জিরো ওয়েস্ট ডেনিম | ZERO Waste Denim
ডেনিম কাপড় তৈরিতে পরিবেশের ক্ষতি বিপুল। কিন্তু বিপর্যয় ঠেকাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিচ্ছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। তৈরি করছে বর্জ্য আর দূষণহীন ডেনিম।
ফ্যাশনে ডেনিম ট্রেন্ড কখনো পুরোনো হওয়ার নয়। তাই এর চাহিদারও শেষ নেই। ডেনিমের সীমাহীন চাহিদা মেটাতে গিয়েই পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে ডেনিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
একটি ডেনিম প্যান্ট বানাতে খরচ হয় অন্তত সাত হাজার লিটার স্বচ্ছ পানি! অর্থাৎ একজন মানুষ ছয় বছরে যে পরিমাণ পানি পান করে, একই পরিমাণ দিয়ে তৈরি হয় যেকোনো পোশাকের জন্য প্রয়োজনীয় ডেনিম। আর জিনসে রং করার জন্য যে রাসায়নিক রঞ্জক ব্যবহার করা হয়, তা খুবই ক্ষতিকর।
ডেনিমে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কেমিক্যাল ইন্ডিগো। এগুলো বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকর রাসায়নিক তেল এবং ইঁদুরের বিষ থেকে তৈরি।
ডেনিমে কেমিক্যাল শুধু রঙের জন্য নয়, কাপড় নরম করার কাজেও লাগে। এটি যেখানে উৎপাদন করা হয়, বিশেষ করে ধোয়া হয়, তার আশপাশের জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। পাশাপাশি এর তরল বর্জ্য জলাশয় ও পানির অন্যান্য উৎসকেও দূষিত করে। এখন কারোরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ডেনিম পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে।
তবে সুখের বিষয়, পশ্চিমের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্র্যান্ড কয়েক বছর ধরে বাজারে আনছে ‘জিরো ওয়েস্ট সাসটেইনেবল ডেনিম’। একেক কোম্পানি একেক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এখানে বাদ যাচ্ছে না লেজার টেকনোলজি, পিছিয়ে নেই রিসাইকেল পদ্ধতি। একনজরে জেনে নেওয়া যাক জিরো ওয়েস্ট ডেনিম তৈরির নানা দিক সম্পর্কে।
জিরো ওয়েস্ট বা সাসটেইনেবল ডেনিম তৈরিতে অবশ্যই সাসটেইনেবল ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রিসাইকেল কটন, অর্গানিক কটন, বিসিআই কটন, লাইওসেল (একধরনের রেয়ন) ফেব্রিক ইত্যাদি। এ ছাড়া পলিয়েস্টার ফেব্রিকও ব্যবহার করা হয়।
1. ন্যানোবাবল টেকনোলজি
এই পদ্ধতিতে খুব কম পানি ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে ডেনিম পরিষ্কার করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতির মতো এতে কোনো ধরনের স্টোন ওয়াশের প্রয়োজন হয় না। এখানে পানি ও রাসায়নিক পদার্থ একসঙ্গে মিশিয়ে যে মাইক্রোবাবল তৈরি করা হয়, তাতে একধরনের ফিশিং ইফেক্ট দেয়, ফলে শুধু বিশাল পরিমাণ পানিই নয়, সাশ্রয় হয় কেমিক্যাল ও বিদ্যুৎও।
2. লেজার টেকনোলজি
ড্রাই প্রসেস, যেমন হুইস্কার, স্যান্ডলিং, ডিস্ট্রাকশন—সবই লেজার মেশিনে করা সম্ভব। এতে বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। কোনো ক্ষতিকর পিপি স্প্রে, পানি ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
3. ওজোন মেশিন
প্রচলিত পদ্ধতিতে ডেনিম ব্লিচ করার জন্য সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা হয়। ওজোন মেশিনে এসব রাসায়নিক ছাড়াই অল্প পানি দিয়ে ব্লিচ করা যায়।
4. সাসটেইনেবল গার্মেন্ট ডায়িং টেকনোলজি
খুব সহজে পরিবেশবান্ধব রং দিয়ে কাপড় রাঙানোর পদ্ধতি হচ্ছে সাসটেইনেবল গার্মেন্ট ডায়িং টেকনোলজি। ডেনিম রং করতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এভাবে ডেনিম প্রস্তুত করে ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির চেয়ে ৮০ শতাংশ পানি, ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে। আর কেমিক্যালের ব্যবহার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কম।
যেসব ব্র্যান্ড সাসটেইনেবল ডেনিম বানাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে জিনোলজিয়া, মাড জিনস, লিভাইস, এভারলেন ইত্যাদি।
জিনোলজিয়া এবং মাড জিনস যে ওজোন টেকনোলজি ব্যবহার করছে, তাতে একই সঙ্গে ডেনিম উৎপাদনে পানি, এনার্জি ও কেমিক্যালের ব্যবহার অনেকাংশে কমে আসছে। এভারলিন ডেনিমের জিনস বানানো হয় সাইটেক্সে, যা বিশ্বের সবচেয়ে স্বচ্ছ ডেনিম ফ্যাক্টরি। এখানে পানি রিসাইকেলের সুব্যবস্থা আছে। একটি এভারলেন ডেনিম বানাতে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ লিটার পানি খরচ হয়।
‘ওয়ারপ প্লাস ওয়েফট’ সাইজ ইনক্লুসিভ ডেনিম ব্র্যান্ড
‘ওয়ারপ প্লাস ওয়েফট’ সাইজ ইনক্লুসিভ ডেনিম ব্র্যান্ড ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ডেনিম এবং সাশ্রয় করেছে ৫৭২ দশমিক ৪ মিলিয়ন গ্যালন পানি। এ ব্র্যান্ডের ডেনিম প্রস্তুতে ব্যবহার করা হয় অর্গানিক কটন, পরিবেশবান্ধব রং, পানিসাশ্রয়ী টেকনিক ও সোলার পাওয়ার। আউটারনোনের সিএআই ১০০ ভাগ অর্গানিক কটন দিয়ে জিনস প্রস্তুত করছে লাইফটাইম গ্যারান্টির সঙ্গে। যদি কোনো জিনসের প্যান্ট বা অন্য প্রোডাক্ট ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ঠিক করার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
বিশেষ করে বলতে হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেনিম ব্র্যান্ড লিভাইসের কথা। ২০১০ সালে তারা প্রথমে বাজারে এনেছিল বেটার ইনিশিয়েটিভ কটন (বিসিআই) ফেব্রিকের জিনস। এই তুলা উৎপাদনে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এখন ২০ ভাগ বিসিআই ব্যবহার করে ডেনিম ছাড়াও আরও অনেক প্রোডাক্ট বানানো হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে এর ব্যবহার ১০০ ভাগ করা হবে।
ডেনিম তৈরিতে ‘ওয়াটারলেস’ টেকনিক ব্যবহার করছে লিভাইস
এ ছাড়া ডেনিম প্রস্তুতে লিভাইসের ‘ওয়াটারলেস’ টেকনিক ব্যবহার করে সাশ্রয় করা হয়েছে ৩ বিলিয়ন লিটার পানি এবং রিসাইকেল করা হয়েছে ২ বিলিয়ন লিটার পানি।
৬৭ ভাগ লিভাইস প্রোডাক্ট এই ‘ওয়াটারলেস’ পদ্ধতিতে বানানো হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে তা ৮০ ভাগে নিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া এই ব্র্যান্ড সম্প্রতি লঞ্চ করেছে তাদের কটনস ব্লু জিনস গো গ্রিন প্রোগ্রাম, যেখানে ময়লার ভাগাড় থেকে সংগৃহীত জিনস ঘরবাড়ি বানানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
Written By :
ফাহমিদা শিকদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন