একটি লোকাল ব্রান্ডের মার্চেন্ডাইজিং করতে হইলে কোন কোন বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে?
মার্চেন্ডাইজিং (Merchandising) শব্দটির ইংরেজি শব্দ (merchant) থেকে এসেছে, যার অর্থ ব্যবসায়ী। মার্চেন থেকে মার্চেন্ডাইজ (Merchandise) যার অর্থ ব্যবসার উদ্দেশ্যে পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয়। মার্চেন্ডাইজিং থেকে মার্চেন্ডাইজার যার কাজই হলো বিক্রয় ডিপার্টমেন্ট পরিচালনা করা।
একজন মার্চেন্ডাইজার এর যেমন যোগ্যতা থাকা চাইঃ
মার্চেন্ডাইজার হওয়ার জন্য যেকোনো বিষয়ে স্নাতক হলেই চলে। তবে অগ্রাধিকার পায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেক্সটাইলের যেকোনো বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা। মার্চেন্ডাইজারদের বিভিন্ন দেশের ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এ জন্য ইংরেজিতে যোগাযোগের দক্ষতা থাকতে হয়। পাশাপাশি অন্য দেশের ভাষা জানা থাকলে বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। কম্পিউটারেও দক্ষতা থাকা চাই।
পোশাক শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন একজন মার্চেন্ডাইজার। মার্চেন্ডাইজিং পেশা হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ একজন মার্চেন্ডাইজার কে সবসময় ক্রেতার সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। শুধু তাই নয় পোশাক তৈরির অর্ডার নেয়া থেকে শুরু করে অর্ডার অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ এবং মান নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে করতে হয় একজন মার্চেন্ডাইজারকে। এছাড়া ক্রেতার চাহিদামত পণ্য তৈরি হচ্ছে কিনা তাও দেখতে হয়।
এক কথায় বলতে গেলে গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং বলতে, এক পক্ষ থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে সেই কাঁচামাল থেকে পণ্য প্রস্তুত করে সেই প্রস্তুতকৃত অন্য অন্য পক্ষের কাছে বিক্রি করা, এটাই মূলত গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং।
▪সফল মার্চেন্ডাইজার হতে প্রয়োজনীয় গুণাবলীঃ
গার্মেন্টস সেক্টরে ক্রেতা এবং প্রস্তুতকারকের মধ্যে যিনি সেতু বা মিডল ম্যানের মতো কাজ করে তিনিই হচ্ছেন মার্চেন্ডাইজার। মোট কথা পণ্যটি তৈরি করতে তিনিই প্রধান দায়িত্বশীল ব্যক্তি। মার্চেন্ডাইজার হতে একজনকে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতে হবে। মার্চেন্ডাইজার কোন ডিজাইনার নন কিন্তু অনুধাবনের দায়িক্তে তিনিই থাকেন ,যিনি কোন ডিজাইন টি মার্কেটে চলবে আর কোনটি চলবে না তার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য মার্চেন্ডাইজারকে প্রতিটি পণ্যের স্টাইলের ভিতরে ঢুকতে হয় এবং বিশ্লেষণ করতে হয়। আবার মাথায় রাখতে হয় স্টাইলিং এর খরচের দিকেও।
একটি যোগ্যতাসম্পন্ন পোশাক মার্চেন্ডাইজারের পণ্য সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে তিনি ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যটি সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি বুঝতে পারবেন এবং প্রস্তুতকারকের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরবেন।একটি যোগ্য মার্চেন্ডাইজার হতে, যোগাযোগের দক্ষতা একটি প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন অর্ডার সঠিক সময়ে শিপমেন্ট সম্পন্ন হওয়া নির্ভর করে মার্চেন্ডাইজারের চমৎকার যোগাযোগ দক্ষতার উপর।কারন যদি আপনি সহজে ক্রেতার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এবং প্রস্তুতকারীর সাথে বসে সঠিক সময় সিডিউল করতে পারেন তবেই সহজে অর্ডার টি সম্পন্ন হতে পারে।
বিদেশিদের সাথে যোগাযোগের জন্য বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজিতে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজার হওয়ার জন্য ইংরেজীর দক্ষতা একটি জ্বলন্ত মানদণ্ড। একটি অর্ডার একজিকিউশনের বিভিন্ন সময়ে বাইয়ারের সাথে শত শত বার মেইল কমিউনিকেশন করতে হয়। ডিজাইন, মেজারমেন্ট, কোয়ালিটি, প্রোডাকশন লাইন মেনেজমেন্ট, শিপমেন্টের সমস্ত বিষয়ে ক্রেতার ও মার্চেন্ডাইজারের মধ্যে কাটাছেড়া বিশ্লেষণ চলে। যার প্রধান মাধ্যম মেইল।শুধু প্রাইজ নেগোসিয়েশন ই একটি অর্ডার পাওয়ার পুর্বশর্ত নয়, শিপমেন্ট এর সময় মিট করতে না পারলে পুরো অর্ডার লস প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য অর্ডার নেয়ার পুর্বে গার্মেন্টস কারখানার বর্তমান পরিস্থিতিকে অনুধাবন করতে হবে, সাথে বিভিন্ন আইটেম সঠিক সময় মত সোর্স করা সম্ভব হবে কিনা সেটা যাচাই করে তারপর একটি অর্ডার গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় শিপমেন্ট মিট না করতে পারলে বাইয়ারের কাছে একটি খারাপ ইম্প্রেশন তৈরি করবে। সুতরাং, যোগ্য মার্চেন্ডাইজার হতে, কারখানা সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান রাখা আবশ্যক।
আরো সহজভাবে বলতে গেলে, একটি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মার্চেন্ডাইজার একজন ক্রেতার কাছ থেকে অর্ডার কালেক্ট করে, সেই অর্ডার পরিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন ফেব্রিক, ইয়ার্ন, কেমিক্যাল, ডাইস, জিপার, বাটন, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রয় করে গার্মেন্টস এর মাধ্যমে ক্রেতার চাহিদা মতো পণ্য তৈরি করে সেই পণ্য ক্রেতার নিকট পৌছানো পর্যন্ত সকল কাজ তত্ববধানে রাখি।
একজন গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজার কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ক্রেতার নিকট থেকে অর্ডার পাওয়ার পর থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত সব কিছু, তাছাড়া,
১. পণ্য প্রস্তুত করার জন্য কাঁচামালের এর দাম।
২. গার্মেন্টসের শ্রমিকদের খরচ/বেতন।
৩. গার্মেন্টসের বিদ্যুৎ বিল।
৪. গার্মেন্টস এর ভাড়া ইত্যাদি।
৫. সকল স্টাফ অফিসারের বেতন।
৬. সকল মেনটেনেন্স খরচ।
৭. ৭. ক্যাড এর সাথে যোগাযোগ ।
৮. ফ্যাশন ডিজাইনে সাথে যোগাযোগ ।
৯.আর এন ডির সাথে যোগাযোগ ।
১০. কাস্টমারের সাথে কন্টিনিউ কমিউনিকেশন ।
১১. সেম্পল ডেভেলপমেন্ট ।
১২. অর্ডার রিসিভ ।
১৩. পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ।
১৪. অর্ডার কনফার্ম ।
১৫. সেম্পল তৈরি করা ।
১৬. পিপি সেম্পল ।
১৭. প্রি প্রোডাকশন মিটিং ।
১৮. লিস্ট চেক ।
১৯. বাল্ক প্রোডাকশন ।
২০. রিসিভ পেমেন্ট । আরো অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় যা নিছে বলার চেষ্টা করা হল ।
টোটাল সব খরচ যেন বিক্রিত পণ্যের দামের থেকে কম হয়। অর্থাৎ ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রয় করে যেন গার্মেন্টসের লাভ থাকে সে বিষয়টি একজন মার্চেন্ডাইজার এর মাথা থাকতে হবে। ক্রেতার থেকে অর্ডার রিসিভ করা থেকে শিপমেন্ট পর্যন্ত গার্মেন্টস
অর্ডার রিসিভঃ
গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজারের সর্ব প্রথম কাজ হলো ক্রেতার কাছ থেকে সবকিছু রিসিভ করা, অর্ডার টির সম্পূর্ণ টেকনিকেল দিক বুঝে নেওয়া।
সেম্পল ডেভেলপমেন্টঃ
ক্রেতার অর্ডার সিট এ যেভাবে অর্ডার দেওয়া আছে ঠিক সেভাবে স্যাম্পল তৈরি করা, এটাই স্যাম্পল ডেভেলপমেন্ট।
পণ্যের মূল্য নির্ধারণঃ
মার্চেন্ডাইজার কে অবশ্যই ক্রেতার থেকে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার পূর্বে গার্মেন্টসের লাভ এর দিকটা মাথায় রাখতে হবে।
অর্ডার কনফার্মঃ
ক্রেতার নিকট থেকে অর্ডার কনফার্ম করা।
সেম্পল তৈরি করাঃ
অর্ডার কৃত পণ্যের স্যাম্পল তৈরি করে ক্রেতার নিকট দেয়া।
রিকুইজেশন বাল্ক ফেব্রিকঃ
প্রোডাকশন প্রস্তুত করার জন্য কি পরিমান ফেব্রিক লাগবে তার সিট প্রস্তুত করা।
রিকুইজেশন এক্সেসরিজঃ
অর্ডারকৃত পণ্য প্রস্তুত করার জন্য যা যা প্রয়োজন সেগুলোর জন্য পারচেজ অর্ডার তৈরি করতে হবে।
নমুনা বোর্ডঃ
প্রোডাক্টটি প্রস্তুত করার জন্য যা যা অ্যাকেসরিজ প্রয়োজন সেগুলো স্যাম্পল নিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
ম্যাটারিয়াল কালেকশনঃ
অর্ডার সম্পূর্ণ করার জন্য যা যা ম্যাটারিয়াল প্রয়োজন হয় তা কালেক্ট করা।
লিস্ট চেকঃ
প্রোডাকশনে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে সে কারণে বার বার লিস্ট চেক করা যাতে করে কোন ম্যাটারিয়াল বাদ না পড়ে।
পিপি সেম্পলঃ
পিপি সেম্পল ক্ষেত্রে সব একচুয়াল হতে হবে, ক্রেতা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই সেম্পল প্রস্তুত করতে হবে।
প্রি প্রোডাকশন মিটিংঃ
প্রোডাকশন প্রস্তুত করার আগে মিটিং করা হয়। এই মিটিং এ প্রোডাকশনের কর্মরত সব কর্মচারী থাকবে। মিটিং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রোডাকশন টি সম্পন্ন করা।
বাল্ক প্রোডাকশনঃ
বাল্ক প্রোডাকশন অর্থাৎ ক্রেতা যেই অর্ডার করেছে সেই অর্ডার অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুত করা।
চেক ডেইলি প্রোডাকশন এন্ড কোয়ালিটি রিপোর্টঃ
ক্রেতার অর্ডারটি নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্ট করতে হবে। তাই একজন মার্চেন্ডাইজার কে আগে থেকেই প্ল্যানিং করতে হবে,যে প্রতিদিন কি পরিমান প্রোডাকশন হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করা সম্ভব।
অনলাইন ইনস্পেকশনঃ
অনলাইন ইনস্পেকশন মানে প্রোডাকশনের কাজ চলাকালীন সময়ে ক্রেতার সাথে কথা বলে ইন্সপেকশন এর ডেট ফিক্সট করতে হবে যাতে করে ক্রেতার নির্ধারিত প্রতিনিধি এসে প্রোডাকশন কৃত পণ্যের কোয়ালিটি ঠিক আছে কিনা তা চেক করে।
ফাইনাল ইনস্পেকশন জন্য বাল্ক প্রোডাকশনঃ
প্রডাকশন শেষ হবার পরে কিন্তু শিপমেন্ট করার আগে ক্রেতার সাথে কথা বলে সর্বশেষ ইনস্পেকশন এর জন্য ডেট ফিক্সট করতে হবে। তার জন্য ফাইনাল ইনস্ট্রাকশন জন্য বাল্ক প্রোডাকশনের সিট প্রস্তুত করতে হবে।
সেম্পল সেন্ড টু থার্ড পার্টি টেস্টিং সেন্টারঃ
সেম্পল গুলোকে থার্ড পার্টির কাছে পাঠাতে হবে সেম্পল এর কোয়ালিটি টেস্ট করার জন্য। ও তার রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।
শিপমেন্ট ফাইনাল ইন্সপেকশনঃ
প্রোডাকশন কৃত সকল পণ্য ক্রেতার নিকট পাঠানোর জন্য শিপমেন্ট করতে হবে। এর জন্য ইন্সপেকশন করতে হবে।
সব ডকুমেন্ট ক্রেতাকে পাঠাতে হবেঃ
অর্ডারের কোয়ান্টিটি সহ সবধরনের ডকুমেন্ট ক্রেতার নিকট পাঠাতে হবে।
রিসিভ পেমেন্টঃ
ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পণ্য বুঝিয়ে দিতে পারলে ক্রেতা ব্যাংকে পেমেন্ট পাঠিয়ে দিবে।
মার্চেন্ডাইজিংকে পেশা হিসেবে নিতে চাইলে কি কি বিষয়ে দক্ষতা ও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন সেসব বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন.
১. একজন মার্চেন্ডাইজারকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হয়। এসপেশালি ইংরেজি ভাষা বোঝার দক্ষতা থাকতে হবে।
২. পোশাক শিল্পের সকল প্রক্রিয়া ও কাঁচামালের দাম সম্পর্কে ধারনা থাকতে হয়।
৩. আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট শিপিং, কাস্টমস, বায়িং পলিসি এসব কাজে দক্ষতা থাকতে হয়।
৪. ক্রেতার কনভিন্স করার দক্ষতা থাকতে হয়।
৫. হিসাব নিকাশ ও পরিকল্পনায় দক্ষ থাকতে হয়।
৬. সর্বোপরি পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে।
ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন