Dignity History of Bangladesh Textiles Yarn & Fabrics -
মসলিন তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুত করা এক প্রকারের অতি সুক্ষণ কাপড়। এটি প্রস্তুত করা হতো পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে। মসলিনে তৈরী করা পোশাকসমূহ এতই সুক্কণ ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দেশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে উনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় ভাবে প্রস্তুত করা বস্ত্রের উপরে ৭০ হতে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানীকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিলো। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁতশিল্পে ধ্বস নামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মসলিন উৎপাদন বন্ধ করার জন্য মসলিন বয়নকারী তাঁতীদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেয় বলে কথিত আছে
মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় উৎপন্ন তুলা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি করে তা দিয়েই বোনা হতো মসলিন। আর কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে সুক্ষতা আর দক্ষতা ফুটিয়ে তোলার যে জ্ঞান সেটা তাঁতিরা অর্জন করতেন অনেকটা বংশানুক্রমেই। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ঢাকায় পা রাখা একাধিক পর্যটকের হাত ধরে মসলিন এর খ্যাতি পৌঁছে যায় চীন থেকে রোম অবধি।
সেখানকার সম্রাট আর রাজা-বাদশাদের উপঢৌকন হিসেবে সীমিত আকারে রপ্তানি হতে থাকে ঢাকাই মসলিন। একই ভাবে মসলিন এর উন্নত ও অনুন্নত কিছু সংস্করণ সে সময় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছেও। তবে ঢাকাই মসলিন তার খ্যাতি এবং মনোযোগের শীর্ষে পৌঁছায় মূলত মোঘল শাসনামলেই।
ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, জঙ্গলবাড়ি এবং বাজিতপুর এলাকার যেসব তাঁতিরা মসলিন কাপড় বুনতেন তারা টিকে থাকার স্বার্থে তাদের কাজের ধরণ পাল্টে ফেলেন। ফলে যুগ যুগ ধরে যে বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য আর অভিজ্ঞতা মসলিনকে দিয়েছিল আকাশছোঁয়া খ্যাতি, সেই মসলিন বুননের জ্ঞানও হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। মানের অবনমনের পাশাপাশি সুক্ষ তন্তুজাত এই শাড়ি সংরণের অভাবে হারিয়ে যায় ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকেও। ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত জেমস টেলর তার ‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা’ গ্রন্থে ঢাকাই মসলিন রফতানি সংক্রান্ত যে হিসাব দেখিয়েছেন তাতে তিনি জানাচ্ছেন, ওই সময় সোনারগাঁ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন রফতানি হতো। মধ্যযুগে বিশেষ করে মুঘল আমলে মসলিন শিল্পের চরম বিকাশ ঘটে। মসলিন বয়ন উপযোগী আবহাওয়া নদীবেষ্টিত অথবা দীঘির তীরে গড়ে উঠেছিল এই শিল্প কেন্দ্র। এ কারণে বয়নশিল্পের জন্য সোনারগাঁ ছিল শ্রেষ্ঠ আদর্শ স্থান। রমণীমোহন একটি শাড়ির জন্য প্রায় ৩০ গ্রাম সুতা তৈরি করতে তাঁতিদের সময় লাগত ২ মাস। ২ হাত প্রস্থ ৪০ হাত দৈর্ঘ্য একটি মসলিন বস্ত্র বুনতে তাঁত শিল্পীদের সময় লাগত ১ থেকে ৩ মাস। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ২ হাত প্রস্থ ও ৩০ হাত দৈর্ঘ্য একখণ্ড মসলিন বস্ত্রের মূল্য ছিল তখনকার ব্রিটিশ মুদ্রায় ৩০ পাউন্ড। মুঘল আমলে মসলিন বস্ত্রে সোনালি ও রুপালি সুতায় তৈরি জমিনে মনি-মুক্তা আর মূল্যবান পাথর বসিয়ে নকশা করা হতো। ১ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ৪০০ গ্রাম ওজনের ১ নল সুতার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৫০ মাইল। ১ ইঞ্চির ১৫০০ ভাগের ১ ভাগ মাপের সূক্ষ্ম সুতার মসলিন বুনতে স্থানীয়ভাবে তৈরি ১২৬টি বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো। ১৭৫ গজ বা ৩৫০ হাত মসলিন এক সঙ্গে করলে কবুতরের একটি ডিমের আকারের সমান হতো। বিভিন্ন নামের আর বিভিন্ন মানের মসলিন বস্ত্র তৈরি করতেন বয়নশিল্পীরা। এর মধ্যে অন্যতম ছিল : মলবুসখাস, মলমলখাস, শবনম, কস্তিদার, আবে-ই-রওয়া ইত্যাদি। বাংলার সেই বিশ্বখ্যাত মসলিনের অপমৃত্যু ঘটে ইংরেজ বেনিয়া রাজের হাতে। নিজেদের বস্ত্রের বাজার একচেটিয়া দখলে নিতে তারা অপকর্ম করে। কথিত আছে, এই বর্বর ও নিষ্ঠুর শাসকরা মসলিন তৈরির সঙ্গে জড়িত সব বয়নশিল্পীদের আঙ্গুল কেটে দিয়ে চিরতরে ধ্বংস করে দেয় বাংলার গৌরব ঐতিহ্যবাহী মসলিন শিল্প। মসলিন এখন শুধু আমাদের স্মৃতিময় সোনালি ইতিহাস
। -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন