পরিত্যক্ত কলাগাছ থেকে উন্নত মানের সুতা!
পাহাড়ে সারা বছরই কলা উৎপাদন হয়। আর পরিত্যক্ত কলাগাছ সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়, যা কোনো কাজেই আসে না। সেটা নিয়ে এসেছে পাহাড়ে নতুন সম্ভাবনা। অব্যবহৃত পরিত্যক্ত কলাগাছের বাকল থেকে উন্নত মানের সাশ্রয়ী ও পরিবেশবন্ধব কলাসুতা তৈরি হচ্ছে; যা সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। আর অবশিষ্টাংশ নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো কম্পোস্ট) সার। এ ছাড়াও এই কলাসুতার সঙ্গে পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের কাগজ, হ্যান্ডি ক্রাফট, হ্যান্ডব্যাগসহ নানা পণ্য।
উদ্যোক্তারা বলছেন, লোডশেডিংমুক্ত সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ থাকলে উদ্যোগটি কার্যকর শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। প্রকল্পটি সঠিক সম্প্রসারণ করতে সরকারের সহযোগিতা দরকার। মনোমুগ্ধকর এসব পণ্য এলাকার চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও রফতানি করা সম্ভব। এ অঞ্চলের বেকার সমস্যা কাটিয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ইতোমধ্যে উৎপাদিত সুতা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
জানা গেছে, খাগড়াছড়িতে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এই প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম অফিসার আশুতোষ রায় বলেন, ‘আমাদের দেশে কলাগাছের বাকল কোনো কাজে আসে না। কলা সংগ্রহের পর কৃষক গাছটি কেটে ফেলেন। এটি পরিত্যক্ত হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু পরিত্যক্ত বাকল থেকে ফাইবার বা সুতা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া গেছে। একটি কলাগাছের বাকল থেকে কমপক্ষে ২০০ গ্রাম আর এক কেজি ফাইবার পেতে পাঁচটি কলাগাছ দরকার হয়। এক কেজি কলাসুতার বাজারমূল্য প্রায় ১৩০ টাকা।’
তিনি জানান, প্রতিটি কলাগাছ ১৫ টাকা দরে কেনা হয়। তবে দূর থেকে কলাগাছ আনতে পরিবহন খরচ বেশি হয়। এ কারণে খরচও একটু বাড়ে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কলাগাছের বাকল থেকে ফাইবার বা সুতা উৎপাদন অত্যন্ত লাভজনক। কলার বাকল থেকে ফাইবার অংশ সংরক্ষণের পর অবশিষ্ট অংশ ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা যায়। কৃষক পর্যায়ে ভার্মি কম্পোস্টের বেশ চাহিদা রয়েছে। প্রতি কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার বিক্রি হয়ে ২০ টাকায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গঞ্জপাড়ায় চলছে কলাগাছের বাকল থেকে সুতা উৎপাদনের কাজ। জার্মান দাতা সংস্থা ওয়েলথ হাঙ্গার হিলফের অর্থায়নে ‘আনন্দ বিল্ডিং কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ অব স্মল হোল্ডারস ইন বাংলাদেশ’ প্রজেক্টের আওতায় চলছে এই প্রকল্প। কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ওয়েস্ট এগ্রো। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘আনন্দ’ এই কার্যক্রমটি শুরু করে।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পের শুরুতে বিদ্যুতের লো-ভল্টেজের কারণে উৎপাদনে ধীরগতি ছিল। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে নতুন সাব-স্টেশন চালু হওয়ায় এ সমস্যা অনেকটাই কেটে গেছে। উৎপাদনও বেড়েছে। তবে ধান কাটার মৌসুমের কারণে শ্রমিক সংকটে উৎপাদন একটু ব্যাহত হচ্ছে। তারা আরো জানান, শ্রমিকদের কাজের ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হয়। প্রতি কেজি ফাইবাব বা সুতা উৎপাদনে একজন শ্রমিক পান ১৩ টাকা। দৈনিক একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ৫০ কেজি পর্যন্ত সুতা উৎপাদন করতে পারেন।
কর্মরত শ্রমিকরা বলেন, ‘নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকলে কাজ চলে। তবে লোডশেডিংয়ে কাজ থাকে না। তখন উৎপাদন কমে যায়। আমাদের মজুরি হয় না। তখন ভর দিন কাজ করেও ৩০০ টাকা আয় করা যায় না। তবে বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। উৎপাদিত সুতা দুই দিন ছায়ামুক্ত স্থানে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর তা গাইড বেঁধে বাজারজাত করতে হয়।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আনন্দের নির্বাহী পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর কলা হয়, এখানে কলাগাছ সহজলভ্য। কলাগাছের বাকল থেকে প্রাপ্ত সুতা অত্যন্ত টেকসই, মানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব। জুট বা কটনের মিশ্রণে তৈরি করলে এটি আরো টেকসই হয়। যা দলিল, স্ট্যাম্প বা এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি কাগজের জন্য খুবই কার্যকর। এই ফাইবার মিশ্রিত কাগজ ৩৫০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তিনি জানান, বর্তমানে প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে খাগড়াছড়িতে চালু হয়েছে। এটি সফলতা পেলে এই প্রকল্প আরো সম্প্রসারণ করা যাবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, পরিত্যক্ত কলাগাছ থেকে তৈরি সুতা, প্রাপ্ত সুতার সঙ্গে ফাইবার জুট বা তুলার মিশ্রণে কাগজ, হ্যান্ডি ক্রাফট, হ্যান্ডব্যাগসহ নানা পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্পটি সঠিকভাবে সম্প্রসারণ করতে পারলে এসব মনোমুগ্ধকর পণ্য এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে রফতানি করা সম্ভব। এতে এলাকার বেকার সমস্যা দূর করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব। প্রকল্পটি সম্প্রসারণে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
তথ্যসূত্র: প্রতিদিনের সংবাদ ডটকম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন