'মেড ইন বাংলাদেশ'
জার্মানির এক বিখ্যাত ক্লথিং স্টোরে কাজ করতে গিয়ে আজকাল প্রায়ই আমার মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর বানানো সেই সিমেন্টের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে। মাল্টিন্যাশনাল সেই দোকানের নব্বই ভাগ কাপড়ের লেবেলেই ঝলঝল করে লেখা- 'মেড ইন বাংলাদেশ'। জার্মানি আসার কিছুদিন পর কোনো এক শপিংমলে হঠাৎ 'মেইড ইন বাংলাদেশ' লেখা দেখে আতকে উঠেছিলাম। অতি আবেগতাড়িত হয়ে তা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ নিয়ে কাজ করার পরো এখনো সেই আবেগ একটুও কমেনি। ম্যানেজারকে দেখলেই ইচ্ছে করে ডেকে এনে একটা কাপড়ের লেবেল দেখিয়ে বলি- ''লুক, স্যার। উই আর প্রাউড।"
চোখের সামনে যখন শত শত ইউরোপিয়ানকে সেই মেড ইন বাংলাদেশ লেখা প্রোডাক্ট অবলীলায় কিনে নিয়ে যেতে দেখি বাংলাদেশী হিসাবে তখন নিজেকে কারোর চেয়ে কম মনে হয় না।
তবে শুধু বাংলাদেশে তৈরি কাপড়ই যে সারাবিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা না। এই ক্লথিং স্টোরে আমার মতোই পার্ট-টাইম কাজ করা এক বিদেশী স্টুডেন্টের সাথে পরিচয়। ইংরেজি না জানা মানুষদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে আমি সবসময় আমার জার্মান ভাষার মুর্খতা লুকাই। আমার সেই কলিগের জার্মান স্কিল যতোটা ভালো ইংরেজি জ্ঞান ততোটাই দুর্বল। তবুও প্রথম থেকেই আমার সাথে তার কথা বলার অতি আগ্রহ দেখে বিস্মিতই হলাম। সাম ইংলিশ আর আইন বিসিয়েন জার্মান দিয়ে সে আমাকে যা বললো তা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। বাংলাদেশের এক মেয়ের সাথে ফেসবুকে তার তিন বছরের সম্পর্ক।
সেই মেয়েকে বিয়ে করার মনস্থির করার পর থেকে এক বছর ধরে টাকা জমাচ্ছে সে। জার্মানিতে একজন স্টুডেন্টর লাইফ কতোটা সংগ্রামী হতে পারে তা আমার অজানা নয়। সেই মেয়েকে জার্মানিতে আনতে যে টাকার প্রয়োজন তার জন্য আরো তিন বছর কাজ করে তা জমাবে সে। আমাকে মেয়ের ছবি দেখিয়ে কেমন হবে তা জানতে চাইলো। আমার তখন সবই বুঝা হয়েছে শুধু একটা বিষয় ছাড়া। বাংলাদেশী সে মেয়ের তো জার্মান জানার কথা না। ছেলের যে ইংরেজি জ্ঞান, তাহলে তাদের মধ্যে কথা হয় কিভাবে। অবশ্য সুন্দর একটা সম্পর্কে ভাষা কতোটা অনাবশ্যক তা জানতে আমার 'লাভ একচ্যুয়ালি' দেখতে হয়নি। বার্লিন থেকে ডর্টমুন্ডের বাসে আমার পিছনের সিটে ছিল একজোড়া কাপল আর পাশের সিটে ছিলো আরেকজোড়া।আজীবন সিংগেলদের প্রতিনিধি আমি মাঝের সিটে একা বসে কানে হেডফোন গুজে এই প্রেমে ভরা পৃথিবী থেকে নির্বাসনে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পিছনের কাপলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে তা আর পারলাম কই। ইউরোপে এসে নতুন কোনো ভাষা না শিখতে পারলেও পরিচিত হয়েছি পৃথিবীর প্রধান সব ভাষার সাউন্ডের সাথে। সেই ভাষা জ্ঞান থেকে বুঝলাম এরা অন্তত চারটি ভাষায় ঝগড়া করছে। জার্মান, ইংরেজি, স্প্যানিশ আর ইটালিয়ান। এই খুনসুটি কি তাদের পলিগট হওয়ার প্র্যাকটিস কিনা তা অবশ্য বুঝতে পারলাম না। তবে পাশের সিটের কাপলরা যে ঝগড়া করছে না তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।কারণ তাদের মুখে কোনো ভাষা নেই। মেয়েটি সত্যিকারের বধির কিনা তা জানিনা, তবে ছেলেটি কথা বলছিলো নিঃশব্দে দুহাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে। তাদের অসাধারণ বোঝাপড়া দেখে মনে মনে আবারো ভাবলাম- নীরবতাই এ পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, বাকি সব ভাষাই অর্থহীন অনুবাদ।
আমার কলিগ সেই ফরেন স্টুডেন্ট নিশ্চই আমার স্বদেশী মেয়ের সাথে ফেসবুকে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলেনি। জিজ্ঞেস করতেই সে বললো- এটা কোনো সমস্যা না। ফেসবুকে চ্যাট করার সময় বিভিন্ন ট্রান্সলেটর অ্যাপ দিয়ে সে জার্মান ল্যাংগুয়েজকে ট্রান্সলেট করে নেয়। তাছাড়া সে টুকটাক যা ইংরেজি জানে তা দিয়েও চলে। পৃথিবীর কোনো শক্তির কাছেই যেখানে ভালোবাসা পরাজয় মেনে নেয়নি, ভাষা তো সেখানে নস্যি।
বাংলাদেশি মেয়ে বিয়ে করলে কেমন হবে তা জিজ্ঞেস করায় তাকে আমি দামী একখানা টি-শার্টের লেবেল দেখিয়ে বললাম-" চালিয়ে যাও, বন্ধু। মেড ইন বাংলাদেশ মানেই অলওয়েজ টপ কোয়ালিটি। হোক সেটা বস্ত্র অথবা মানুষ।"
Written By
NH Ashis Khan Vai
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন