু কিনে খেও, তোমার ছুটি পাশ"
বোকা মেয়ে টা কেঁদে ফেল্লো। আমি চুরান্ত পর্যায়ের অপ্রস্তুত। হয়তো এতো সামান্য স্নেহ টুকু ও কারো কাছ থেকে পায়নি।
তিন দিন পরই রাশেদা কাজে এলো। আমি তো খুব ই অবাক। আমাকে দেখে ও আড়ালে চলে গেলো। যা জানলাম তা হলো, রাশেদার স্বামী ওকে এস,এস,সি পরীক্ষা দিতে দেবে না। কারন বেশী শিক্ষিত বউ থাকা অশান্তির কারন। কিন্তু রাশেদা জেদ করেছিলো। আর এই কারনে ওর শ্বাশুরী ওর পিঠে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ চেপে ধরেছিলো। রাশেদার পরীক্ষা দেয়া হয় নি। এরপর থেকে রাশেদা পড়াশুনা বাদ দিয়েছিলো। ও এক বার আমাকে বলেছিলো ও নার্স হয়ে সবার সেবা করতে চায়।
হনুফা ছিলো খুব ই চঞ্চল একটা মেয়ে। ঠাশ ঠাশ কথা বলতো। কাজে ছিলো অসাধারন। ও মেটারনিটি লিভে যাবে। আমি ই সব পাশ করিয়ে জি,এম স্যার কে বলে অ্যাডভান্স টাকার ব্যাবস্থা করে ওর হাতে তুলে দিলাম। যাবার সময় আমাকে সালাম করে গেলো। আমি যথারীতি অপ্রস্তুত! সে আমাকে বল্লো, "স্যার আমার বাচ্চা রে দেখবার আইবেন! আমার বাড়ি এই থন এক কিলো। না আইলে আমি রাগ করুম। আপনের আইতেই হইবো"আমি বুক টা কেমন করে উঠলো। আমি এতো ভালোবাসার যোগ্য না। খুব সাধারন একটা ছেলে। এরা আমাকে অনেক বেশী উপরে স্থান দিয়েছে।
ঠিক সময় মতো ও এলো। ওর বাচ্চা টা কে দেখতে যাওয়া হয়নি। হনুফা কে দেখে আমি বেশ একটা ভয় ই পেলাম। না জানি কি বলে!
নাহ! ও কিছুই বল্লো না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ওর বাচ্চার খবর। ক্লান্ত দৃষ্টি তে তাকালো। বাচ্চা টা কে নিয়ে ও বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ছেলে বাচ্চা হয় নাই বলে ওর শ্বশুর বাড়ির মানুষ ওকে লাথি মেরে ওই রাতেই বাচ্চা সহ বের করে দিয়েছিলো যে রাতে ওর কোল জুড়ে বাচ্চা টা এসেছিলো। ওর বাচ্চাকে বুকে নিয়ে তিন চার কিলো হেটে ওর বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। ঠিক তার তিন দিন পর হনুফার স্বামী আরেক টা বিয়ে করে। হনুফার স্বপ্ন ছিলো টাকা জমিয়ে স্বামীর জন্য একটা সাইকেল কিনবে। স্বামীর অফিস যেতে খুব ই সমস্যা হয়। সে ঐ চিন্তায় প্রায় ই বিচলিত থাকতো।
ঝর্ণা তিন দিন ধরে কাজে আসে না। নাইট শিফটে মাঝে মাঝে ই ওয়ার্কার রা হুট হাট আসে না। তিন দিন পর বিধ্বস্ত ঝর্ণা কাজে এলো। অন্যদের কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার গা টা গুলিয়ে গেলো। তিন দিন আগে ও ফ্যাক্টরি তে আসছিলো, পথে এক যুবক তার দুই বন্ধু মিলে তাকে জোড় করে টেনে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালায়।
সে কাউ কে ঘটনা বলে নাই ভয়ে, কিন্তু ঘটনা সবাই জেনে যায়। এরপর পুলিশের কাছে তো বিচার যায় ই নাই বরং "অসভ্য" চালচলনের জন্য ঝর্নাকে সবার সামনে মাফ চাইতে হলো। ঝর্ণা এখন পাথর হয়ে গেছে। ফড়িং এর মতো উড়ে উড়ে যে কাজ করতো, সে হঠাৎ করেই যেনো বুড়িয়ে গেছে।
ঝর্নার কিছুদিন পর বিয়ে হবার কথা ছিলো। সংসার করার কথা ছিলো। যে যুবক তার বন্ধু দের নিয়ে পশুর মতো কাজ টা করেছিলো, সেই পশু টার সাথেই তার বিয়ে হবার কথা ছিলো।
এই প্রতি টা ঘটনা দিনের মতো সত্য আর প্রতি টা ঘটনার পর এরা সবাই পেটের দায়ে আবার কাজে ফিরে এসেছে। আবার এরা পরম মমতায় সুতা বানিয়েছে, মেশিনে ববিন লাগিয়েছে। ওদের চোখের জল মিলে মিশে গেছে প্রতিটা সুতার সাথে। যে সুতা রপ্তানি হয়েছে এইচ,এন,এম, ভার্সাচে, পিয়েরে কার্ডিন, টমি হিল্ফিগারের মতো নামীদামী ব্র্যান্ডে।
সেই ব্র্যান্ডের শার্ট পড়ে আমরা আমাদের স্ত্রীর সাথে, প্রেমিকার সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করি। আর রাশেদা, হনুফা ঝর্না রা সুতা বানিয়ে যায়।
আমার আজ অনেক কষ্টেও কষ্ট লাগে না। অনেক দুঃখেও চোখে পানি আসেনা। কারন আমাদের দুঃখ বিলাস ওদের হাসায়। আর ওদের কষ্ট আমাদের অবাক করে।
লেখাটি সংগ্রহকরা
একটু না হয় কষ্ট ই সই !
বুয়েট থেকে পাশ করে কিছু কারনে আমার দেশে থাকতে হলো। আমার মা বাবা কে ছেড়ে যাওয়া টা সম্ভব ছিলো না ওই সময়। অনেকে হায়ার স্টাডিজ এর জন্য বিদেশ চলে গেলো। আবার আমরা বন্ধু রা কেউ কেউ বাংলাদেশে রয়ে গেলাম। আমি পাশ করার সাথে সাথেই একটা চাকরী পেয়ে গেলাম। যদি ও ঢাকার বাইরে। আমার যথেষ্ট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা একপ্রকার জোর করেই পাঠালেন। বাবা একটা কথা ই বল্লেন, মিল কারখানায় কিছু দিন কাটিয়ে আসো, অনেক এক্সপেরিয়েন্স হবে। মানুষ ঠেকে শেখে, তুমি ও ঠেকে শিখবা। বাবার আদেশ শিরোধার্য, চলে গেলাম টাঙ্গাইলের এক স্পিনিং মিলে।
প্রথম প্রথম আমার কান্না চলে আসতো। অসহ্য কষ্ট। প্রচন্ড গরমে টানা আট ঘন্টা ডিউটি। তাও আবার শিফটের চাকুরী। নাইট শিফট মানে রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬ টা। আমি ছিলাম প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার। স্পিনিং মিলে তুলা থেকে ইয়ার্ন তৈরী হয়। এর প্রোসেস বেশ লম্বা। আমি ছিলাম রিং স্পিনিং সেকশনে। সবচেয়ে যন্ত্রণাময় সেকশন। আকাশে বাতাসে তুলার আশ উড়ছে। নাক মুখ বন্ধ হয়ে আসে। আর কাজ ছিলো শ্রমিক দের সাথে। তাও আবার আমার সেকশনে ৪৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে বেশীর ভাগই মেয়ে। সবচেয়ে যন্ত্রণা ছিলো এদের ঝাড়ি মারা যেতো না। বকা দিলে ই ঘাড়ত্যাড়া করে গ্যাট ধরে থাকবে। আর যেহেতু কন্টিনিউয়াস প্রসেস, কাজে একটু ঢিলা দিলে পুরা প্রসেসে বারোটা বেজে যায়। আমি কূল কিনারা না পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। আমার দুঃস্বপ্ন ছিলো রিং স্পিনিং সেকশনের মহিলা শ্রমিক গুলা। মাঝে মাঝে সিনিয়র কলিগ দের সাথে কথা বলতাম। উনারা বিভিন্ন টিপস দিতেন। প্রথমত টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক রা বান্দরের মতো। বেশী আস্কারা দিলে মাথায় উঠে উকুন বাছা শুরু করবে, উকুন না পেলে চুল টেনে ছিড়বে। সো আস্কারা দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত এরা জন্মই হইসে কথা না শুনার জন্য। এদের শায়েস্তার উপায় একটা ই। কাজ থেকে বের করে দুই তিন দিন ঘুরানো। মিল কারখানায় এল,ডব্লিউ,পি নামক শাস্তি আছে। যার মানে লিভ উইথআআউট পে। সহজ বাংলায় ছুটি নিয়া বাতাস খা, বেতন পাবি না। এই পদ্ধতি তে এরা ঘায়েল।
আমি চালু করলাম এই পদ্ধতি, ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। মাস দুয়েক পর আমার জব ভালো লাগা শুরু করলো। এদের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্কের অবসান ঘটলো। আমি একটা জিনিস বের করলাম, এদের আই,ডি নাম্বার ধরে না ডেকে নাম ধরে ডাকলে খুব সন্মানিত বোধ করে। আমি ধীরে ধীরে ৪৫ জনের নাম মুখস্ত করে ফেল্লাম। আসমা, জমিরন, রাহেলা, হনুফা, তসলিমা, ঝর্না, শিরিন, লাভলী... এক সময় এদের সাথে গল্প করে এমন এক অবস্থা হলো, আমি কোনো অর্ডার দিলে এরা এক সাথে তিন জন ছুটে আসে, কে কাজ টা করবে। এক দিন আমার শিফটে প্রোডাকশন টার্গেট ছিলো ৭ টন। মোটামুটি অনেক বেশী। টার্গেট ফিল আপ না হলে ঝামেলা লেগে যাবে। কারন কাল এম,ডি নিজে প্রোডাকশনের সাথে মিটিং এ বসবে। আমি নতুন মানুষ, এই অবস্থায় আমি যদি টার্গেট অ্যাচিভ করতে না পারি, আমার ব্যাপারে সবাই প্রশ্ন তুলবে। আর টেক্সটাইল মিল মানে ই অনেক রকম পলিটিক্স, যাতে বলি হয় আমার মতো নতুন ইঞ্জিনিয়ার গুলো।
সেই দিন টা আমার মনে আছে। প্রচন্ড বৃষ্টি ছিলো। এর উপর নাইট শিফট। আমি ফ্লোরে গিয়ে দেখি আগের শিফট অনেক কাজ বাকী রেখে চলে গেছে। আর আমার শিফটে ৪৫ জনের যায়গায় ৩২ জন ওয়ার্কার এসেছে। আমার হাত পা অসাড়। বৃষ্টির কারনে অনেক ওয়ার্কার আসে নাই, এই ব্যাপারে কিছু বলার নাই। আমি আগের শিফটের বাকী কাজ শেষ করতেই ১ ঘন্টা খেয়ে ফেল্লাম। এরপর ডাক দিলাম আসমা কে। অনেক করুণ কন্ঠে বল্লাম, "আজ সাত টন প্রোডাকশন দিতে হবে। এমন এক দিনে তোমাদের অনুরোধ করলাম, যেই দিনে লোক নাই, সময় ও নাই। কাজ না করতে পারলে তোমাদের কোনো সমস্য নাই, কারন কাজ টা এই কয় জন মিলে করা সম্ভব না আমি জানি। শুধু মনে কইরো, আজ ৩২ না, ৩৩ জন ওয়ার্কার, আমি সহ।"
আমার কথা শুনে আসমা বল্লো, "স্যার, আইজ সাড়ে সাত টন নামামু, আপনে আমাগোর উপ্রে ছাইড়া দেন, এক এক জন দুই টা কইরা লাইন দেখুম। (সাধারনত এক ওয়ার্কার এক লাইন করে দেখে, মোট ছিলো ৪০ লাইন)
সেই রাতে আমি ও নিজের হাতে ববিনের ট্রলি ঠেলেছি। নিজের হাতে রোভিং (ইয়ার্ন যা থেকে তৈরী হয়) লোড করেছি। আর আমার সেই ৩২ জন ওয়ার্কার? মাঝে টিফিন ব্রেকে ওরা খেতেও যায় নি কেউ! ভোর পাচ টা চল্লিশে আমাদের পৌনে আট টন সুতা রেডী।
আমি বাক্য হারা। হনুফা আমাকে বলে, "স্যার আপনের অসন্মান হইবো, এই টা কহনো হইবো না।"
আমার চাকুরী জীবনের টিম মেম্বার এই পঁয়তাল্লিশ জন অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক। যারা মাঝে মাঝে আমার জন্য পিঠা, পায়েস রান্না করে নিয়ে আসতো। কেউ কেউ গাছের আম, নারিকেল অথবা কামরাঙ্গা ব্যাগ ভরে নিয়ে আসতো। বিনিময়ে তাদের প্রত্যাশা ছিলো একটু মমতা, একটু কোমল গলায় কথা। টেক্সটাইল মিলের ওয়ার্কারদের যে কী পরিমান কষ্ট করতে হয়, তা কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। এদের কেউ কেউ নিজের প্রচন্ড জ্বর, বাচ্চার অসুখ রেখে কাজ করতে আসে। কেউ কেউ না খেয়ে আসে। কেউ কেউ একটু পয়সা বাচানোর জন্য টিফিন খায় না। কারো কারো এতো বেশী কষ্ট যে নিজের কষ্ট কে হাস্যকর মনে হয়।
আমি এর হয়তো কিছুই জানতাম না। জেনেছি এদের সাথে মিশে।
রাশেদা, ও পাচ নম্বর মেশিনে কাজ করতো। চুপচাপ মেয়ে। কাজে খুব দক্ষ। জানলাম ও খুব ভালো ছাত্রী। এস,এস,সি দেবে কিছু দিন পর। আমার কাছে খুব ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে এলো। "স্যার আমি পরীক্ষা দিমু, মাঝে পরীক্ষার দিন গুলান ছুটি লাগবো।"
আমি হেসে ফেল্লাম। ওকে পাচশ টাকা দিয়ে বল্লাম, "দোয়া করি, ভালো মতো পরীক্ষা দাও, আর এই টাকা টা দিয়ে পছন্দ মতো কিছু কিনে খেও, তোমার ছুটি পাশ"
বোকা মেয়ে টা কেঁদে ফেল্লো। আমি চুরান্ত পর্যায়ের অপ্রস্তুত। হয়তো এতো সামান্য স্নেহ টুকু ও কারো কাছ থেকে পায়নি।
তিন দিন পরই রাশেদা কাজে এলো। আমি তো খুব ই অবাক। আমাকে দেখে ও আড়ালে চলে গেলো। যা জানলাম তা হলো, রাশেদার স্বামী ওকে এস,এস,সি পরীক্ষা দিতে দেবে না। কারন বেশী শিক্ষিত বউ থাকা অশান্তির কারন। কিন্তু রাশেদা জেদ করেছিলো। আর এই কারনে ওর শ্বাশুরী ওর পিঠে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ চেপে ধরেছিলো। রাশেদার পরীক্ষা দেয়া হয় নি। এরপর থেকে রাশেদা পড়াশুনা বাদ দিয়েছিলো। ও এক বার আমাকে বলেছিলো ও নার্স হয়ে সবার সেবা করতে চায়।
হনুফা ছিলো খুব ই চঞ্চল একটা মেয়ে। ঠাশ ঠাশ কথা বলতো। কাজে ছিলো অসাধারন। ও মেটারনিটি লিভে যাবে। আমি ই সব পাশ করিয়ে জি,এম স্যার কে বলে অ্যাডভান্স টাকার ব্যাবস্থা করে ওর হাতে তুলে দিলাম। যাবার সময় আমাকে সালাম করে গেলো। আমি যথারীতি অপ্রস্তুত! সে আমাকে বল্লো, "স্যার আমার বাচ্চা রে দেখবার আইবেন! আমার বাড়ি এই থন এক কিলো। না আইলে আমি রাগ করুম। আপনের আইতেই হইবো"আমি বুক টা কেমন করে উঠলো। আমি এতো ভালোবাসার যোগ্য না। খুব সাধারন একটা ছেলে। এরা আমাকে অনেক বেশী উপরে স্থান দিয়েছে।
ঠিক সময় মতো ও এলো। ওর বাচ্চা টা কে দেখতে যাওয়া হয়নি। হনুফা কে দেখে আমি বেশ একটা ভয় ই পেলাম। না জানি কি বলে!
নাহ! ও কিছুই বল্লো না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ওর বাচ্চার খবর। ক্লান্ত দৃষ্টি তে তাকালো। বাচ্চা টা কে নিয়ে ও বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ছেলে বাচ্চা হয় নাই বলে ওর শ্বশুর বাড়ির মানুষ ওকে লাথি মেরে ওই রাতেই বাচ্চা সহ বের করে দিয়েছিলো যে রাতে ওর কোল জুড়ে বাচ্চা টা এসেছিলো। ওর বাচ্চাকে বুকে নিয়ে তিন চার কিলো হেটে ওর বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। ঠিক তার তিন দিন পর হনুফার স্বামী আরেক টা বিয়ে করে। হনুফার স্বপ্ন ছিলো টাকা জমিয়ে স্বামীর জন্য একটা সাইকেল কিনবে। স্বামীর অফিস যেতে খুব ই সমস্যা হয়। সে ঐ চিন্তায় প্রায় ই বিচলিত থাকতো।
ঝর্ণা তিন দিন ধরে কাজে আসে না। নাইট শিফটে মাঝে মাঝে ই ওয়ার্কার রা হুট হাট আসে না। তিন দিন পর বিধ্বস্ত ঝর্ণা কাজে এলো। অন্যদের কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার গা টা গুলিয়ে গেলো। তিন দিন আগে ও ফ্যাক্টরি তে আসছিলো, পথে এক যুবক তার দুই বন্ধু মিলে তাকে জোড় করে টেনে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালায়।
সে কাউ কে ঘটনা বলে নাই ভয়ে, কিন্তু ঘটনা সবাই জেনে যায়। এরপর পুলিশের কাছে তো বিচার যায় ই নাই বরং "অসভ্য" চালচলনের জন্য ঝর্নাকে সবার সামনে মাফ চাইতে হলো। ঝর্ণা এখন পাথর হয়ে গেছে। ফড়িং এর মতো উড়ে উড়ে যে কাজ করতো, সে হঠাৎ করেই যেনো বুড়িয়ে গেছে।
ঝর্নার কিছুদিন পর বিয়ে হবার কথা ছিলো। সংসার করার কথা ছিলো। যে যুবক তার বন্ধু দের নিয়ে পশুর মতো কাজ টা করেছিলো, সেই পশু টার সাথেই তার বিয়ে হবার কথা ছিলো।
এই প্রতি টা ঘটনা দিনের মতো সত্য আর প্রতি টা ঘটনার পর এরা সবাই পেটের দায়ে আবার কাজে ফিরে এসেছে। আবার এরা পরম মমতায় সুতা বানিয়েছে, মেশিনে ববিন লাগিয়েছে। ওদের চোখের জল মিলে মিশে গেছে প্রতিটা সুতার সাথে। যে সুতা রপ্তানি হয়েছে এইচ,এন,এম, ভার্সাচে, পিয়েরে কার্ডিন, টমি হিল্ফিগারের মতো নামীদামী ব্র্যান্ডে।
সেই ব্র্যান্ডের শার্ট পড়ে আমরা আমাদের স্ত্রীর সাথে, প্রেমিকার সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করি। আর রাশেদা, হনুফা ঝর্না রা সুতা বানিয়ে যায়।
আমার আজ অনেক কষ্টেও কষ্ট লাগে না। অনেক দুঃখেও চোখে পানি আসেনা। কারন আমাদের দুঃখ বিলাস ওদের হাসায়। আর ওদের কষ্ট আমাদের অবাক করে।
লেখাটি সংগ্রহকরা
1 টি মন্তব্য:
Choke Pani chole aslo...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন