ন্যাচারাল ডাইজের উৎপত্তির ইতিহাস | Natural Textile Dyes - Textile Lab | Textile Learning Blog
ন্যাচারাল ডাইজের উৎপত্তির ইতিহাসঃ
রাসায়নিকভাবে  ডাই তৈরির পূর্বে প্রাকৃতিক উৎসই ছিলো টেক্সটাইল ডাইযের প্রধান উৎস। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এসব প্রাকৃতিক উৎস থেকে রঙ আহরণ ও প্রস্তুত করতো। ঠিক কোন সময়ে এই প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছে তা নিয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া যায় না । কারো কারো মতে, ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রথম প্রাকৃতিক ডাই এর ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় । আবার অন্যদিকে স্পেনের ‘এল কাস্টিলো’ (El Castillo) গুহার ভেতরে আবিষ্কৃত রঙিন গুহাচিত্র থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে এসব গুহাচিত্র চিত্রিত হয়েছিলো। জর্জিয়া অঞ্চলে ফ্লাক্স ফাইবারে ব্যবহার করা ডাই থেকে জানা যায় যে, এটি প্রায় ৩৪,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রঙিন করা হয়েছিলো।

নীল গাছ এবং প্রাপ্ত নীল বা ইন্ডিগো ডাই

প্রাকৃতিক ডাই এর ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে একেক ভৌগোলিক অঞ্চলে ব্যবহৃত ডাই মূলত সেই অঞ্চলের গাছপালা কিংবা প্রাণী-পোকামাকড় থেকে তৈরি করা হয়। যেমন- ইন্ডিগো (Indigo) বা নীল নামক রঙের উৎস হচ্ছে নীলগাছ (Indigofera), যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ওক গাছের পোকা থেকে তৈরি করা হয় ক্রিমসন ডাই, ককিনিয়াল (Cochineal) নামক একপ্রকার পতঙ্গ থেকে পাওয়া যায় কারমিন (Carmine) নামক লাল পিগমেন্ট।

ক্যাকটাসের উপর ককিনিয়াল কলোনি ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত কারমিন এদিতে্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি ডাই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,

১. ইন্ডিগো ডাইজ বা নীল – যা নীলগাছ থেকে পাওয়া যায় এবং নীল বর্ণ ধারণ করে। একে সবচেয়ে প্রাচীন ও বহুল ব্যবহৃত রং হিসেবে ধরা হয়।

২. অ্যালিজারিন (Alizarin) – অ্যালিজারিন মূলত ম্যাডার (Madder) নামক লতাবিশেষ গাছ থেকে প্রস্তুত করা লাল ডাই। এই লাল ডাই আবার ক্রেমিস বা ককিনিয়াল নামক পতঙ্গ থেকে আহরণ করা হয়।

৩. টিরিয়ান পার্পল (Tyrian Purple) – এই রঙের মূল উৎস বিশেষ প্রকার শামুকের গ্রন্থি।

৪. হলুদ – হলুদই মনে হয় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ডাই এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর মূল উৎস বিভিন্ন ধরনের গাছের শিকড়, বাকল কিংবা ফুল।

সামুদ্রিক শামুক থেকে প্রস্তুত টিরিয়ান পারপাল

যদিও এসব ডাই প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ও সহজলভ্য, কিন্তু এসব ডাই এর প্রস্তুতি খুবই সময়সাপেক্ষ এবং একইসাথে ব্যয়বহুল। যেমন- ধরা যাক টিরিয়ান পারপালের কথা। এটি সামুদ্রিক শামুকের গ্রন্থি থেকে তৈরি করা হয়। সামুদ্রিক শামুক অবশ্যই সহজলভ্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায় ১২,০০০ শামুক থেকে আহরণ করা ডাই এর পরিমাণ হবে মাত্র ১.৪ গ্রাম। এ কারণে এই ডাই খুবই দামী এবং সেসময়ের রাজপরিবারেই এই ডাই দিয়ে রঙ করা পোষাক ব্যবহার করা হত। অন্যদিকে ১,৫০,৫০০টি ককিনিয়াল পতঙ্গের শুষ্ক দেহ থেকে ১ কেজি কারমিন ডাই প্রস্তুত করা যায়।

আরো কিছু প্রাকৃতিক ডাই এবং তাদের ইতিহাস 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মান রসায়নবিদ জোহান জ্যাকব ডিজবাখ ককিনিয়াল থেকে প্রাপ্ত কারমিন ডাই নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করছিলেন। তিনি একপর্যায়ে এই অনুসিদ্ধান্তে আসেন যে, তিনি এই লাল কারমিন ডাই এর সাথে অ্যালাম, আয়রন বা পটাশ মেশালে একপ্রকার বিবর্ণ লাল রঙ পাওয়া যাবে। অ্যালাম এবং আয়রন দিয়ে তিনি মোটামুটি সঠিক রঙ পেলেন। কিন্তু পটাশ মেশানোর পর তিনি দেখেন যে, আরো মূল্যবান সামুদ্রিক নীল (Ocean blue) বর্ণ তৈরি হয়েছে। পটাশ মিশ্রণের পরে এটি কারমিন ডাই এর রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়েই নীল রঙ ধারণ করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে নীল রঙ খুবই দুষ্প্রাপ্য। সেখানে এই নীল রঙের আবির্ভাব সত্যিই চমকপ্রদ। ডিজবাখের আবিষ্কৃত এই ডাই প্রুশিয়ান ব্লু (Prussian Blue) নামেও পরিচিত।


জোহান জ্যাকব ডিজবাখ এবং তার আবিষ্কৃত প্রুশিয়ান ব্লু

এই ঘটনার (বা দুর্ঘটনার) পর থেকে আস্তে আস্তে আরো নানা রঙের আবিষ্কার হতে থাকে। তবে প্রাকৃতিক ডাই এর ঝামেলাপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ প্রস্তুত প্রণালীর কারণে এই ডাই এর দাম ও স্বল্পতা থেকেই যায়। প্রাকৃতিক ডাই এর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এটি সাধারণভাবে ব্যবহার করতে গেলে আরেকটি মধ্যবর্তী যৌগের প্রয়োজন পড়ে, যাদের বলা হয় মর্ডান্ট। মর্ডান্ট ব্যবহার করার ফলে প্রাকৃতিক ডাই ব্যবহৃত বস্তুতে লেগে থাকতে পারে। কিন্তু এর ব্যবহারের ফলে অনেক সময় রঙের  রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে অন্য রঙের আবির্ভাব ঘটতে পারে। আবার মর্ডান্ট ব্যবহার করা হলেও কিছুদিন পরেই প্রাকৃতিক ডাই বিবর্ণ হতে শুরু করে। ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুন কোনো পদ্ধতি, যার সাহায্যে সহজে ডাই প্রস্তুত করা যায় এবং যার স্থায়িত্ব হবে আরো বেশি।



ন্যাচারাল ডাইজের উৎপত্তির ইতিহাস | Natural Textile Dyes

ন্যাচারাল ডাইজের উৎপত্তির ইতিহাসঃ
রাসায়নিকভাবে  ডাই তৈরির পূর্বে প্রাকৃতিক উৎসই ছিলো টেক্সটাইল ডাইযের প্রধান উৎস। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এসব প্রাকৃতিক উৎস থেকে রঙ আহরণ ও প্রস্তুত করতো। ঠিক কোন সময়ে এই প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছে তা নিয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া যায় না । কারো কারো মতে, ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রথম প্রাকৃতিক ডাই এর ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় । আবার অন্যদিকে স্পেনের ‘এল কাস্টিলো’ (El Castillo) গুহার ভেতরে আবিষ্কৃত রঙিন গুহাচিত্র থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে এসব গুহাচিত্র চিত্রিত হয়েছিলো। জর্জিয়া অঞ্চলে ফ্লাক্স ফাইবারে ব্যবহার করা ডাই থেকে জানা যায় যে, এটি প্রায় ৩৪,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রঙিন করা হয়েছিলো।

নীল গাছ এবং প্রাপ্ত নীল বা ইন্ডিগো ডাই

প্রাকৃতিক ডাই এর ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে একেক ভৌগোলিক অঞ্চলে ব্যবহৃত ডাই মূলত সেই অঞ্চলের গাছপালা কিংবা প্রাণী-পোকামাকড় থেকে তৈরি করা হয়। যেমন- ইন্ডিগো (Indigo) বা নীল নামক রঙের উৎস হচ্ছে নীলগাছ (Indigofera), যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ওক গাছের পোকা থেকে তৈরি করা হয় ক্রিমসন ডাই, ককিনিয়াল (Cochineal) নামক একপ্রকার পতঙ্গ থেকে পাওয়া যায় কারমিন (Carmine) নামক লাল পিগমেন্ট।

ক্যাকটাসের উপর ককিনিয়াল কলোনি ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত কারমিন এদিতে্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি ডাই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,

১. ইন্ডিগো ডাইজ বা নীল – যা নীলগাছ থেকে পাওয়া যায় এবং নীল বর্ণ ধারণ করে। একে সবচেয়ে প্রাচীন ও বহুল ব্যবহৃত রং হিসেবে ধরা হয়।

২. অ্যালিজারিন (Alizarin) – অ্যালিজারিন মূলত ম্যাডার (Madder) নামক লতাবিশেষ গাছ থেকে প্রস্তুত করা লাল ডাই। এই লাল ডাই আবার ক্রেমিস বা ককিনিয়াল নামক পতঙ্গ থেকে আহরণ করা হয়।

৩. টিরিয়ান পার্পল (Tyrian Purple) – এই রঙের মূল উৎস বিশেষ প্রকার শামুকের গ্রন্থি।

৪. হলুদ – হলুদই মনে হয় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ডাই এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর মূল উৎস বিভিন্ন ধরনের গাছের শিকড়, বাকল কিংবা ফুল।

সামুদ্রিক শামুক থেকে প্রস্তুত টিরিয়ান পারপাল

যদিও এসব ডাই প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ও সহজলভ্য, কিন্তু এসব ডাই এর প্রস্তুতি খুবই সময়সাপেক্ষ এবং একইসাথে ব্যয়বহুল। যেমন- ধরা যাক টিরিয়ান পারপালের কথা। এটি সামুদ্রিক শামুকের গ্রন্থি থেকে তৈরি করা হয়। সামুদ্রিক শামুক অবশ্যই সহজলভ্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায় ১২,০০০ শামুক থেকে আহরণ করা ডাই এর পরিমাণ হবে মাত্র ১.৪ গ্রাম। এ কারণে এই ডাই খুবই দামী এবং সেসময়ের রাজপরিবারেই এই ডাই দিয়ে রঙ করা পোষাক ব্যবহার করা হত। অন্যদিকে ১,৫০,৫০০টি ককিনিয়াল পতঙ্গের শুষ্ক দেহ থেকে ১ কেজি কারমিন ডাই প্রস্তুত করা যায়।

আরো কিছু প্রাকৃতিক ডাই এবং তাদের ইতিহাস 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মান রসায়নবিদ জোহান জ্যাকব ডিজবাখ ককিনিয়াল থেকে প্রাপ্ত কারমিন ডাই নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করছিলেন। তিনি একপর্যায়ে এই অনুসিদ্ধান্তে আসেন যে, তিনি এই লাল কারমিন ডাই এর সাথে অ্যালাম, আয়রন বা পটাশ মেশালে একপ্রকার বিবর্ণ লাল রঙ পাওয়া যাবে। অ্যালাম এবং আয়রন দিয়ে তিনি মোটামুটি সঠিক রঙ পেলেন। কিন্তু পটাশ মেশানোর পর তিনি দেখেন যে, আরো মূল্যবান সামুদ্রিক নীল (Ocean blue) বর্ণ তৈরি হয়েছে। পটাশ মিশ্রণের পরে এটি কারমিন ডাই এর রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়েই নীল রঙ ধারণ করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে নীল রঙ খুবই দুষ্প্রাপ্য। সেখানে এই নীল রঙের আবির্ভাব সত্যিই চমকপ্রদ। ডিজবাখের আবিষ্কৃত এই ডাই প্রুশিয়ান ব্লু (Prussian Blue) নামেও পরিচিত।


জোহান জ্যাকব ডিজবাখ এবং তার আবিষ্কৃত প্রুশিয়ান ব্লু

এই ঘটনার (বা দুর্ঘটনার) পর থেকে আস্তে আস্তে আরো নানা রঙের আবিষ্কার হতে থাকে। তবে প্রাকৃতিক ডাই এর ঝামেলাপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ প্রস্তুত প্রণালীর কারণে এই ডাই এর দাম ও স্বল্পতা থেকেই যায়। প্রাকৃতিক ডাই এর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এটি সাধারণভাবে ব্যবহার করতে গেলে আরেকটি মধ্যবর্তী যৌগের প্রয়োজন পড়ে, যাদের বলা হয় মর্ডান্ট। মর্ডান্ট ব্যবহার করার ফলে প্রাকৃতিক ডাই ব্যবহৃত বস্তুতে লেগে থাকতে পারে। কিন্তু এর ব্যবহারের ফলে অনেক সময় রঙের  রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে অন্য রঙের আবির্ভাব ঘটতে পারে। আবার মর্ডান্ট ব্যবহার করা হলেও কিছুদিন পরেই প্রাকৃতিক ডাই বিবর্ণ হতে শুরু করে। ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুন কোনো পদ্ধতি, যার সাহায্যে সহজে ডাই প্রস্তুত করা যায় এবং যার স্থায়িত্ব হবে আরো বেশি।



কোন মন্তব্য নেই: