সিল্ক ফাইবার । Silk Fibre - Textile Lab | Textile Learning Blog
Silk Yarn (রেশম সুতা) কি? ও কেমন করে হয়? 

ইতিহাস ও সম্ভাবনা:

Silk Fiber বা রেশম তন্তু বা সুতা, রেশম মথ নামে এক ধরনের মথের লার্ভার লালাগ্রন্থি বা রেশ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের তৈরি। এরা আথোপোডা (Arthropoda) পর্বের অন্তর্ভুক্ত ইনসেক্টা (Insecta) শ্রেণীর লেপিডটেরা (Lepidoptera) বর্গের পতঙ্গ। রেশম পোকার ইংরেজি নাম সিল্ক ওর্য়াম (Silk Worm)। ওর্য়াম (Worm) শব্দের অর্থ কীট। Silk Worm এর অর্থ দাঁড়ায় রেশম কীট। কৃমি জাতীয় প্রাণীদের কীট বলা হয়। আসলে এরা দেখতে কৃমির মত নয়। তবে এরা পূর্ণবয়স্ক হলে প্রজাপতির মত দেখায়। তাই কীট না বলে পোকা বলাই বরং ভাল। বিভিন্ন প্রজাতির রেশম মথ বিভিন্ন মানের রেশম সুতা তৈরি করে। আমাদের দেশে যে রেশম পোকা পাওয়া যায় তার বৈজ্ঞানিক নাম বোমবিক্র মোরি (Bombyx mori)


রেশম সূতার ইতিহাস-

চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিস্কৃত হয়। এর সর্বপ্রাচীন নমুনা পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের। কথিত আছে‒খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ শতাব্দীতে লেইজু (Leizu) নামের এক সম্রাজ্ঞী বাগানে বসে সহচরীদের নিয়ে চা পান করছিলেন, এমন সময় একটি রেশমগুটি তার চায়ের পাত্রে এসে পড়ে, তার এক বালিকা সহচরী দ্রুত পাত্র থেকে গুটিটি তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, গুটি থেকে এক ধরনের মিহি সুতো বের হচ্ছে। সম্রাজ্ঞী বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই সুতা থেকে উন্নত মানের কাপড় বোনা সম্ভব। এরপর সম্রাজ্ঞীর আদেশে রেশমগুটি সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয় এবং পরে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়।

পরে সম্রাজ্ঞীর আদেশে প্রাসাদের ভিতরে মেয়েরা প্রথম রেশম কাপড় তৈরি করা শুরু করে। সে সময় প্রাসাদ রমণীদের একটি বড় বিনোদনের বিষয় ছিল রেশম বুনন। তারপর হাজার বছর ধরে রেশমি কাপড় কিভাবে তৈরি করা হয়, তা চীনারা গোপন রাখে। রেশম আবিষ্কারের ফলে চিত্রশিল্পের ক্ষেত্র এক বিশাল অগ্রগতি হয়। চীনে রেশমি কাপড়ের উপর ওপর ছবি এঁকে এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টেনিয়ানের আদেশে দুজন ইউরোপীয় পাদ্রী গোপনে রেশম উৎপাদনের কৌশল শিখে নেন।

৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, ইউরোপে রেশম চাষ শুরু হয়। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহরে পরিণত হয়েছিল। বহু আগে থেকে বাংলাদেশে রেশমের চাষ হয়ে আসছে। চীন থেকে রেশমের চাষ বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, না কি এখানাকার স্থানীয় মানুষ নিজেরাই আবিষ্কার করেছিল এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় মিহি রেশমের কাপড়কে বলা হয়, "অংশুপট্ট। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষেরদিকে লিখিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গে সূক্ষ্মবস্ত্র সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সেখানে পত্রোর্ণ নামক বস্ত্রের উল্লেখ আছে যেটি এক প্রকার বুনো রেশমবস্ত্র। পত্রোর্ণ (জাত) বস্ত্র পুন্ডদেশে (পৌন্ড্রিকা) উৎপন্ন হতো।


পত্রোর্ণজাত বস্ত্র বলতে এন্ডি ও মুগজাতীয় বস্ত্রকে (পত্র হইতে যাহার উর্ণা (পত্রোর্ণ) বুঝানো হয়েছে। অমরকোষ এর মতে পত্রোর্ণ সাদা অথবা ধোয়া কোষের বস্ত্র; কীট বিশেষের জিহতারস কোনও কোনও বৃক্ষপত্রকে এই ধরনের উর্ণায় রূপান্তরিত করে।


প্রাচীনকালে বাংলাদেশে উৎকৃষ্টতার বিচারে রেশম কাপড়কে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। এই ভাগ তিনটি হলো−

গরদ:
সর্বোৎকৃষ্ট মানের রেশম সুতা থেকে এই কাপড় তৈরি করা হতো। এই কাপড় পড়তেন রাজ-পারিবার এবং অভিজাত পরিবারের মেয়েরা।

তসর:
অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের রেশম সুতা থেকে এই কাপড় তৈরি করা হতো। এই কাপড় কখনো কখনো রাজ-পারিবার এবং অভিজাত পরিবারের মেয়েরা পরতেন। তবে মধ্যবিত্ত সমাজে এর কদর ছিল। অনেক সময় অভিজাত পরিবারে পর্দার কাজে তসরের কাপড় ব্যবহার করা হতো।

মটকা:
গরদ এবং তসর জন্য রেশম সুতা তৈরির সময় যে বাতিলযোগ্য অংশ পড়ে থাকতো, তার সাথে কিছু ভালো রেশমের সুতা যুক্ত করে মটকার সুতা তৈরি করা হতো। মটকা দিয়ে গায়ের চাদর, পড়নের ধুতি তৈরি করা হতো.


রেশম পোকার জীবনচক্র - 

রেশম পোকার জীবনে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত। এই পর্যায় চারটি হলো‒ তা হল ডিম (egg), শূককীট (larva), মূককীট (pupa) ও পূর্ণাঙ্গ পোকা। পূর্ণাঙ্গ দশার পোকাকে সাথারণভাবে মথ (moth) বলে।


রেশম পোকা নিশাচর। এদের গায়ের রঙও অনুজ্জ্বল। স্ত্রী মথ গাছের পাতার উপরে চলার সময় প্রায় ৪০০- ৫০০ ডিম পাড়ে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার শেষে স্ত্রী মথ মারা যায়। ডিমের রঙ ফ্যাকাশে হলুদ। ৮-৯ দিনের মাথায় ডিমের গায়ে কালো কালো দাগ পড়ে। প্রায় ১০ দিনের দিকে পুরো ডিম কালচে হয়ে যায়। এরপর ১১-১২ দিনের মাথায় ডিম ফুটে শূককীট বের হয়। শূককীটের প্রাথমিক দশায় পুল বলা হয়।

প্রাথমিক দশায় এদের গায়ের রঙ থাকে হাল্কা বাদমী আভাযুক্ত সাদা। এরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকে। এরা প্রচুর পরিমাণ তুঁত গাছের পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। এই সময় এরা দিনে প্রায় ১১-১৩ বার তুঁত পাতা খায়। এরপর ১৮-২৪ ঘণ্টা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এরপর এরা দেহের খোলস পাল্টায় এবং আবার তুঁত পাতা খাওয়া শুরু করে।  এইভাবে এরা চারবার খোলস বদলায়। পূর্ণাঙ্গ শূককীট প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হয় এবং তিনটি খণ্ডে (মস্তক, বক্ষ ও উদর) বিভক্ত থাকে। এদের বক্ষে তিন জোড়া এবং উদরে পাঁচ জোড়া পা থাকে। দেহের পার্শ্ব বরাবর দশ জোড়া শ্বাস-ছিদ্র থাকে।

চতুর্থবার খোলস বদলানোর পর এরা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মূককীটে পরিণত হতে শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ মূককীটের দেহের ভিতরে একটি লম্বা রেশম গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থিতে থাকে এক প্রকার রস। নালী দিয়ে এ রস মুখের বাইরে আসে। নালীর নাম স্পিনারেট (Spinneret)। বাতাসের সংস্পর্শে রস শক্ত হয়ে যায়। এরা এই সময় মিনিটে প্রায় ৬৫ বার মুখ ঘুরিয়ে রস দিয়ে দেহের চারপাশে আবরণ তৈরি করে। ধীরে ধীরে এই আবরণ শক্ত খোলসে পরিণত হয়। এই আবরণসহ মূককীটকে গুটি (Cocoon) বলে। রেশম পোকার এই পরিবর্তনকে মেটামোর্ফোসিস (Metamorphosis) বলে। এই সময় এদের দেহের আকার ছোটো হয়ে যায়।


 প্রায় ১০ দিন মূককীট দশায় থাকার পর, এদের দেহ থেকে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়। এই রস খোলসের একটি প্রান্ত গলিয়ে ফেলে। এরপর এরা গুটি কেটে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই সময়ই রেশম পোকা তার জীবনচক্রে পূর্ণাঙ্গ মথ দশা পায়। মথ দশায় রেশম পোকার দেহ মাথা, বক্ষ ও উদরে বিভক্ত থাকে। মাথায় এক জোড়া পুঞ্জাক্ষী ও এক জোড়া এন্টেনা থাকে। এর বক্ষস্থলের দুই পাশে চারটি (২ +২) পা থাকে। এছাড়া অঙ্কীয় দেশের দুই পাশে থাকে। ৬টি (৩+৩) পা থাকে। গুটি কেটে পুরুষ মথগুলো আগে বেরিয়ে আসে। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় স্ত্রী-পুরুষ মথ যৌন মিলনে অংশ নেয়,  একটি গুটিতে ৪০০ – ৫০০ গজ সুতা থাকে। এরপর পুরুষ পথটি মারা যায়। আর স্ত্রী মথ ডিম পাড়ার পর মারা যায়।


রেশমগুটি থেকে রেশম সুতা সংগ্রহ - 

শূককীট দশা শেষ করে রেশম পোকা তার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, দেহ নিঃসৃত লালা দিয়ে দেহকে আবৃত করে ফেলে এবং একটি ডিম্বাকৃতির গুটিতে পরিণত হয়। রেশম চাষীরা এই গুটি গরম পানিতে চুবিয়ে রেশমপোকা মেরে ফেলে। একই সাথে গরম পানির সংস্পর্শে গুটি নরম হয়ে আলগা হয়ে যায়। এই সময় চাষীরা যত্নের সাথে কাঠি দিয়ে রেশম সুতার একটি প্রান্ত বের করে আনে। এই প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে টেনে টেনে দীর্ঘ সুতা বের করে আনা হয়। এই সুতাকেই রেশম সুতা বলা হয়।


রেশম বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের আবহাওয়া রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। ভালো মানের রেশম গুটি উৎপাদন করে তা বেশি দামে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া বিদেশে রেশম সুতা থেকে প্রস্তুত করা বস্ত্রের বেশ চাহিদা রয়েছে। রেশম চাষ করে তাই দেশের আর্থিক উন্নতি করা সম্ভব। রেশম চাষ করতে হলে তুঁত গাছের চাষ করতে হবে কারণ রেশম পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। সাদা তুঁত, কালো তুঁত এবং লাল তুঁত-এ তিন প্রজাতির গাছে রেশম পোকা চাষ করা যায়। তবে সাদা তুঁত গাছই রেশম পোকার সবচেয়ে পছন্দের। তুঁত গাছ একবার লাগালে ২০-২৫ বছর ধরে পাতা দেয়,

Silk (রেশম) দেশীয় উৎপাদন/ রপ্তানি/সম্ভাবনা - 

দেশে রেশম সুতার উৎপাদন পর্যাপ্ত নয়। সে কারণে ব্যবসায়ীদের ভরসা ছিল আমদানি করা সুতা। কিন্তু চীন ছাড়া সব দেশই রেশম সুতা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পর্যাপ্ত রেশম সুতা না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন রেশম বা সিল্ক ব্যবসায়ীরা। আবার রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকেই মূল্য বাড়ানো ও দেশে এ সুতা আমদানিতে অধিক হারে শুল্ক দিতে হওয়ায় আমদানি করা রেশম সুতার দাম পড়ছে অনেক বেশি। রেশম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেশম সুতার বার্ষিক চাহিদা ৩০০ মেট্রিক টন।


দেশে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টন সুতা। চাহিদার বাকি সুতা ব্যবসায়ীরা চীন থেকে আমদানি করে থাকেন।

বর্তমানে প্রতি কেজি মিহি সুতা তিন হাজার ৩০০ ও মোটা সুতা এক হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর চীন থেকে আমদানি করা সুতার দাম পাঁচ হাজার ১০০ থেকে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে সুতা আমদানিতে ১২ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ২৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ উৎসে কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও পিএসআইয়ের জন্য ১ শতাংশ মাশুল দিতে হয়। এসব কারণে কাপড়ের দামও গেছে বেড়ে। বছর খানেক আগেও যেখানে রাজশাহী সিল্কের শাড়ির দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকায়।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুতার সংকট, শাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে চাহিদা হ্রাস আর সিল্ক কারখানাগুলো শাড়িনির্ভর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ছয় বছর আগেও রাজশাহীর সপুরার বিসিক শিল্পনগরে ৬০ থেকে ৭০টি সিল্ক কারখানা ছিল। বর্তমানে চালু আছে মাত্র তিন-চারটি। এখন আমরা আমাদের দেশের  চাহিদার ২০%  শতাংশও তারা পূরণ করতে করতে পারি না। আমাদের দেশের Spinning mill মালিক রা চাইলে, এই "রেশম সুতার" সাথে ভিবিন্ন  Fixed Fiber যেমন: Cotton+ Silk, Acrylic+Silk, Cotton+Silk+Lacra, Cotton Slub+Silk, Fancy Yarn Item ইত্যাদি Mixed করে Fabrics শিল্পে  ও Sweater Yarn শিল্পে - দেশে ও বিদেশে সহজে Export করে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা পেতে পারে।

- Ahmed Rubel

সিল্ক ফাইবার । Silk Fibre

Silk Yarn (রেশম সুতা) কি? ও কেমন করে হয়? 

ইতিহাস ও সম্ভাবনা:

Silk Fiber বা রেশম তন্তু বা সুতা, রেশম মথ নামে এক ধরনের মথের লার্ভার লালাগ্রন্থি বা রেশ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের তৈরি। এরা আথোপোডা (Arthropoda) পর্বের অন্তর্ভুক্ত ইনসেক্টা (Insecta) শ্রেণীর লেপিডটেরা (Lepidoptera) বর্গের পতঙ্গ। রেশম পোকার ইংরেজি নাম সিল্ক ওর্য়াম (Silk Worm)। ওর্য়াম (Worm) শব্দের অর্থ কীট। Silk Worm এর অর্থ দাঁড়ায় রেশম কীট। কৃমি জাতীয় প্রাণীদের কীট বলা হয়। আসলে এরা দেখতে কৃমির মত নয়। তবে এরা পূর্ণবয়স্ক হলে প্রজাপতির মত দেখায়। তাই কীট না বলে পোকা বলাই বরং ভাল। বিভিন্ন প্রজাতির রেশম মথ বিভিন্ন মানের রেশম সুতা তৈরি করে। আমাদের দেশে যে রেশম পোকা পাওয়া যায় তার বৈজ্ঞানিক নাম বোমবিক্র মোরি (Bombyx mori)


রেশম সূতার ইতিহাস-

চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিস্কৃত হয়। এর সর্বপ্রাচীন নমুনা পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের। কথিত আছে‒খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ শতাব্দীতে লেইজু (Leizu) নামের এক সম্রাজ্ঞী বাগানে বসে সহচরীদের নিয়ে চা পান করছিলেন, এমন সময় একটি রেশমগুটি তার চায়ের পাত্রে এসে পড়ে, তার এক বালিকা সহচরী দ্রুত পাত্র থেকে গুটিটি তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, গুটি থেকে এক ধরনের মিহি সুতো বের হচ্ছে। সম্রাজ্ঞী বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই সুতা থেকে উন্নত মানের কাপড় বোনা সম্ভব। এরপর সম্রাজ্ঞীর আদেশে রেশমগুটি সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয় এবং পরে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়।

পরে সম্রাজ্ঞীর আদেশে প্রাসাদের ভিতরে মেয়েরা প্রথম রেশম কাপড় তৈরি করা শুরু করে। সে সময় প্রাসাদ রমণীদের একটি বড় বিনোদনের বিষয় ছিল রেশম বুনন। তারপর হাজার বছর ধরে রেশমি কাপড় কিভাবে তৈরি করা হয়, তা চীনারা গোপন রাখে। রেশম আবিষ্কারের ফলে চিত্রশিল্পের ক্ষেত্র এক বিশাল অগ্রগতি হয়। চীনে রেশমি কাপড়ের উপর ওপর ছবি এঁকে এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টেনিয়ানের আদেশে দুজন ইউরোপীয় পাদ্রী গোপনে রেশম উৎপাদনের কৌশল শিখে নেন।

৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, ইউরোপে রেশম চাষ শুরু হয়। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহরে পরিণত হয়েছিল। বহু আগে থেকে বাংলাদেশে রেশমের চাষ হয়ে আসছে। চীন থেকে রেশমের চাষ বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, না কি এখানাকার স্থানীয় মানুষ নিজেরাই আবিষ্কার করেছিল এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় মিহি রেশমের কাপড়কে বলা হয়, "অংশুপট্ট। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষেরদিকে লিখিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গে সূক্ষ্মবস্ত্র সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সেখানে পত্রোর্ণ নামক বস্ত্রের উল্লেখ আছে যেটি এক প্রকার বুনো রেশমবস্ত্র। পত্রোর্ণ (জাত) বস্ত্র পুন্ডদেশে (পৌন্ড্রিকা) উৎপন্ন হতো।


পত্রোর্ণজাত বস্ত্র বলতে এন্ডি ও মুগজাতীয় বস্ত্রকে (পত্র হইতে যাহার উর্ণা (পত্রোর্ণ) বুঝানো হয়েছে। অমরকোষ এর মতে পত্রোর্ণ সাদা অথবা ধোয়া কোষের বস্ত্র; কীট বিশেষের জিহতারস কোনও কোনও বৃক্ষপত্রকে এই ধরনের উর্ণায় রূপান্তরিত করে।


প্রাচীনকালে বাংলাদেশে উৎকৃষ্টতার বিচারে রেশম কাপড়কে ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। এই ভাগ তিনটি হলো−

গরদ:
সর্বোৎকৃষ্ট মানের রেশম সুতা থেকে এই কাপড় তৈরি করা হতো। এই কাপড় পড়তেন রাজ-পারিবার এবং অভিজাত পরিবারের মেয়েরা।

তসর:
অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের রেশম সুতা থেকে এই কাপড় তৈরি করা হতো। এই কাপড় কখনো কখনো রাজ-পারিবার এবং অভিজাত পরিবারের মেয়েরা পরতেন। তবে মধ্যবিত্ত সমাজে এর কদর ছিল। অনেক সময় অভিজাত পরিবারে পর্দার কাজে তসরের কাপড় ব্যবহার করা হতো।

মটকা:
গরদ এবং তসর জন্য রেশম সুতা তৈরির সময় যে বাতিলযোগ্য অংশ পড়ে থাকতো, তার সাথে কিছু ভালো রেশমের সুতা যুক্ত করে মটকার সুতা তৈরি করা হতো। মটকা দিয়ে গায়ের চাদর, পড়নের ধুতি তৈরি করা হতো.


রেশম পোকার জীবনচক্র - 

রেশম পোকার জীবনে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত। এই পর্যায় চারটি হলো‒ তা হল ডিম (egg), শূককীট (larva), মূককীট (pupa) ও পূর্ণাঙ্গ পোকা। পূর্ণাঙ্গ দশার পোকাকে সাথারণভাবে মথ (moth) বলে।


রেশম পোকা নিশাচর। এদের গায়ের রঙও অনুজ্জ্বল। স্ত্রী মথ গাছের পাতার উপরে চলার সময় প্রায় ৪০০- ৫০০ ডিম পাড়ে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার শেষে স্ত্রী মথ মারা যায়। ডিমের রঙ ফ্যাকাশে হলুদ। ৮-৯ দিনের মাথায় ডিমের গায়ে কালো কালো দাগ পড়ে। প্রায় ১০ দিনের দিকে পুরো ডিম কালচে হয়ে যায়। এরপর ১১-১২ দিনের মাথায় ডিম ফুটে শূককীট বের হয়। শূককীটের প্রাথমিক দশায় পুল বলা হয়।

প্রাথমিক দশায় এদের গায়ের রঙ থাকে হাল্কা বাদমী আভাযুক্ত সাদা। এরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকে। এরা প্রচুর পরিমাণ তুঁত গাছের পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। এই সময় এরা দিনে প্রায় ১১-১৩ বার তুঁত পাতা খায়। এরপর ১৮-২৪ ঘণ্টা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এরপর এরা দেহের খোলস পাল্টায় এবং আবার তুঁত পাতা খাওয়া শুরু করে।  এইভাবে এরা চারবার খোলস বদলায়। পূর্ণাঙ্গ শূককীট প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হয় এবং তিনটি খণ্ডে (মস্তক, বক্ষ ও উদর) বিভক্ত থাকে। এদের বক্ষে তিন জোড়া এবং উদরে পাঁচ জোড়া পা থাকে। দেহের পার্শ্ব বরাবর দশ জোড়া শ্বাস-ছিদ্র থাকে।

চতুর্থবার খোলস বদলানোর পর এরা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মূককীটে পরিণত হতে শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ মূককীটের দেহের ভিতরে একটি লম্বা রেশম গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থিতে থাকে এক প্রকার রস। নালী দিয়ে এ রস মুখের বাইরে আসে। নালীর নাম স্পিনারেট (Spinneret)। বাতাসের সংস্পর্শে রস শক্ত হয়ে যায়। এরা এই সময় মিনিটে প্রায় ৬৫ বার মুখ ঘুরিয়ে রস দিয়ে দেহের চারপাশে আবরণ তৈরি করে। ধীরে ধীরে এই আবরণ শক্ত খোলসে পরিণত হয়। এই আবরণসহ মূককীটকে গুটি (Cocoon) বলে। রেশম পোকার এই পরিবর্তনকে মেটামোর্ফোসিস (Metamorphosis) বলে। এই সময় এদের দেহের আকার ছোটো হয়ে যায়।


 প্রায় ১০ দিন মূককীট দশায় থাকার পর, এদের দেহ থেকে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়। এই রস খোলসের একটি প্রান্ত গলিয়ে ফেলে। এরপর এরা গুটি কেটে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই সময়ই রেশম পোকা তার জীবনচক্রে পূর্ণাঙ্গ মথ দশা পায়। মথ দশায় রেশম পোকার দেহ মাথা, বক্ষ ও উদরে বিভক্ত থাকে। মাথায় এক জোড়া পুঞ্জাক্ষী ও এক জোড়া এন্টেনা থাকে। এর বক্ষস্থলের দুই পাশে চারটি (২ +২) পা থাকে। এছাড়া অঙ্কীয় দেশের দুই পাশে থাকে। ৬টি (৩+৩) পা থাকে। গুটি কেটে পুরুষ মথগুলো আগে বেরিয়ে আসে। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় স্ত্রী-পুরুষ মথ যৌন মিলনে অংশ নেয়,  একটি গুটিতে ৪০০ – ৫০০ গজ সুতা থাকে। এরপর পুরুষ পথটি মারা যায়। আর স্ত্রী মথ ডিম পাড়ার পর মারা যায়।


রেশমগুটি থেকে রেশম সুতা সংগ্রহ - 

শূককীট দশা শেষ করে রেশম পোকা তার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, দেহ নিঃসৃত লালা দিয়ে দেহকে আবৃত করে ফেলে এবং একটি ডিম্বাকৃতির গুটিতে পরিণত হয়। রেশম চাষীরা এই গুটি গরম পানিতে চুবিয়ে রেশমপোকা মেরে ফেলে। একই সাথে গরম পানির সংস্পর্শে গুটি নরম হয়ে আলগা হয়ে যায়। এই সময় চাষীরা যত্নের সাথে কাঠি দিয়ে রেশম সুতার একটি প্রান্ত বের করে আনে। এই প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে টেনে টেনে দীর্ঘ সুতা বের করে আনা হয়। এই সুতাকেই রেশম সুতা বলা হয়।


রেশম বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের আবহাওয়া রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। ভালো মানের রেশম গুটি উৎপাদন করে তা বেশি দামে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া বিদেশে রেশম সুতা থেকে প্রস্তুত করা বস্ত্রের বেশ চাহিদা রয়েছে। রেশম চাষ করে তাই দেশের আর্থিক উন্নতি করা সম্ভব। রেশম চাষ করতে হলে তুঁত গাছের চাষ করতে হবে কারণ রেশম পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। সাদা তুঁত, কালো তুঁত এবং লাল তুঁত-এ তিন প্রজাতির গাছে রেশম পোকা চাষ করা যায়। তবে সাদা তুঁত গাছই রেশম পোকার সবচেয়ে পছন্দের। তুঁত গাছ একবার লাগালে ২০-২৫ বছর ধরে পাতা দেয়,

Silk (রেশম) দেশীয় উৎপাদন/ রপ্তানি/সম্ভাবনা - 

দেশে রেশম সুতার উৎপাদন পর্যাপ্ত নয়। সে কারণে ব্যবসায়ীদের ভরসা ছিল আমদানি করা সুতা। কিন্তু চীন ছাড়া সব দেশই রেশম সুতা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পর্যাপ্ত রেশম সুতা না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন রেশম বা সিল্ক ব্যবসায়ীরা। আবার রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকেই মূল্য বাড়ানো ও দেশে এ সুতা আমদানিতে অধিক হারে শুল্ক দিতে হওয়ায় আমদানি করা রেশম সুতার দাম পড়ছে অনেক বেশি। রেশম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেশম সুতার বার্ষিক চাহিদা ৩০০ মেট্রিক টন।


দেশে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টন সুতা। চাহিদার বাকি সুতা ব্যবসায়ীরা চীন থেকে আমদানি করে থাকেন।

বর্তমানে প্রতি কেজি মিহি সুতা তিন হাজার ৩০০ ও মোটা সুতা এক হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর চীন থেকে আমদানি করা সুতার দাম পাঁচ হাজার ১০০ থেকে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে সুতা আমদানিতে ১২ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ২৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ উৎসে কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও পিএসআইয়ের জন্য ১ শতাংশ মাশুল দিতে হয়। এসব কারণে কাপড়ের দামও গেছে বেড়ে। বছর খানেক আগেও যেখানে রাজশাহী সিল্কের শাড়ির দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকায়।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুতার সংকট, শাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে চাহিদা হ্রাস আর সিল্ক কারখানাগুলো শাড়িনির্ভর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ছয় বছর আগেও রাজশাহীর সপুরার বিসিক শিল্পনগরে ৬০ থেকে ৭০টি সিল্ক কারখানা ছিল। বর্তমানে চালু আছে মাত্র তিন-চারটি। এখন আমরা আমাদের দেশের  চাহিদার ২০%  শতাংশও তারা পূরণ করতে করতে পারি না। আমাদের দেশের Spinning mill মালিক রা চাইলে, এই "রেশম সুতার" সাথে ভিবিন্ন  Fixed Fiber যেমন: Cotton+ Silk, Acrylic+Silk, Cotton+Silk+Lacra, Cotton Slub+Silk, Fancy Yarn Item ইত্যাদি Mixed করে Fabrics শিল্পে  ও Sweater Yarn শিল্পে - দেশে ও বিদেশে সহজে Export করে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা পেতে পারে।

- Ahmed Rubel

কোন মন্তব্য নেই: