কিভাবে বন্ডের অপব্যবহার কিভাবে স্থানীয় পোশাক শিল্পের ক্ষতি করে
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্প। দেশের মোট প্রবৃদ্ধির ছয়-আট শতাংশ আসে এই সেক্টর থেকে। পোশাক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে কাপড় (ফেব্রিক্স)। যখন দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাপড় সরবরাহ করতে পারে না, তখন প্রতিবেশী দেশগুলো (যেমন: ভারত, পাকিস্থান, চীন, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি) থেকে আমদানী করতে হয়। সরকারের আইন অনুযায়ী কোন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানী করতে হলে সেই পন্যের উপর নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু তৈরী পোশাক শিল্পকে আরও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার জন্য কাস্টমস বন্ডের মাধ্যমে শুল্কবিহীন পণ্য আমদানীর সুযোগ প্রদান করেছে। কিছু সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী এই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে শুল্ক ফ্রি আমদানীকৃত পণ্য স্থানীয় বাজারে স্বল্প মূল্যে ছেড়ে দিচ্ছে। এক দিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আশির দশকে টেক্সটাইল শিল্প দেশীয় শিল্প হিসাবে যাত্রা শুরু করে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরে (নব্বই দশকের শুরুতে), সরকার বিশ্ব বাজারে এই দেশীয় শিল্পের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতেই রপ্তানীর পরিমানের উপর ভিত্তি করে টেক্সটাইল মালিকদেরকে ২৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। সরকার এই খাত থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল এবং রপ্তানি শুল্ক ফিরিয়ে আনার সুবিধাগুলি প্রবর্তন করে এবং পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে বন্ডের সুবিধা চালু করা হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য এই; যে ব্যবসা ২৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং এই খাতটি যখন পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়, নগদ প্রণোদনার হারও ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে বর্তমানে ৪ শতাংশে উপনীত হয়েছে। পোশাক শিল্পে সরকারের এই প্রণোদনা দেওয়ার পিছনে যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। যখন কোন ব্যবসায়ী প্রতিবেশী দেশগুলি (যেমন ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড ইত্যাদি) থেকে কোন পণ্য আমদানি করেন তখন পণ্যের মূল্যের সাথে তার কিছু অতিরিক্ত ব্যয়ও (উদাহরণঃ ব্যাংক চার্জ, পণ্যে গাড়ীতে উঠানো ও নামানো ইত্যাদি) হয়ে থাকে। যেহেতু বাংলাদেশের পোশাক শিল্প তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করে, সেহেতু এই সুবিধা প্রদান না করলে উক্ত প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। সরকার ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফ্রি সুবিধা প্রদান করছেন। যেখানে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানীর উপর আনুমানিক ৪০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফ্রি করে দেওয়া হয়।
এটা অনুমান করা হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার গার্মেন্টস আছে কিন্তু বিজিএমইএ অধীনে নিবন্ধনকৃত গার্মেন্টস এর সংখ্যা পঁচিশ শত থেকে তিন হাজার। সুতরাং বাকি গার্মেন্টসের কোন কাগজপত্র না থাকা সত্বেও তারা তাদের কার্যক্রম পরিচলনা করে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই, কিছু বৈধ ও অবৈধ গার্মেন্টস এবং অল্প সংখ্যক টেক্সটাইল মিল আছে, যারা সরকারের প্রদত্ত বন্ড সুবিধাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে মুনাফা উপার্জন করছে এবং দেশীয় শিল্পকে হুমকির মুখে পতিত করছে।
আইন অনুযায়ী বন্ডের লাইসেন্স ব্যবহারের এর প্রধান শর্ত হল বন্ডের পণ্য রপ্তানী ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু আইনে এটাও উল্লেখ আছে, যদি কোন ব্যবসায়ী বন্ডের মালামাল সামগ্রী স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে চায় (সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ), সেক্ষেত্রে বন্ড কমিশনারেট থেকে অনুমতি পত্র সংগ্রহ এবং বাণিজ্যিক শুল্ক প্রদান করতে হবে। এই আইন লংঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের যথাযথ আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখতিয়ার রয়েছে। বর্তমানে কিছু সংখ্যক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আইনকে তোয়াক্কা না করেই তাদের আমদানীকৃত বন্ডের কাপড় খোলা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে এবং একটি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে, দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, কারণ বন্ডের কাপড় শুল্কমুক্ত হওয়ায় এর বাজারদর তুলনামূলক কম। এজন্য স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না এবং প্রতিযোগীতামূলক বাজারে ক্রমান্বয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ্ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সোয়াজ বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন যৌথভাবে ডিপার্টমেন্ট অফ্ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিফিড) এর অর্থায়নে বাংলাদেশের কাস্টমস বন্ডের অপব্যবহার শীর্ষক গবেষণাকর্মটি পরিচলনা করছে। বন্ডের মালামাল স্থানীয় বাজারে প্রবেশের ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প অস্তিত্বহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হল কাস্টমস শুল্কের হার কমিয়ে বন্ডের অপব্যবহার হ্রাস করা এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্পকে রক্ষা করা। গবেষণায় দেখা যায় যে, বন্ডের অপব্যবহার এমন একটি জটিল প্রক্রিয়া যা ক্রেতার অর্ডার থেকে শুরু করে পণ্য বিপণনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত হইতে পারে। বন্ডের এই অপব্যবহার মূলত দুইভাবে হয়ে থাকে যথা: বৈধ পথে এবং অবৈধ পথে। বৈধ পথ বলতে গার্মেন্টস মালিক ক্রেতার অর্ডারের উপর ভিত্তি করে সকল অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পন্ন করবে কিন্তু তার মধ্যে কোন এক জায়গায় অর্থের লোভে আকৃষ্ট হয়ে এই সূক্ষ্ম অপকর্মটি করে থাকে।
এক, বিদেশী ক্রেতার অর্ডারের উপর ভিত্তি করে বিজিএমইএ ইউটিলাইজেশন ডিক্লিয়ারেশন (ইউডি) ইস্যু করে এবং ঐ ইউডির বিপরীতে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ইউটিলাইজেশন পারমিশন (ইউপি) দিয়ে থাকেন। এই ইউপি ব্যবসায়ীকে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আনতে সাহায্য করে। বিজিএমইএ ইউডি ইস্যু করার সময় ঐসকল অসৎ ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাপড় আনার জন্য চাহিদা পত্র দিয়ে থাকে। উদাহরন: একটি শার্টের জন্য ১ মিটার কাপড় প্রয়োজন কিন্তু তিনি তার চাহিদা পত্রে ১.২০ মিটার কাপড় প্রয়োজন উল্লেখ করেন। যদি তার অর্ডার এক লক্ষ শার্টের জন্য হয়ে থাকে তাহলে বিশ হাজার শার্টের কাপড় অতিরিক্ত নিয়ে আসবে। বিশ হাজার শার্টের কাপড় যেহেতু শুল্কমুক্ত এবং স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা থাকার কারণে উক্ত কাপড় ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে।
দুই, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানী করে হরমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোডের মাধ্যমে। অনেকসময় ইউডিতে ইস্যুকৃত এইচএস কোডের কাপড়ের পরিবর্তে অন্য এইচএস কোডের কাপড় নিয়ে আসে। যেমন, ইউডিতে ৫০ কাউন্ট সুতার কাপড় নিয়ে আসার কথা উল্লেখ থাকা স্বত্বেও ৮০ কাউন্ট সুতার কাপড় নিয়ে আসে। সাধারণত সুতার কাউন্ট যত বেশী কাপড়ের মূল্য তত বেশী হবে। সেই হিসাবে ৮০ কাউন্ট সুতার মূল্য ৫০ কাউন্ট সুতার তুলনায় বহুগুণ।
তিন, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত কাপড়গুলো পরিমাপ করা হয় কেজিতে। সেক্ষেত্রে কাপড় যত মিহি (চিকন সুতা) হবে ওজনও তত কম হবে। উদাহরণঃ যদি এক কেজিতে দুইটি প্যান্টের কাপড় হয়, সেখানে সমপরিমাণ ওজনে ১০টি থ্রি-পিসের কাপড় পাওয়া যায়। বর্তমান বাজার মূল্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্যান্টের কাপড়ের তুলনায় থ্রি-পিসের মূল্য অনেক বেশী।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল এসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর মতে ১৩০টি গার্মেন্টস মালিকেরা এই কাজে সম্পর্কিত। বিটিএমএ এর সদস্যরা দেশের প্রাইমারী টেক্সটাইল সেক্টরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি বিনিয়োগ করেছে এবং দেশের পোষাক শিল্পের প্রয়োজনীয় ইয়ার্ণ ও ফেব্রিকের সিংহভাগ যোগান দেওয়া ছাড়াও দেশের মানুষের ব্যবহারের জন্য কাপড় সমানভাবে যোগান দিয়ে যাচ্ছে। বিটিএমএ এর মতে দেশের স্থানীয় টেক্সটাইলের বাজারটি প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এই বাজারটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বন্ডেড ওয়্যার হাউজের মাধ্যমে নিয়ে আসা অবৈধ বিদেশী কাপড়ে। তাদের মতে, বছরে প্রায় আট-দশ লাখের বেশী থ্রী-পিস, বিপুল পরিমান শাড়ী, শার্ট-প্যান্টের কাপড়সহ অনান্য বস্ত্র সামগ্রী বিভিন্ন পথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে ভ্রমণ ভিসা (নিউ মার্কেটের দোকানদাররা, অনলাইন শপিং পেজ, ঈদের শপিং), সীমান্ত হাট এবং আন্ত:সীমান্ত চোরাকারবারীর মাধ্যমেই বেশি ফেব্রিক্স আসে।
পোশাক শিল্পের মালিকরা বন্ড লাইসেন্স এর মাধ্যমে যে কাপড় আমদানী করে তা দুই বছরের জন্য তাদের নিজস্ব কারখানায় সঞ্চয় করে রাখতে পারে। বন্ড কমিশনারেট প্রতি বছর নিরীক্ষণের মাধ্যমে উক্ত পোশাক শিল্পের ক্রেতার অর্ডারের সাথে মজুতকৃত কাঁচামালের হিসাব মিলিয়ে থাকেন। যদি অর্ডার এবং সঞ্চয়ের মধ্যে কোন ব্যত্যয় ঘটলে সাথে সাথেই আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য যে, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ৭৬টি গার্মেন্টস কে চিহ্নিত করেছে, যারা এই অসৎ কাজে জড়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, অনেক পোশাক শিল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের অবকাঠামোগত কোন অস্তিত্ব নেই কিন্তু কাগজ-কলমে তা সক্রিয়। এক্ষেত্রে তাদের বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বড় পাইকারি কাপড়ের বাজারগুলোর মধ্যে ঢাকার ইসলামপুর, নরসিংদীর মাধবদী, এবং নারায়ণগঞ্জের টান বাজার অন্যতম। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট পোশাক শিল্পের পাশাপাশি এই সকল বাজারেও বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিক অভিযানসমূহ কিছুটা হলেও দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরী করছে। পুলিশের সহায়তায় বন্ড কমিশনারেট প্রতিনিয়ত ইসলামপুরে অভিযান পরিচলনা করছে এবং বন্ডে আসা কাপড়ের ট্রাক জব্দ করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কাপড় ব্যবসায়ী সমিতিও তাদের মাসিক মিটিং এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে যে কোন ব্যবসায়ী বন্ডের অবৈধ মালামাল বিক্রি করতে পারবেনা। আর ইহার ব্যত্যয় ঘটলে মালিক সমিতি তার কোন দায়িত্ব নিবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত বাণিজ্যিকভাবে আমদানীকৃত পণ্যের শুল্কহার কমিয়ে দেওয়া, যাতে বন্ডের অপব্যবহার কমে। কারণ আমদানীকৃত পণ্যের শুল্ক তুলনামূলক কম হলে কাপড় ব্যবসায়ীরা বন্ডের কাপড় বিক্রয় করবে না, এতে তাদের ব্যবসায়িক মূলধন হারানোর ঝুঁকি অনেক বেশী। তাই সরকারের উচিত গবেষণার মাধ্যমে এই শুল্ক নীতিমালা পুনরায় প্রনায়ন করা। তাহলে, সরকার একদিকে যেমন এই সেক্টর থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারবে, অন্য দিকে দেশীয় শিল্পকেও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
মুল লেখকঃ
রায়হান আহমেদ
ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ্ গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কর্মরত। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব, প্রতিষ্ঠানের নয়।
গবেষণাটি করা হয়েছে এন্টি করাপশন এভিডেন্স (এইস) সমষ্টির অংশ হিসেবে, সওয়াস-এইস-এর অর্থায়নে।
1 টি মন্তব্য:
Very informative.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন